নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশে গত দুমাস ধরে অলিখিত লকডাউন ছিলো। বন্ধ ছিলো অফিস আদালত আর সেই সাথে বিভিন্ন গণপরিবহনও। তবে ধীরে ধীরে লকডাউন পরিস্থিতি শিথিল হলে রাস্তায় নামতে শুরু করে রাইড শেয়ারিং সার্ভিসে চলা যানবাহন। অ্যাপসে চলাচল বন্ধ থাকায় এসব যানবাহন ঝুঁকি নিয়েই চুক্তিভিত্তিতে চলতে শুরু করে। এতে চালক ও যাত্রীদের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সবার পরিবারের সদস্যদের বড় ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যার আশঙ্কা রয়েছে। স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, বর্তমানে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের সঙ্কট পুরোপুরি কাটতে আরও অনেক সময় লাগবে। রাইড শেয়ারিংয়ে যেহেকু একটি গাড়ি অনেকে ব্যবহার করেন, তাই অনেক ঝুঁকি থেকে যায়। এ ছাড়া করোনাভাইরাস ছোঁয়াচে হওয়ায় গা ঘেঁষাঘেঁষি করে চালক ও যাত্রী বসা, একই হেলমেট অনেকে পরাসহ বিভিন্ন কারণে বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে।
এদিকে গত শনিবার থেকে গণপরিবহন চলাচলের অনুমতি দেওয়া হলেও রাইড শেয়ারিং সার্ভিস চলাচলের অনুমতি দেয়নি সরকার। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত রাইড শেয়ারিং সার্ভিস বন্ধ রাখতে বিআরটিএ থেকে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে গত ২৬ মার্চ থেকে গণপরিবহনের পাশাপাশি রাইড শেয়ারিং সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শর্তসাপেক্ষে রোববার থেকে গণপরিবহন চালুর অনুমতি দিলেও অ্যাপসভিত্তিক যানবাহন চলাচলের অনুমতি দেয়নি সরকার। তবে লকডাউন পরিস্থিতি শিথিল হওয়ার পর গত বেশ কয়েকদিন ধরে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে মোড়ে মোড়ে মোটরসাইকেলসহ রাইড শেয়ারিং সার্ভিসের যানবাহন চলতে দেখা গেছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ চালক আগে উবার, পাঠাও, ও-ভাই এবং সহজে রাইড শেয়ারিং করতেন। করোনা শুরুর পর অ্যাপসভিত্তিক চলাচল বন্ধ হলে বেশকিছু দিন তারা কর্মহীন অবস্থায় গৃহবন্দি থাকেন। পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতি কিছুটা শিথিল হলে অ্যাপসের পরিবর্তে চুক্তিভিত্তিক চালাতে শুরু করেন।
গত কয়েকদিন যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, গুলিস্তান, শাহবাগ, পল্টন, বাংলামোটর, ফার্মগেট, মহাখালী, উত্তরা, গাবতলী, সদরঘাট ও মিরপুরসহ নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে রাইড শেয়ারিংয়ে চলা মোটরসাইকেল চালকদের দেখা গেছে। ফার্মগেট, উত্তরা, সদরঘাট ও গুলিস্তানসহ বেশ কিছু এলাকায় রাইড শেয়ারিংয়ে চলা প্রাইভেটকারও দেখা গেছে।
রোববার গুলিস্তান মোড়ে দেখা যায় অনেক চালক মোটরসাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তাদের সামনে দিয়ে কোনো পথচারী হেঁটে যাওয়ার সময় কোথায় যাবেন বলে জানতে চান এই চালকরা। এ সময় অনেক যাত্রীর সঙ্গে দরকষাকষি করতে দেখা গেছে।
করোনার আগে পাঠাও সার্ভিসে মোটরসাইকেল চালিয়েছেন এমন চালক রহিম মুন্সী জানান, রাইড শেয়ারিং সেবা বন্ধ থাকায় অনেকদিন রাস্তায় নামেননি। তবে অর্থ সঙ্কটের কারণে খুব কষ্টে জীবনযাপন করতে হয়েছে। তিনি আরও জানান, ঋণ নিয়ে মোটরসাইকেলটা কিনেছি। এখন তাদের টাকাও দিতে পারছি না আবার সংসারও চলছে না। বর্তমানে একপ্রকার বাধ্য হয়েই রাস্তায় নেমেছি। তবে তার মুখে নিম্নমানের মাস্ক ও হাতে গ্লাভস ছাড়া অন্য কোনো সংক্রমণ প্রতিরোধী উপকরণ ব্যবহার করতে দেখা যায়নি।
ফার্মগেটে নাজমুল নামের এক উবার চালক জানান, অ্যাপস বন্ধ থাকায় আমরা যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে চুক্তিতে বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছি। নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে অনেকদিন বাড়িতে কর্মহীন অবস্থায় গৃহবন্দি থাকলেও সরকারের তরফ থেকে কেউ কোনো সহযোগিতা করেনি। এতদিন পরিচিতদের কাছ থেকে ধারদেনা করে কোনো রকমে চলেছি। এখন বাধ্য হয়ে রাস্তায় নেমেছি। তবে মাস্ক ও হাতে হ্যান্ড গ্লাভস ব্যবহার করছি।
সদরঘাটে ইশরাক হোসেন নামের এক যাত্রী জানান, বাস না থাকায় বাধ্য হয়ে উবার-পাঠাওয়ের মোটরসাইকেলে যেতে হচ্ছে। তবে অ্যাপসের চেয়ে চালুকরা চুক্তিতে অনেক বেশি টাকা নিচ্ছে। অন্য কোনো উপায় না থাকায় বাধ্য হয়েই বেশি টাকা দিয়ে গন্তব্যে যেতে হচ্ছে। নগরীর বিভিন্ন জায়গায় দাঁড়িয়ে দেখা গেছে, দরকষাকষি ঠিক হলে কোনোরকম সংক্রমণ প্রতিরোধী উপকরণ ব্যবহার ছাড়াই মোটরসাইকেলে উঠে বসছেন যাত্রীরা।
মোটরসাইকেলের মতোই উবারের চালকদেরও গাড়ি নিয়ে চুক্তিভিক্তিক ট্রিপে বেরোতে দেখা গেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বিভিন্ন গ্রুপে পোস্ট দিয়ে স্বল্প বা দূরপাল্লার গাড়ি ভাড়া দেওয়া হবে বলে বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গত বছরের প্রকাশিত এক গবেষণা তথ্যে দেখা গেছে, বাংলাদেশে অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং সেবা ২ হাজার ২০০ কোটি টাকার বাজার তৈরি করেছে। বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ১২টি প্রতিষ্ঠান রাইড শেয়ারিংয়ের লাইসেন্স নিয়েছে। এ ছাড়া আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আবেদন করেছে। অঘোষিত লকডাউন শুরুর পর রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলোর যানবাহন সেবা এখন পুরোপুরি বন্ধ।
উবার ড্রাইভার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. সেলিম গণমাধ্যমকে জানান, রাইড শেয়ারিং সার্ভিস বন্ধ থাকায় চালকরা এখন খুব কষ্টে রয়েছেন। লকডাউন শিথিল হওয়ায় কেউ কেউ রাস্তায় নামতে শুরু করেছেন। তবে যাত্রী অনেক কম হওয়ায় উবার চালকরা অনেকেই চুক্তিভিক্তিক ভাড়া নিচ্ছেন। তিনি নিজেও গত শনিবার রাস্তায় নেমেছেন বলে জানান।
বাংলাদেশি রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলোর মধ্যে ‘পাঠাও’ কোম্পানির তিন লাখ তালিকাভুক্ত চালক রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক হুসেইন এম ইলিয়াস গণমাধ্যমকে জানান, আমাদের তালিকাভুক্ত চালকদের অর্ধেকের বেশি লকডাউন শুরুর আগেভাগেই নিজেদের বাড়িতে চলে গেছেন। তবে গত কয়েক সপ্তাহে অনেকে ফিরে এসেছেন। তাদের অনেকে অফলাইনে (অ্যাপ ব্যবহার না করে) ট্রিপ দিচ্ছেন বলেও শোনা যাচ্ছে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা ওঠার আগ পর্যন্ত এক্ষেত্রে তো আসলে আমাদের কিছু করার নেই। তবে যারা খুব বেশি সঙ্কটে পড়েছেন সরকারের সঙ্গে মিলে তাদের সহায়তা করার জন্য তারা চেষ্টা করছেন। বিধিনিষেধ তুলে দেওয়া হলেই আমরা আবার চালু করতে পারব।
আরেকটি প্রতিষ্ঠান সহজের প্রধান নির্বাহী মালিহা কাদির জানান, নিষেধাজ্ঞার কারণে আমাদের সার্ভিস দেওয়ার সুযোগও নেই। তবে চালু হলে স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা মেনেই আমাদের সেবা চালু হবে। যেমন চালক ও যাত্রীর মাঝখানে ব্যাগপ্যাগ ব্যবহার করা, মাস্ক পরা, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা নিশ্চিত করা হবে। এ ছাড়া আচরণগত কিছু সতর্কতা , হাঁচি-কাশির নিয়ম মানা ইত্যাদির জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তবে উবারের সঙ্গে চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।