আল্লামা শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর পর হেফাজতে দেখা দেয়া সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। আল্লামা শফীকে হত্যা করা হয়েছে অভিযোগ এনে আদালতে মামলার পর তার শ্যালক মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন অভিযোগ করেন, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের নবনির্বাচিত কমিটির যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হকের পরিকল্পনা এবং আরেক যুগ্ম-মহাসচিব নাসির উদ্দিন মুনিরের নেতৃত্বে আল্লামা আহমদ শফীকে ‘হত্যা’ করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১৭ ডিসেম্বর) সকালে চট্টগ্রাম জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শিপলু কুমার দে’র আদালতে মামলা দায়েরের আদালতে মামলা দায়েরের পর মাইনুদ্দিন ও তার আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আবু হানিফ কথা বলেন।
মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে মাওলানা নাসির উদ্দিন মুনিরকে, পরিকল্পনাকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে মাওলানা মামুনুল হকের নাম। বাকি আসামিদের মধ্যে রয়েছেন- হেফাজতের সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মীর ইদ্রিস, প্রচার সম্পাদক জাকারিয়া নোমান ফয়েজী, সহকারী অর্থ সম্পাদক মাওলানা মুহাম্মদ আহসান উল্লাহ ও সহকারী মহাসচিব হাবিব উল্লাহ।
মাইনুদ্দিন বলেন, ‘আল্লামা আহমদ শফী একজন বিশ্ববরেণ্য আলেম। ওনাকে পূর্বপরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। গত ১১ সেপ্টেম্বর মামুনুল হক ঢাকা থেকে ফটিকছড়িতে এসে (জুনায়েদ) বাবুনগরীর বাসায় বসে ওয়ালিমার অনুষ্ঠানের নাম দিয়ে অন্য আসামিদের নিয়ে মিটিং করেন। পরে সেখান থেকে ঘোষণা দেয়া হয় হুজুরের ছেলে আনাস মাদানীকে বহিষ্কার করা না হলে হুজুরকে চরম মূল্য দিতে হবে। তারই অংশ হিসেবে ১৬ তারিখ হাটহাজারী মাদরাসায় আন্দোলন শুরু হয়।
প্রশ্ন রেখে মাইনুদ্দিন বলেন, ‘মামুনুল হক তাহলে চরম মূল্য বলতে কী বুঝিয়েছিলেন সেদিন, হুজুরের মৃত্যু? এটা বলতে আমরা বুঝেছি তাকে হত্যার পরিকল্পনা।’
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘পরিকল্পনার অংশ হিসেবে হুজুরকে অক্সিজেন খুলে নিয়ে, রাইস টিউব খুলে নিয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছে। যখন মেডিকেলে নিয়ে আসার জন্য চেষ্টা করা হচ্ছিল, তখন তাকে প্রায় দেড় ঘণ্টা মাদরাসার দরজায় আটকে রাখা হয়েছিল। এ সময় মাওলানা নাছির উদ্দিন মুনিরের নেতৃত্বে হামলা চালিয়ে হুজুরের অক্সিজেন খুলে নেয়া হয়। এসব আমরা মামলার এজাহারে উল্লেখ করেছি।’
‘যে মাদরাসায় ছাত্ররা ফ্রি খায়, ফ্রি থাকে সেখানে আন্দোলন হতে পারে না’ দাবি করে তিনি বলেন, ‘যেখানে ৮ হাজার ছাত্র ফ্রি খায় সেখানে আবার কিসের আন্দোলন? হাটহাজারী মাদরাসায় কোনো আন্দোলন ছিল না। ৫১ বছর বয়সে কওমি মাদরাসায় আমি সর্বপ্রথম আন্দোলন দেখলাম হাটহাজারীতে।’
আল্লামা শফীকে হত্যার পেছনে ‘উগ্রবাদী’ শক্তির হাত আছে দাবি করে মাইনুদ্দিন বলেন, ‘উগ্রবাদীরা এখানে জড়িত, বর্তমান হেফাজতের যে কমিটি করা হয়েছে সেখানে এই উগ্রবাদীদের নামও আছে। ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের কায়দায় সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে আমার ভগ্নিপতিকে হত্যা করা হয়েছে। আমার ছোট ভাগনে আনাস মাদানীকে বাবার জানাজায় পর্যন্ত আসতে দেয়নি।’
তিন মাসেও ঘটনা তদন্তে হেফাজত নেতাদের আশ্বাস পাননি জানিয়ে মাইনুদ্দিন আরও বলেন, ‘আমি গত তিন মাস পর্যন্ত হেফাজতের বড় বড় নেতার কাছে গিয়ে এর প্রতিকার চেয়েছি। কিন্তু তারা কোনো আশ্বাস না দেয়ায় শেষ পর্যন্ত আমি আদালতের কাছে বিচারের প্রার্থনা করেছি। মাননীয় আদালত আমার বক্তব্য শুনে পিবিআইকে (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছেন।’
বাদীর আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আবু হানিফ বলেন, ‘পূর্বপরিকল্পনার অংশ হিসেবে আল্লামা শাহ আহমদ শফীকে হত্যা করা হয়েছে। যে মানুষটি অক্সিজেন ছাড়া চলতেই পারেন না, সেটা আবার হাই ফ্লো অক্সিজেন। সেখানে তাকে প্রায় দেড় ঘণ্টা অক্সিজেন ছাড়া আটকে রাখা হয়েছে। এ কারণে তাকে যখন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তখন তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। পরে বাদী নিজস্ব ব্যবস্থায় হুজুরকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকার আজগর আলী হাসপাতালে নিয়ে গেলেও চিকিৎসকরা জানান, হুজুর ততক্ষণে কোমায় চলে গেছেন। পরে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।’
আন্দোলনের নামে হাটহাজারী মাদরাসায় লুটতরাজ হয়েছে অভিযোগ করে এ আইনজীবী বলেন, ‘ওইদিন শুধু হুজুরের ওপরই হামলা চালানো হয়নি, বরং তার কক্ষে ভাঙচুরের পাশাপাশি ৬০ লাখ ৮০ হাজার নগদ টাকা ও ২০ ভরি স্বর্ণ লুট করেছে।’
এদিকে এ মামলার বিষয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় হেফাজতে ইসলামের প্রচার সম্পাদক জাকারিয়া নোমান ফয়েজী জাগো নিউজকে বলেন, ‘যারা গাফেলদের সঙ্গে মিলে পথভ্রষ্ট হয়েছেন তারা এখন ভাত-কাপড় পাচ্ছেন না। তারাই বাতিলদের সঙ্গে মিলে এ মামলা করেছেন। আমরা সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাব।’
প্রসঙ্গত, কয়েক দশক ধরে চট্টগ্রামের হাটহাজারীর আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদরাসার মুহতামিম বা মহাপরিচালকের পদে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন শাহ আহমদ শফী। এ প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে তিনি বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা বোর্ড বা বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশেরও (বেফাক) সভাপতির দায়িত্বও সামলাচ্ছিলেন। হেফাজতে ইসলাম নামে যে সংগঠন গড়ে ওঠে, শুরু থেকে সেটির আমিরের দায়িত্বও তিনি পালন করছিলেন কওমি মাদরাসার নেতৃত্বের ওপর ভর করেই।
আহমদ শফীর উত্তরসূরি হওয়ার দ্বন্দ্ব চলছিল মাদরাসার নায়েবে মুহতামিম বা সহকারী পরিচালক জুনাইদ বাবুনগরী ও শফীর ছেলে আনাস মাদানীর মধ্যে। এর জেরে গত ১৭ জুন সহকারী পরিচালকের পদ হারান বাবুনগরী। কিছুদিন পর মাদরাসার কার্যক্রম শুরু হলে ১৫ সেপ্টেম্বর আকস্মিকভাবে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী বিক্ষোভ শুরু করে মাদরাসার মধ্যেই। এ সময় প্রধান ফটক আটকে মাদরাসার মধ্যে ব্যাপক ভাঙচুর চালায় বিক্ষোভকারীরা।
এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৭ সেপ্টেম্বর মাদরাসার শুরা কমিটি বৈঠকে আনাস মাদানীকে মাদরাসার সহকারী পরিচালকসহ সব পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। মুহতামিম আহমদ শফী নিজে ‘পদত্যাগ’ করেন। ওই দিনই গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় শফীকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়। পরদিন ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায় মারা যান আহমদ শফী ঢাকায় মারা যান আহমদ শফী।
তার মৃত্যুর পর গত ১৫ নভেম্বর হেফাজতের সম্মেলন হয়। শফীপন্থীদের অংশগ্রহণ ছাড়া অনুষ্ঠিত ওই সম্মেলনে হেফাজতের । মহাসচিব নির্বাচিত হন আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী। এই কমিটিরই যুগ্ম-মহাসচিব হয়েছেন মামুনুল হক ও নাসির উদ্দিন মুনির। সম্প্রতি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন নূর হোসাইন কাসেমী।