দেশে নানা ধরনের মন্দ খবরের মাঝেও একটি সুখবর মনে হচ্ছে একঝাঁক পরিচ্ছন্ন যুবককে নিয়ে আওয়ামী যুবলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা। যেটি বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অনেকটাই অবিশ্বাস্য। যুবলীগের গত কমিটির বিদায়টি সুখকর ছিল না। যুবলীগের ইসমাইল হোসেন সম্রাট, আনিসসহ দেশের নানাস্থানে মুষ্টিমেয় ব্যক্তির কৃতকর্মের কারণে অন্ধকার গলিতে ঢুকে পড়েছিল যুবলীগ। এমন জায়গায় সংগঠনটি পৌঁছে গিয়েছিল যে দেশের সাধারণ মানুষের সামনে সংগঠনটিকে দৈত্য হিসেবে আকৃতি দেয়ার মন্দ চেষ্টা দেখেছি। এর মাধ্যমে সংগঠনটির পাঁচ দশকের ত্যাগ-তিতিক্ষা মুছে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল।
১৯৭২ সালের ১১ নভেম্বর শেখ ফজলুল হক মনির নেতৃত্বে দেশের যুবশক্তিকে সম্পদে পরিণতকরণ ও দেশ পুনর্গঠনের ব্রত নিয়ে জন্ম নিয়েছিল যুবলীগ। সম্রাট-পাপিয়াদের মতো কতিপয় নষ্ট ব্যক্তির দলবাজি ও কৃতকর্মের কারণে যুবলীগকে নষ্ট মানুষের সংগঠন হিসেবে চিত্রায়নের প্রচেষ্টা লক্ষণীয় ছিল। কতিপয় নষ্ট মানুষের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের কারণেই অনেকের মধ্যে এ ধারণা ছিল ক্রমান্বয়ে নষ্ট মানুষদের হাতে রাজনীতি বন্দী হচ্ছে। যাকে আর ফেরানো যাবে না।
সম্ভাবনাময় তরুণ-যুবারা হতাশ হয়েছিলেন। অনেকের মধ্যে এ ধারণা বদ্ধমূল হতে দেখা গেছে ভালো মানুষের রাজনীতি করার আর সুযোগ নেই। যে যত দু-নম্বর সে তত বড় নেতা! তার মূল্যায়ন মানি আর মাসলের ওপর। মাসলম্যানরা মন্দ আচরণের মধ্য দিয়ে ভালো ও সম্ভাবনাময় নেতৃত্বকে বিতাড়িত করেছিল। এই করুণ পরিস্থিতির কথা বঙ্গবন্ধুকন্যা ও দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবগত হয়েই একটা বিহিতের ব্যবস্থা অনেকদিন ধরেই অনুসন্ধান করছিলেন। বিগত কমিটির চেয়ারম্যান ওমর ফাুরক চৌধুরী এসব বিষয় অতিক্রম করে যুবলীগকে দাঁড় করাতে না পারায় সমগ্র নিন্দার দায় সংগঠনের কাঁধে পড়েছিল। সেটির উদ্ধার করা ছিল সবচেয়ে চ্যালেঞ্জ।
ছাত্রলীগের শোভন-রাব্বানীকেও বিদায় নিতে হয়েছিল অশোভন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে। এগুলো কিন্তু ব্যক্তিকে অতিক্রম করে দলকে আক্রান্ত করছিল। সামগ্রিকভাবে যুবলীগের ভবিষ্যৎ নিয়ে দল ও দলের বাইরেও নাগরিক সমাজ সকলেই চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। কারও কারও কাছে মনে হচ্ছিল কয়েক বছরের জন্য সংগঠনটির কাজ স্থগিত হয়ে যেতে পারে। এ রকম এক ক্রান্তিকালে শক্তহাতে দুষ্টের দমনে এগিয়ে এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বলা যায় তিনি ওভাররিক্স নিয়েছিলেন। ওভাররিক্স এ জন্য বলছি তিনি যাকে যুবলীগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছিলেন তাকে নিয়ে। তিনি একটি ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সন্তান হলেও রাজনীতিতে তার অংশগ্রহণ ছিল না। সাদামাটা নিরামিষ জীবনে অভ্যস্থ ছিলেন। শিক্ষকতা ও সংস্কৃতির অধিক্ষেত্রেই তার মূলত বিচরণ ছিল।
বলতে দ্বিধা নেই আমরা অনেকেই জানতামই না শেখ ফজলুল হক মনির জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ ফজলে শামস পরশ। দেশের মানুষজন এমনকি তৃণমূল পর্যায়ে দলেও কর্মীরাও তাকে জানতেন না। যতটুকু জানতেন তা ছিল ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপসকে। এ রকম একজন অনভিজ্ঞ ব্যক্তিকে যুবলীগের মতো বৃহৎ সংগঠনের দায়িত্ব দিয়ে প্রধানমন্ত্রী রিক্সই নিয়েছিলেন। আমরা তার সফলতা নিয়ে দোলাচালে ছিলাম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ ফজলে শামস পরশকে চিনতে ভুল করেননি। তিনি পরখ করতে পেরেছেন। অনেকের মতো আমারও ধারণা ছিল যুবলীগের মতো সংগঠনের জটিল সমীকরণকে তিনি মেলাবেন কেমন করে। পূর্ব সাংগঠনিক অভিজ্ঞতা থাকলেও তাও বুঝতাম পেরে উঠবেন। তিনি যখন দায়িত্ব পেয়েছেন তখন ইতিহাসের সবচেয়ে জটিল সময়কাল চলছিল যুবলীগের। সংগঠনটির অনেক বনেদি নেতা জেলে গেছেন তাদের বিতর্কিত কাজের জন্য। পুরোনো সেট-আপের অনেকেই নেই, কেউ পরিত্যক্ত কেউবা নিজে নিজে নির্বাসিত হয়েছেন।
পেরেছেন এবং সবচেয়ে বড় জটিল কাজটি করতে পেরেছেন শেখ পরশ। তিনি এই সময়কালে যেমন নিজে পরিচ্ছন্ন থেকেছেন, তেলবাজিতে ডোবেননি তেমনি সংগঠনটিকে বুঝে তার জন্য একটি উত্তম নেতৃত্ব সৃষ্টির অনন্য প্রয়াস সফল করেছেন। কিছুটা সময় তিনি নিয়েছেন। বিলম্বের জন্য সমালোচিতও হচ্ছিলেন। কিন্তু বলা যায় বিলম্ব হলেও সফল হয়েছেন। যুবলীগের বিশাল কমিটি। এই কমিটির জন্য সারাদেশ থেকে পরিচ্ছন্ন ইমেজের যুবকদের খুঁজে বের করা এবং তাদের নিয়ে একটি কমিটি উপহার দেয়া সত্যিই কঠিন কাজ ছিল। তিনি সেটি পেরেছেন। এক্ষেত্রে তার সাধারণ সম্পাদক নিখিল সাহেবের ভূমিকাও স্মরণযোগ্য হবে।
যুবলীগের কমিটিতে যে সকল যুবকের নাম দেখা যাচ্ছে তারা নানা পেশার মানুষ। প্রায় সকলেই সাংগঠনিক ও পেশাগত জীবনে বয়স বিবেচনায় অনন্য উচ্চতায় আছেন। সামাজিক নানা কাজে তাদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। রয়েছে সুনাম। এদের মধ্যে যে দু-চারজন কমজোরি নন তা বলব না। নিশ্চয়ই কিছু কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি থাকতে পারে। বিশ্বাস করি সেসব একসময় ঝরে পড়বে।
পরিচ্ছন্ন ইমেজের তারুণ্যনির্ভর ব্যক্তিরা কমিটিতে স্থান পাওয়ায় দলটির ইমেজের সংকট কাটিয়ে উঠতে কাজ করবে। পরিচ্ছন্ন যুবকদের হাতে সুস্থ রাজনীতির যে শুভসূচনা হয়েছে তা সমাজ ও রাষ্ট্রিয় জীবনে সুদূরপ্রসারী অবদান রাখবে। এ-ও প্রত্যাশা করি এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে। আর সেটি থাকলে মন্দ ও দুর্বৃত্তরা এখান থেকে দ্রুতই বিদায় নেবে। সেখানে ভালো মানুষ স্থান পাবেন। আশা করব যুবলীগের এই কমিটি তৃণমূলে একটি প্রশিক্ষিত কর্মীবাহিনী সৃজনে অবদান রাখবে। যেখানে রাজনৈতিক ও ইতিহাস জানবেন নেতৃত্ব। মনিটরিং রাখতে হবে ভালো কর্মী যেন হতাশ ও মন্দ না হয়ে পড়ে। মন্দ হওয়ার কারণগুলো অনুসন্ধান করে এর প্রতিষেধকের নিত্য ব্যবহার রাখতে হবে।
আমি বিশ্বাস করি যুবলীগ পারলে অন্যসব সহযোগী ও অঙ্গ সংগঠন এ রকম চমকপ্রদ নেতৃত্ব সৃজনে ভূমিকা রাখতে পারবেন। এটি অন্য সকলের জন্য অনুসরণীয় হতে পারে। মনে রাখতে হবে টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এই সময়কালে নজরকাড়া উন্নয়ন হয়েছে। বাংলাদেশের উন্নয়ন যে মাত্রায় হয়েছে তার উপলব্ধি আন্তর্জাতিক দুনিয়ার কাছে প্রস্ফূটিত হলেও দেশের মানুষের কাছে সেগুলোর প্রচার ততটা কম। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মতে প্রায় সকল প্যারামিটারে বাংলাদেশ এগিয়েছে। কিন্তু সেটি জানে না আমজনতা। আমজনতার সামনে দলের একজন মন্দ কর্মীর আচার-আচরণ ও কর্মকে বড় করে তুলছে বৈরী শক্তি। তারা কর্মীর দুর্বলতাকে ক্যাপিটালাইজড করছে আর সাবসাইড করছে উন্নয়ন ও নজরকাড়া সাফল্যকে। সামনের স্থানীয় সরকার ও জাতীয় নির্বাচনে প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করে বিজয় অর্জন করার জন্য যুবলীগের তারুন্যভরা যোগ্য ও পরিচ্ছন্ন নেতৃত্ব সফল হবে বলে বিশ্বাস করি।
আগামী নির্বাচনের আগে প্রতিপক্ষরা যুবলী-ছাত্রলীগ এই সংগঠনগুলোর নেতৃত্বের দুর্বলতাগুলোকে আরও ক্যাপিটালাইড করে আওয়ামী লীগকে বিপদগ্রস্ত করার চেষ্টা নেবে। মনে রাখতে হবে দেশে আওয়ামী লীগের পরে যারা ক্ষমতার স্বপ্ন বুনছেন তারা অন্ধকারের শক্তি। আওয়ামী লীগ না থাকলে বামপন্থীদের ক্ষমতায় যাওয়ার মতো শক্তি বা জনসমর্থন নেই দৃষ্টিগোচর করার মতো নয়। অন্যরা যদি ক্ষমতায় আসে তারা বিএনপি বা অন্য কোনো নামে এলেও ভেতরে থাকবে জামায়াত ও মৌলবাদ। যা হবে মুক্তিযুদ্ধের বৈরী শক্তির উত্থানের উৎস। এই শক্তি আওয়ামী লীগকে তছনছ করার চেষ্টা নেবে। তাদের প্রধান টার্গেট হবে আওয়ামী লীগের ছাত্র ও যুবশক্তি। হয়তো সফল হবে না, তবে যে ক্ষতিটি হবে তা হচ্ছে দেশের এবং দেশের দর্শনের। যে দর্শন রোপিত হয়েছিল ত্রিশ লাখের রক্তবীজে। বিশ্বাস করি পরশদের পরশের কারণে জাতি তার মূল লক্ষ্য থেকে চ্যুত হবে না।
লেখক : সাবেক রাকসু নেতা, আইনজীবী, লেখক ও গবেষক।