৮ মে রোববার একদিনে ইটালির কোনো দ্বীপে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক অভিবাসী এসেছেন৷ সেদিন মোট এক হাজার ৪০০জন ইটালির লাম্পেদুসা দ্বীপে অবতরণ করেন, যার মধ্যে বেশিরভাগই তিউনিশিয়া, আইভরি কোস্ট ও বাংলাদেশের নাগরিক৷
স্থানীয় সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে যে অভিবাসীদের নিয়ে আসা নৌকার ঢল চলতে থাকে সোমবার পর্যন্ত৷ সিসিলিয়ান সংবাদপত্র জিওর্নালে দি সিসিলিয়া জানায় যে ২৪ ঘণ্টায় মোট ২০টি নৌকা শনাক্ত করা গেছে ও মোট দুই হাজার ১২৮জনকে নিকটবর্তী রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের নিবন্ধনকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছে৷
শনিবার সারা রাত ধরে অভিবাসীদের নিয়ে একের পর এক নৌকা আসতে থাকে লাম্পেদুসায়৷ রোববার সকাল পর্যন্ত আসতে থাকে এমন বহু নৌকা, যার মধ্যে ছিল মাছ ধরার কাঠের নৌকাও৷ রোববার বিকাল পর্যন্ত এমন মোট নয়টি নৌকা এসে পৌঁছানোর কথা জানা গেছে৷ ইটালির তট থেকে কিছুটা দূরে এই নৌকাগুলি দেখা গেলে ইটালির সীমান্তরক্ষী ও কাস্টমস পুলিশের নৌকা তাদের পাহারা দিয়ে নিয়ে আসে বলে ইটালির সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে৷ সোমবার সকালে আরো চারটি নৌকায় এসে পৌঁছান আরো ৬৩৫জন৷
জিওর্নালে দি সিসিলিয়া জানাচ্ছে, আগত অভিবাসীদের অধিকাংশই পুরুষ, কিন্তু কিছু কিছু নারী, শিশু এমনকি নবজাতকও আছে৷ সংবাদ সংস্থা এপি ইটালির রেডিও সংস্থার বরাত দিয়ে জানিয়েছে যে, নিবন্ধনকেন্দ্র ভরে যাওয়ায় বহু অভিবাসীদের বাইরে তোষক পেতে রাত কাটাতে হয়েছে৷ কোভিড সংক্রমণ বিষয়ে নিশ্চিত হতে শয়ে শয়ে অভিবাসীদের কোয়ারেন্টিন করে একটি অব্যবহৃত ফেরিতে রাখা হয়৷
ডানপন্থিদের চাপে প্রধানমন্ত্রী
স্কাই টিজি২৪ টিভিকে লাম্পাদুসার মেয়র সালভাতোরে মারতেলো রোববার বলেন, ‘‘আমি বলেছি যে একদিন ভালো আবহাওয়া থাকলেই এই ধরনের নৌকাগুলিকে দেখা যায়৷’’ এএফপি জানিয়েছে যে মারতেলো ইতিমধ্যে অভিবাসনকে গুরুত্ব দেবার কথা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মারিও দ্রাঘিকে৷
এই ধরনের অভিবাসী আগমনের নিন্দা জানিয়েছেন অতি-ডানপন্থি দল লিগ পার্টির নেতা মাত্তেও সালভিনি৷ সালভিনি ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী থাকাকালীন দ্বীপে কিছু অভিবাসীকে প্রবেশ করতে না দেওয়া বিষয়ে একটি মামলায় অভিযুক্ত৷ মামলাটি সিসিলিতে বর্তমানে চলছে৷
ভূমধ্যসাগরে বিপদে পড়া অভিবাসীদের জন্য হটলাইন পরিষেবা অ্যালার্ম ফোন জানিয়েছে যে ২৭ ঘণ্টায় মোট ছয়টি বিপদগ্রস্ত নৌকার কাছ থেকে বার্তা পায় তারা৷ এর মধ্যে দুটি নৌকার এখনও কোনো খোঁজ নেই৷
স্বপ্নের খোঁজে বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে পাড়ি
জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থা আইওএম-এর পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৫ সালের শুরু থেকে ইটালিতে এসেছেন পাঁচ লাখেরও বেশি অভিবাসী৷ ইটালিয়ান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৭ মে পর্যন্ত, দশ হাজার ৭২৫জন জলপথে এসেছেন, যার মধ্যে এক হাজার ২১৬জন বাংলাদেশি রয়েছেন৷
মধ্য ভূমধ্যসাগরের যে পথ সিসিলি ও উত্তর আফ্রিকার মাঝে রয়েছে, তা বিশ্বের অন্যতম বিপজ্জনক অভিবসন পথের একটি৷ এই পথে ইউরোপে প্রবেশ করতে গিয়ে এখন পর্যন্ত ৫০৬জন অভিবাসীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে৷
ব্র্যাকের অভিবাসন বিশেষজ্ঞ শরিফুল হাসান ঢাকা থেকে ইনফোমাইগ্রেন্টসকে জানান, কিছু নির্দিষ্ট জেলার মানুষদের মধ্যে একটি ভুল ধারণা রয়েছে যে গ্রিস বা ইটালিতে পৌঁছানো তুলনামূলকভাবে সহজ ও সেখান থেকে সহজেই ইউরোপে কাজ করা যায়৷ হাসান বলেন, ‘‘তাদের বলা হয় যে, যে কোনো উপায়ে ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে একবার ইটালি পৌঁছাতে পারলেই চাকরি পাওয়া সহজ৷’’
‘‘বাংলাদেশ বা ইউরোপে থাকা দালালদের বিশ্বাস করে ফেলে তারা৷ আর দালালরাও তাদের বলে যে সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে৷ কোনো দারিদ্র্য থাকবে না, ধনী হওয়া সহজ৷’’ মধ্যপ্রাচ্যে থাকা বাংলাদেশিদের পরামর্শ দেয় এই দালালরা যে, কোনো মতে ইউরোপ যেতে পারলে তাদের জীবন আরো সুখের হবে, জানান হাসান৷
বেশিরভাগ বাংলাদেশিদের বাস্তবতা আসলে ভিন্ন৷ তাদের কাছ থেকে আরো বেশি টাকা আদায়ের জন্যে এদের মধ্যে অনেককেই শুধু এক পাচারকারী চক্রের হাত থেকে অন্য চক্রের হাতে বিক্রি করে দেওয়া হয়৷ এই দালালরা শুধু বাংলাদেশ বা লিবিয়াতেই অবস্থান করে এমনটা নয়, বরং তুরস্ক ও দুবাইতেও ছড়িয়ে রয়েছে তাদের চক্র৷
‘‘প্রতি বছর এই সময়ে, অর্থাৎ মে-জুন থেকে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস পর্যন্ত, দালালরা আরো বেশি মানুষকে ইউরোপে পাঠাতে চেষ্টা করে৷ যদি কিছু ফেসবুক গ্রুপগুলি দেখা যায়, তাহলে লক্ষ্য করা যাবে যে কিছু পাচারকারীরা সেখানে লিখছে যে তারা ১০০জনকে ইটালি পাঠিয়েছে, ফলে এখন আরেকটা দল আসতে পারে’’, জানান হাসান৷
তিনি বলেন, ‘‘এই সব দেশগুলি একসাথে মিলে সংযুক্ত পদক্ষেপ না নিলে এই পথে মৃত্যুর কোনো শেষ নেই৷’’
উদ্ধারকারী জাহাজের ওপর কড়াকড়ি
ইটালির কর্তৃপক্ষ বর্তমানে অভিবাসী উদ্ধারকারী নৌকার ওপর কড়াকড়ি চালাচ্ছে৷ এমন পরিস্থিতির মধ্যেই নতুন করে ইটালিতে আসছেন আরো অভিবাসী৷ বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন ও এনজিও পরিচালিত কিছু উদ্ধারকারী জাহাজ বর্তমানে মধ্য ভূমধ্যসাগরে সক্রিয়ভাবে বিপন্ন অভিবাসীদের বাঁচানোর কাজ করছে৷ গত সপ্তাহান্তে, সিসিলিতে সিওয়াচ-৪ নামের একটি উদ্ধারকারী জাহাজকে আটক করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে৷ এর আগে, পালেরমো শহরে ছয়মাস আটকে রাখা হয়েছিল সেই জাহাজটিকে৷
এই নির্দেশনা দেওয়া হয় কারণ একটি নিরাপত্তা পরিদর্শন দল জানায় যে জাহাজটিতে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি লাইফজ্যাকেট ছিল৷ পাশাপাশি, তারা এটাও বলে যে জাহাজটির নিষ্কাশন ব্যবস্থা পর্যাপ্ত ছিল না৷ কিন্তু অধিকারকর্মীদের মতে, এই নির্দেশনা ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত মতামত সবই ছিল জাহাজটিকে কোনোমতে আটকানোর অজুহাত৷
নিরাপত্তাজনিত কারণে আরেকটি জাহাজ, সিওয়াচ-৩, আটক ছিল সিসিলির আওগুস্তা বন্দরে৷
সুত্র :ইনফোমাইগ্রেন্টস