২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল। নারায়ণগঞ্জ থেকে একে একে আসে সাতজনের অপহরণের খবর। এর তিনদিন পর শীতলক্ষ্যা নদীতে ভেসে ওঠে সেই সাতজনের মরদেহ। সারা দেশে সৃষ্টি হয় তোলপাড়। বয়ে যায় নিন্দা ও সমালোচনার ঝড়। জঘন্য ওই হত্যাকাণ্ডে সন্দেহের আঙুল যায় র্যাবের দিকে। একে একে গ্রেপ্তার হন সংস্থাটির অভিযুক্ত কর্মকর্তারা। বিচার কার্যক্রম শেষে ঘোষণা করা হয় রায়ও। তবে আড়ালে রয়ে যায় অনেক কিছু।
মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, সাতজন অপহৃত হওয়ার পর যখন র্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে তখন ঘটনার ছায়া তদন্ত শুরু করে র্যাব সদরদপ্তর। ওই সময় র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান ঘটনায় অভিযুক্ত র্যাব-১১’র অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদকে র্যাব সদরদপ্তরে ডেকে আনেন। তার কাছ থেকে অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডের গল্প শোনেন। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে তাকে ছেড়ে দেন। হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি তদন্ত কর্মকর্তাদের না জানিয়ে গোপন রাখেন।
সূত্র জানায়, সেসময় পুলিশকেও কোনো সহযোগিতা করেননি জিয়াউল আহসান। তিনি তারেক সাইদ এবং আরও কয়েকজন মিলে ঠিক করেছিলেন অপহৃত ব্যক্তিরা ‘নিখোঁজ’ বা ‘স্বেচ্ছায় আত্মগোপনে’ চলে গেছেন বলে ঘোষণা করা হবে। মরদেহগুলো যদি শীতলক্ষ্যায় ভেসে না উঠত তাহলে এটিই করা হতো।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জে সাতজনকে অপহরণ করা হয় এবং ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদীতে তাদের মরদেহ ভেসে ওঠে। নিহতরা হলেন- নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, তার বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, সিরাজুল ইসলাম লিটন, তাজুল ইসলাম, গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম, আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহিম।
অপহরণের পর থেকে মরদেহ উদ্ধারের আগ পর্যন্ত র্যাব সদরদপ্তরে যা হয়েছিল
জানা গেছে, সাত খুনের মামলা নিয়ে অনুসন্ধানের সময় র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক জিয়াউল আহসান অভিযুক্তদের র্যাব সদরদপ্তরে ডেকে পাঠান। তার কক্ষে প্রথমে ডাকা হয় র্যাব-১১’র সাবেক কোম্পানি কমান্ডার মেজর (অব.) আরিফ হোসেনকে। জিয়াউল আহসান যেখানে বসতেন তার পেছনে রাখা ছিল একটি গোপন ক্যামেরা। সেই ক্যামেরায় আরিফকে জিজ্ঞাসাবাদের ফুটেজ রেকর্ড করে রেখেছিলেন তিনি।
ওই গোপন ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, জিজ্ঞাসাবাদে আরিফ জানান, তারা প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামকে অপহরণ ও হত্যা করেন। হত্যার নির্দেশনা দিয়েছিলেন র্যাব-১১’র অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ।
আরিফের জবানবন্দির পরপর জিয়াউল আহসানের কক্ষে ডাকা হয় তারেক সাঈদকে। জিয়াউলের ডেস্কের সামনে পাশাপাশি বসেন আরিফ ও তারেক। তখন তারেককে একই প্রশ্ন করেন জিয়াউল আহসান।
জবাবে তারেক সাঈদ হত্যাকাণ্ডের কথা অকপটে স্বীকার করেন। তারেক জানান, তাদের (সাতজন) অপহরণ করা হয়েছে। সাতজনকে অপহরণের কারণ হিসেবে তিনি বলেন, কেবল নজরুলকে অপহরণের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু বাকিরা দেখে ফেলায় তাদেরও অপহরণ করা হয়।
তারা এখন কোথায়? জিয়াউল আহসানের এমন প্রশ্নের উত্তরে তারেক বলেন, তাদের হত্যা করে শীতলক্ষ্যায় ফেলে দেওয়া হয়েছে।
তখন জিয়াউল আহসান উদ্বিগ্ন হয়ে বলে ওঠেন, লাশ যদি ভেসে ওঠে? জবাবে তারেক সাইদ বলেন, উঠবে না স্যার।
আবারও জিয়া বলেন, যদি ওঠে? তারেক উত্তরে বলেন, উঠবে না স্যার। পেট ফুটো করে দিয়েছি। ইটের বস্তার সঙ্গে বেঁধে ফেলা হয়েছে।
তখন জিয়াউল আহসান বলেন, তারেক, লাশ ভেসে উঠলে কিন্তু একদম ফাঁসি।
এই কথোপকথনে পরিষ্কার, লাশ ভেসে ওঠার আগেই সাত খুনের বিষয়টি জানতেন জিয়াউল আহসান।
দায়িত্বশীল একটি সূত্রে জানা যায়, জিয়াউল আহসান র্যাব কর্তৃক হত্যার বিষয়টি জেনে সঙ্গে সঙ্গে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে ‘নিখোঁজ সাতজন খুন হয়েছেন’ বলে জানান। তখন প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দেখ কী হয়।’
খুনের কথা জেনেও জিয়াউল আহসানকে কোনো ধরনের নির্দেশনা বা কাউকে গ্রেপ্তার করতে বলেননি শেখ হাসিনা। এর পরদিন (৩০ এপ্রিল ২০১৪) শীতলক্ষ্যা নদীতে ভেসে ওঠে সাতজনের লাশ।
দেশজুড়ে যখন সাত খুনের ঘটনায় তোলপাড় চলছিল তখন একটি গণমাধ্যম ‘সাত খুনের বিষয়ে আগেই জানত র্যাব সদরদপ্তর’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ করে। তবে, সেই সংবাদের পর বিষয়টি অস্বীকার করে একটি বিবৃতি দিয়েছিল র্যাব সদরদপ্তর। সূত্র জানায়, র্যাবের পক্ষে বিবৃতিটি লিখে দিয়েছিলেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজাম। এ ছাড়া ঘটনা সম্পর্কে দেশের বেশ কয়েকটি মিডিয়ার কর্তাদের ডেকে আনঅফিসিয়ালি ব্রিফও করেন জিয়াউল আহসান।
সূত্র জানায়, জিয়াউল আহসান সবকিছু জানতেন, সেই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সব জানতেন। যেহেতু প্রধানমন্ত্রী কোনো নির্দেশনা দেননি, তাই এ বিষয়ে আর কেউ মুখ খোলেননি।
গণমাধ্যম ও তদন্ত কমিটিকে মিথ্যা বলেন জিয়াউল আহসান
সাত খুনের ঘটনার তিন মাস পর হাইকোর্টের নির্দেশে কর্নেল জিয়াউল আহসানকে চার ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি। সেই জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বের হয়ে জিয়া সাংবাদিকদের বলেন, ‘তারা (তদন্ত কমিটি) যেসব বিষয় জানার প্রয়োজন মনে করেছে, সেগুলো জানিয়েছি।’
একই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে প্রথমবারের মতো ওই ঘটনা নিয়ে গণমাধ্যমে কথা বলেন জিয়াউল আহসান। তিনি বলেন, ‘সাতজনকে অপহরণের পর তারেক সাঈদকে ফোন করলে তিনি (তারেক) অস্বীকার করে বলেছিলেন অপহরণের ঘটনা তার জানা নেই। এ ছাড়া পুরোটা সময় তারেক সাঈদ আমাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।’
এদিকে, সাত খুন মামলার তদন্ত চলার সময় নারায়ণগঞ্জের সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের সঙ্গে সাত খুনের প্রধান আসামি নূর হোসেনের একটি ফোনালাপ ফাঁস হয়। ১০৪ সেকেন্ডের ওই ফোনালাপটি ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রভাবিত করতে জিয়াউল আহসান সেই ফোনালাপ ফাঁস করেন বলে তখন অভিযোগ ওঠে।
র্যাবের সাবেক কর্মকর্তা সেই জিয়াউল আহসান বর্তমানে ডিবি পুলিশের রিমান্ডে রয়েছেন। গত ১৫ আগস্ট, বৃহস্পতিবার রাতে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। কোটা আন্দোলনের সময় নিউমার্কেট এলাকায় হকার শাহজাহান হত্যার ঘটনায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে তার বিরুদ্ধে আরও হত্যা মামলা হতে পারে।
২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত দেশে যে কয়টি নিখোঁজ ও গুম-খুনের ঘটনা ঘটেছে তার অধিকাংশের সঙ্গে জিয়াউল আহসানের জড়িত থাকার গুঞ্জন রয়েছে।
কী ঘটেছিল সেদিন
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের লামাপাড়া এলাকায় র্যাবের সদস্যরা চেকপোস্ট বসিয়ে কাউন্সিলর নজরুলের গাড়ি থামান। র্যাব গাড়ি থেকে নজরুল, তার তিন সহযোগী ও গাড়িচালককে তুলে নিয়ে যায়। এ সময় ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন আইনজীবী চন্দন সরকার। অপহরণের বিষয়টি দেখে ফেলায় তাকে এবং তার গাড়িচালককেও র্যাব তুলে নিয়ে যায়। ওই রাতেই সবাইকে হত্যা করা হয়। এরপর পেট কেটে এবং ইটের বস্তা বেঁধে সবার মরদেহ শীতলক্ষ্যা নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। ৩০ এপ্রিল ছয়জন এবং পরদিন একজনের মরদেহ ভেসে ওঠে।
এর এক সপ্তাহের মধ্যে ওই ঘটনায় র্যাব-১১ এর অধিনায়ক তারেক সাঈদসহ তিন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতার তথ্য প্রকাশ পায়। টাকার বিনিময়ে হত্যার অভিযোগ ওঠে। একসঙ্গে সাতজনকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা ও গুমের নৃশংসতায় শিউরে ওঠে মানুষ।
ওই ঘটনায় নারায়ণগঞ্জের আইনজীবীরা আন্দোলনে নামেন। সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ করেন কাউন্সিলর নজরুলের অনুসারীরা। গণমাধ্যম ও সারাদেশে বিষয়টি হয়ে ওঠে আলোচনার প্রধান বিষয়বস্তু।