বিশেষ প্রতিবেদন,কলকাতা:মুকুল রায় কি তৃণমূলে ফিরছেন? দিল্লিতে আয়োজিত বিজেপির সাত দিনের দীর্ঘ বৈঠকের প্রথম পর্বেই মুকুল রায় কলকাতায় ফিরে আসা নিয়ে এমনই প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল রাজনৈতিক মহলে। জল্পনাও শুরু হয়ে গিয়েছিল। যদিও মুকুল রায় স্পষ্টই জানান, তিনি চোখের চিকিৎসার জন্য কলকাতায় ফিরেছেন। কিন্তু তাঁর বক্তব্য অনেকেরই বিশ্বাস হয়নি। কিন্তু সব জল্পনা উড়িয়ে দিয়ে মুকুল রায় জানিয়েছেন, তিনি বিজেপিতেই আছেন। পরিষ্কার বলেছেন, ‘আমার সম্পর্কে অনেকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে নানা রকম বানানো গল্প রটিয়ে বেড়াচ্ছেন। আমি বিজেপি ছাড়ব বলে তাঁরা গুজব ছড়াচ্ছেন। আমি বিজেপিতে ভালোই আছি।’
রাজ্য বিজেপিতে মুকুল রায় যে কোণঠাসা, তা মুকুল রায়ের অনুগামীদের একাংশ আড়ালে আবডালে বলে থাকেন। তাঁদের বক্তব্য, বিজেপিতে মুকুল রায়কে যোগ্য মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে না। বিষয়টি মুকুল রায়কে ধারাবাহিক ভাবেই হতাশ করে চলেছে। শোনা যায়, দিল্লিতে থাকার সময়ই বৈঠকে বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের সঙ্গে তাঁর মত–বিরোধ হয়। তখন তিনি বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নাড্ডার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে সময় দেওয়া হয়নি। তাই তিনি দিল্লিতে না থেকে কিছুটা অভিমান করেই কলকাতায় ফিরে আসেন। যদিও প্রকাশ্যে বিজেপি নেতাদের কেউই বিষয়টি নিয়ে মুখ খোলেননি।
মুকুল রায়ের কলকাতায় ফেরা নিয়ে দিলীপ ঘোষও চোখের চিকিৎসার কথা জানান। পাশাপাশি তিনি এ কথাও জানান, বৈঠক যে বেশ কয়েকদিন ধরে চলবে, তা সব নেতাকেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। রাজনৈতিক মহলের ধারণা, এর অর্থ, মুকুল রায়ও সে কথা জানতেন। তবু তিনি দিল্লি গিয়েছিলেন। অথচ মাঝপথে চিকিৎসার কারণ দেখিয়ে ফিরে এসেছেন। দিলীপবাবুর কথার মধ্যেই যে অন্য ইঙ্গিত লুকিয়ে রয়েছে, তা বুঝতে কারও অসুবিধে হয়নি। কিন্তু দিলীপ ঘোষের আরও একটি মন্তব্য নিয়েও চর্চা শুরু হয় রাজ্য রাজনীতিতে। দিলীপবাবু কারও নাম না করেই বলেছেন, বিজেপিতে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেই গুরুত্ব পেতে হয়। চাইলেই গুরুত্ব মেলে না। কথার ইঙ্গিতটি কার দিকে ছিল, তা অনুমানের বাইরে নয়।
শনিবার মুকুল রায় ‘বিজেপিতেই আছি’ বলে জানালেও দিলীপবাবুর নাম না করে রীতিমতো আক্রমণাত্মক সুরে বলেছেন, ‘রাজনীতিতে কারও যোগ্যতা কোনও ব্যক্তি নির্ধারণ করেন না। যোগ্যতা বিচার করে সাধারণ মানুষ।’ মুকুল রায়ের এই বক্তব্য দিলীপবাবুরও কানে গিয়েছে। তবে বিষয়টি নিয়ে তিনি কোনও প্রতিক্রিয়া দেননি। এদিকে, বিশ্বস্ত সূত্রের খবর, দিল্লি থেকে কলকাতা ফেরার পর মুকুল রায়ের সঙ্গে গোপনে বৈঠক করেছেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক সুব্রত বকসি। কিন্তু বৈঠকটি যেহেতু গোপনে হয়েছে, তাই কী আলোচনা সেখানে হয়েছে, তা প্রকাশ্যে আসেনি। স্বাভাবিক কারণে দুই নেতাই বৈঠক নিয়ে নীরবতা পালন করে চলেছেন।
কিন্তু এই বৈঠকের খবর পৌঁছে গিয়েছে দিল্লিতে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কানে। তার পরই তৎপর হয়ে ওঠেন কেন্দ্রীয় নেতারা। বলা বাহুল্য, ঘটনায় কিছুটা চাপে পড়ে গিয়েছেন দিলীপ ঘোষ স্বয়ং। তাই বিষয়টি নিয়ে তিনি কোনও রকম মন্তব্য করে আর জটিলতা বাড়াতে চাননি। এর মধ্যে বাংলার এক বিজেপি সাংসদ দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের বিষয়টি জানিয়ে পরিষ্কার বলেছেন, শেষ লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যে বিজেপির ভালো ফলের পিছনে মুকুল রায়ের অবদান ভুললে চলবে না। তিনি সক্রিয় থাকার সুফল কিন্তু বিজেপির ঘরেই এসেছে। তাই রাজ্য বিজেপিতে মুকুল রায়কে এ ভাবে অচ্ছুত করে রাখার চেষ্টা অব্যাহত থাকলে তার ফল খুব একটা ইতিবাচক নাও হতে পারে।
ঘটনাটি পৌঁছে গিয়েছে বিজেপির প্রাক্তন সর্বভারতীয় সভাপতি তথা বর্তমানে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর কানেও। শুধু তাই নয়, রাজ্যসভার এক বাঙালি সাংসদও মুকুল রায়ের পক্ষেই কথা বলেন অমিত শাহের সঙ্গে। এর পরই বাংলায় বিজেপির পর্যবেক্ষক কৈলাশ বিজয়বর্গীয় সরাসরি ফোন করেন মুকুল রায়কে। মুকুল রায়কে ফের আগামী সপ্তাহেই দিল্লিতে আসার জন্য তিনি বলেন। শোনা যাচ্ছে, সামনের সপ্তাহের প্রথম দিকেই দিল্লি যাচ্ছেন মুকুল রায়। সূত্রের খবর, অমিত শাহ সরাসরি মুকুল রায়ের সঙ্গে কথা বলবেন। কথা বলবেন দিলীপ ঘোষের সঙ্গেও। তার পর মুকুল রায় ও দিলীপ ঘোষকে নিয়ে একসঙ্গে আলোচনা করবেন তিনি। এখন দেখার অমিত শাহের এই উদ্যোগ সফল হয় কিনা!
এদিকে, বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গিয়েছে, রাজ্য বিজেপিতে দিলীপ ঘোষের আচরণ নিয়ে রাজ্য নেতাদের অনেকের অসংন্তোষ রয়েছে এবং সে কথা কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছেও পৌঁছেছে। রাজ্য বিজেপির একাংশ গোপনে জানিয়েছেন, অন্য দলের বড় নেতারা বিজেপিতে এলে দিলীপ ঘোষ নাকি নিরাপত্তার অভাব বোধ করেন। তাই তাঁদের প্রতি তিনি শীতল আচরণই করে থাকেন। মূলত তাঁর আপত্তিকর মন্তব্যের পরই বিজেপির সঙ্গে তৃণমূল ত্যাগ করে আসা তথা কলকাতার প্রাক্তন মেয়র ও মন্ত্রী শোভন চট্টোপাধ্যায় এবং তাঁর বান্ধবী বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের দূরত্ব বেড়েছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, দিলীপ ঘোষ কি ইচ্ছে করেই সেই আপত্তিকর মন্তব্য করেছিলেন? মুকুল রায়কেও যে তিনি সহজ ভাবে নিতে পারেননি, সে কথাও ক্রমশ সকলের কাছেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।
দিল্লির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কানেও এইসব অভিযোগ পৌঁছে গিয়েছে। শোনা যাচ্ছে, তাঁরা এখন বিষয়টি নিয়ে সিরিয়াস ভাবনাচিন্তা শুরু করেছেন। বিশেষ করে অমিত শাহ চাইছেন না মুকুল রায়, শোভন চট্টোপাধ্যায় এবং বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপি ছেড়ে চলে যান। তাই দিলীপ ঘোষকে তিনি কী বার্তা দেন, তা নিয়েও এখন চর্চা চলছে বিজেপির অন্দর মহলে। অবশ্য প্রকাশ্যে রাজ্য বিজেপির কোনও নেতাই বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলতে রাজি নন।