স্বপ্ন শূন্যতা এবং
(পর্ব ০২)
উপমন্যু রায়
দুই
কুশলের কথা শুনে মারাত্মক খেপে গেলেন যযাতিদা। তেড়ে মারতে এলেন। প্রায় চিৎকার করেই বললেন, ‘‘তোর লজ্জা করে না? পাবলিক ধোলাই খেয়ে আবার আমার কাছে সহানুভূতি চাইতে এসেছিস!’’
যযাতিদা কণ্ঠস্বর উঁচুমাত্রায় রেখেই কাল রাতে কুশলের মার খাওয়ার কাহিনি সংযুক্তা বউদিকে গড়গড় করে সব বলে দিলেন। বউদিকে সব কথা যযাতিদা যে এ ভাবে বলে দেবেন, তা কুশল ভাবতে পারেনি। লজ্জায় সে মাটিতে মিশে গেল।
কিন্তু, সব শুনে বউদি বললেন, ‘‘তা হলে ওকে বকছ কেন? ওর তো কোনও দোষ নেই!’’
যযাতিদা চেঁচিয়ে বললেন, ‘‘সেটাই তো ওর দোষ! কিছু না করেও মার খেয়ে চলে এলো! আরে বাবা, মারই যদি খাবি তো সেই মহিলার গায়ে হাত দিয়েই মার খেতিস!’’
আমতা আমতা করে কুশল বলল, ‘‘ওই মহিলার গায়ে আমি হাত দেব! কী বলছ যযাতিদা? সে সব কথা আমার মাথাতেই আসেনি। ওই মহিলা অন্যায় ভাবে আমাকে মেরেছে!’’
যযাতিদা দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, ‘‘না, ওই মহিলা ঠিকই করেছে। এ দেশে এটাই স্বাভাবিক। বরং, ভালো মানুষ হওয়াটাই এ দেশে এখন অপরাধ জানিস না?’’
যযাতিদার কথা শুনে মুখ টিপে হাসেলন বউদি। ‘‘তুমি না— কী!’’ বলেই অন্য ঘরে চলে গেলেন।
তার পর যযাতিদা হঠাৎই শান্ত হয়ে গেলেন। কুশলের কাছে এসে তার কাঁধে হাত রাখলেন। মুহূর্তেই অদ্ভুত একটা অনুভূতি হল তার। এর আগেও যযাতিদা যতবার তার কাঁধে হাত রেখেছেন, ততবারই তার মন অসম্ভব একটা প্রশান্তিতে ভরে গিয়েছে। এবারও তেমনই হল কুশলের। হয়তো তাই কোনও সমস্যা হলে সে বারবার ছুটে আসে যযাতিদার কাছে।
যযাতিদা হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘তুই এত ভালো মানুষ হলি কেন কুশল?’’
কুশল অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে তাঁর দিকে। কোনও কথা তার মুখে আসে না।
তিনি কিন্তু থামলেন না। বললেন, ‘‘ভালো মানুষ হয়ে কী পেলি বল তো? এই পঁয়তিরিশ বছর বয়সেও নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারলি না! আসলে কী জানিস—’’ থেমে গেলেন যযাতিদা। চুপ করে কুশল তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে।
তিনি বললেন, ‘‘আজকের দিনে ভালো মানুষ কারা হয় জানিস? ভালো মানুষ হয় বোকারা। এই সমাজ এবং সংসারও তা–ই মনে করে। হয় বোকা, না–হয় পাগল, তারাই দেখবি খুব ভালো বা সরল মানুষ হয়ে থাকে। তুই তো পাগল নস! অথচ ভালো মানুষ তুই। এর অর্থ, তুই বোকা! আর, এটাই তোর চরিত্রের একটা বড় ধরনের নেগেটিভ পয়েন্ট। এখন যত শয়তান ও বদমাশ হতে পারবি, ততই তুই সাফল্যের দিকে এগিয়ে যাবি। দেখবি, তখন সবাই তোকে বাহবা দেবে। এই সময়ের এটাই নিয়ম!’’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি।
কুশল কোনও কথা বলতে পারে না।
যযাতিদা ফের বললেন, ‘‘তোর বাবা ভালো ও সৎ মানুষ ছিলেন। তোর বাবাও জীবনে কিছু করতে পারেননি। তোর মা–ও ভালো মানুষ। তাই এখনও এই বয়সে তাঁকে কী ভাবে তোকে সামলে সংসারের ঘানি টানতে হচ্ছে, দেখতে পাচ্ছিস না? এই বয়সে তাঁর তো বিশ্রাম পাওয়ার কথা! একটু আরামে, হাসিখুশিতে থাকার কথা। তাই না?’’
কুশলের মাথানত হয়ে এলো নিজে থেকেই। মন খারাপ হয়ে গেল যযাতিদার কথা শুনে।
ফের পুরনো প্রসঙ্গে ফিরে এলেন যযাতিদা। বললেন, ‘‘মন খারাপ করিস না। ওটা একটা অ্যাকসিডেন্ট। যে বাসে ঘটনাটা ঘটেছে, সেই বাস তোকে ফেলে চলে যাওয়ার পর সব চুকে গেছে। ও–সব কথা বাসের ওই মহান যাত্রীরাও যেমন মনে রাখবে না, তুই–ও তেমনই ভুলে যা।’’
কুশল চুপ করে থাকে।
হঠাৎই প্রসঙ্গ পালটে ফেললেন যযাতিদা। বললেন, ‘‘তুই এখন তো বাচ্চা নয় কুশল! ওই বয়স তুই অনেকদিন আগেই পেরিয়ে এসেছিস। তা হলে তুই এখনও এমন রয়ে গেলি কেন?’’
কুশল অবাক হয় যযাতিদার কথা শুনে। বলে, ‘‘মানে?’’
যযাতিদা বললেন, ‘‘মানে এখনও তুই বুঝলি না সেক্স একটা স্বাভাবিক ব্যাপার!’’
—কী থেকে কী কথা! কুশল ঠিক বুঝতে পারে না। জিজ্ঞাসা করে, ‘‘ঠিক করে বলো তো, কী বলতে চাইছ তুমি?’’
তিনি হাসিমুখে বললেন, ‘‘যারা সেক্স ব্যাপারটাকে স্বাভাবিক ভাবে নেয়, শরীরের ধর্ম মেনে সেক্স করে, তারা দেখবি খুব দুর্ভাগ্যে না পড়লে ওই রকম পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে না। পড়লেও ঠিক কাটিয়ে বেরিয়ে আসে। মহিলারাও তাদের গায়ে চট করে হাত দেওয়ার সাহস পায় না।’’
কুশল ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে তাঁর দিকে।
যযাতিদা মুখে হাসির রেখা বজায় রেখেই বললেন, ‘‘আসলে ওইসব ছেলেদের চেহারায় একটা অন্য রকম ব্যক্তিত্ব ফুটে ওঠে। পুরুষত্ব বলতে পারিস! মহিলারাও তা বুঝতে পারে। তাই চট করে ওই ধরনের ছেলেদের গায়ে হাত দেওয়া তো দূরের কথা, তাদের সঙ্গে তর্ক করারও সাহস দেখায় না!’’
কী বলবে বুঝতে পারে না কুশল। চুপ করে থাকে।
যযাতিদা বললেন, ‘‘একটা কথা বলব?’’
কুশল প্রশ্নভরা চোখে তাকায় যযাতিদার দিকে।
মুখ টিপে একটু হেসে তিনি বললেন, ‘‘তুই এবার একটা বিয়ে কর।’’
— ‘‘বুঝতে পারলাম না।’’ অবাক হয় কুশল। এ–সব কী বলছেন? তিনি নিজেই তো বিয়ের সম্পর্কে বিশ্বাসী নন! তা হলে এ–ধরনের কথা তিনি বলছেন কেন?
যযাতিদা হয়তো কুশলের মনের কথা বুঝতে পারলেন। একটু হেসে বললেন, ‘‘দ্যাখ কুশল, আমি জানি তোর মতো মুখচোরাদের দ্বারা প্রেম–ট্রেম হবে না। মেয়েদের সঙ্গে তোদের মতো ছেলেদের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উপায় একটাই। আর তা হল, বিয়ে।’’ একটু থেমে বললেন, ‘‘তাই বলি কী দেখেশুনে এবার একটা বিয়ে করে ফেল!’’ — ‘‘ধ্যেৎ, কী–সব বলছ?’’ লজ্জা পেল যেন কুশল।
যযাতিদা কিন্তু সিরিয়াস ভাবেই বললেন, ‘‘না রে কুশল, তোর ভালোর জন্যই বলছি। তুই বিয়ে করলে তোর মা–ও একটু রেস্ট পাবেন। একটু ভালো থাকবেন। আর, —তা ছাড়া বলছি তোর মতো ছেলেদের আজকের এই পৃথিবীতে প্রয়োজন আছে বলেই।’’
কুশল কিছু বুঝতে পারে না। একটু অবাক হয়। তাকিয়ে থাকে যযাতিদার দিকে।
যযাতিদা হেসে বললেন, ‘‘বুঝতে পারলি না তো? দ্যাখ, কঠিন বাস্তব, এই সমাজ ব্যবস্থা, বৈষম্য আর নিজের জীবনের সঙ্গে তুই যে ভাবে সংগ্রাম করে চলেছিস, অথচ হারিয়ে যাসনি ঘোরালো জীবনের চোরাপথে, বা নেতিবাদী কোনও পথ বেছে নিসনি, এই ব্যাপারটা দেশের পক্ষে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ জানিস? তোদের মতো ছেলেদের এই সংগ্রামই তো দেশকে এখনও, হ্যাঁ— এই অসময়েও ইতিবাচক রেখেছে। তোরাও যদি এই নষ্ট সময়ের মতো নষ্ট হয়ে যেতিস, তা হলে দেশের আর থাকতটা কী? —কিছুই না! বুঝেছিস?’’
আশ্চর্য মানুষ এই যযাতিদা। তাঁকে বিবাহ প্রথার বিরোধী বলেই এতদিন জেনে এসেছে কুশল। সে কথা গোপনও রাখেননি তিনি। সেই তিনি কিনা তাকে বিয়ে করার পরামর্শ দিচ্ছেন!
বার্নড শ’ বলেছিলেন, ম্যারেজ ইজ লিগালাইজড প্রস্টিটিউশন। যযাতিদাও এ কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন। নিজের জীবনেও হয়তো তা–ই অনুসরণ করে চলেছেন। বউদিও কিন্তু তাঁর নিজের স্ত্রী নন! —হ্যঁা, চমকে ওঠার মতো কথা বইকি। তবে, এ কথা অপ্রিয় সত্য।
বউদির সঙ্গে যযাতিদার পরিচয় হয় ব্যাঙ্কে। বউদির নাম সংযুক্তা। মিসেস সংযুক্তা সেন। স্কুলমাস্টার দেবালয় সেনের স্ত্রী। দেবালয় সেনকে চেনে না কুশল। তবে সংযুক্তা বউদির সঙ্গে কুশলের বন্ধুত্বের সম্পর্ক। সেই বন্ধু্ত্বে অদ্ভুত একটা শ্রদ্ধা–বোধ মিশে রয়েছে। সেখানে যেমন গভীর এক নৈকট্য আছে, তেমনই রয়েছে দুস্তর ব্যবধান। তাই ব্যক্তিগত ব্যাপারে সংযুক্তা বউদিকে যেচে কোনও প্রশ্ন কখনও সে করেনি। করার কথা ভাবেওনি। অবশ্য বউদি নিজে থেকে যখন কিছু বলেন, সীমার মধ্যে থেকেই সে সম্পর্কে নিজের মতামত জানায় সে। ব্যস, ওই পর্যন্তই।
একই ব্যাঙ্কের গ্রাহক ছিলেন সংযুক্তা সেন এবং যযাতিদা। ব্যাঙ্কেই দু’জনের আলাপ। সেই আলাপ ক্রমশ বন্ধুত্বে পরিণত হয়। সেই বন্ধুত্বই একদিন দু’জনকে গভীর ভালবাসায় জড়িয়ে ফেলে। আর ওই ভালবাসার জোরেই যযাতিদার হাত ধরে মিসেস সেন নিজের ঘর–সংসার ছেড়ে বেরিয়ে আসেন এবং তাঁর সঙ্গে বসবাস করতে শুরু করেন।
সেই থেকে এখনও দু’জনে একসঙ্গেই রয়েছেন। কিন্তু বিয়ে করেননি। সেই হিসেবে মিসেস সেন যযাতিদার প্রকৃত স্ত্রী নন!
তবে দু’জনের মধ্যে রয়েছে গভীর ভালবাসা। ব্যাপারটা সেভাবে প্রকাশিত না হলেও কুশল দু’জনের সঙ্গে কথা বলে বেশ বুঝতে পারে। অন্তত সংযুক্তা বউদি যে যযাতিদাকে খুব ভালবাসেন এবং তাঁর বিষয়ে যথেষ্ট সতর্ক, তা নিশ্চিত ভাবেই বলে দিতে পারে কুশল।
লর্ড বায়রনের একটা কথা আছে, আই হ্যাভ গ্রেট হোপস দ্যাট উই শ্যাল লাভ ইচ আদার অল আওয়ার লাইভস অ্যাজ মাচ অ্যাজ ইফ উই হ্যাড নেভার ম্যারেড অ্যাট অল। যযাতিদা আর সংযুক্তা বউদিকে দেখে বায়রনের এই কথাটাই কুশলের বারবার মনে হয়।
যদিও যযাতিদা মুখে সে ভাবে ভালবাসার তাৎপর্য স্বীকার করেন না। তাঁর কাছে নারী ও পুরুষের সম্পর্ক শুধুই যৌনতার খাতিরে। এবং, সেই সূত্রে বংশবিস্তারের জন্যেও। ভালবাসার অর্থ তাঁর কাছে নেহাতই একটা মায়া! যেমন পশুপাখি বাড়িতে রাখলে তাদের ওপর সকলেরই একটা মায়া পড়ে যায়, তেমনই।
কুশলের কাছে এ–সব ব্যাপারে বেশ চাঁচাছোলা ভাষায় কথা বলে থাকেন তিনি। তিনি বিশ্বাস করেন, যৌনতাকে প্রেমের একটা আবরণ পরিয়ে রেখে পুরুষ ও নারী একসঙ্গে থাকার পথ খুঁজে নেয়। তাই যৌন প্রেম ছাড়া পৃথিবীতে অন্য কোনও প্রেমের অস্তিত্ব নেই। তাঁর সাফ কথা।
যযাতিদার মধ্যে অদ্ভুত এক সাহসী প্রেমিক–মন আছে! এ দিক থেকে ধরলে পুরাণ কথিত যযাতির সঙ্গে অদ্ভুত মিল আছে এই প্রেমিক যযাতিদার। পুরাণে আছে, নহুষের ছেলে যযাতি, পুরুর বাবা। তিনি বিয়ে করেছিলেন অসুরদের পুরোহিত বা গুরু শুক্রাচার্যের মেয়ে দেবযানিকে। তাঁদের দুই সন্তান। যদু ও তুরবসু। এই জীবন নিয়ে যযাতি সুখেই থাকতে পারতেন। কিন্তু, পারলেন না।
দেবযানির বন্ধু ও দাসি ছিলেন শর্মিষ্ঠা। শর্মিষ্ঠা ছিলেন দানবরাজ বৃষপ্রর্বর মেয়ে। শর্মিষ্ঠার রূপ আগুন জ্বালিয়ে দেয় যযাতির মনে। আর মনস্তত্ত্ব তো বলছেই, নারী বশ অর্থ আর যৌনতায়।
তাই যযাতির জীবন ও প্রভাবকে অস্বীকার করতে পারেননি শর্মিষ্ঠাও। এই শর্মিষ্ঠার সঙ্গেই সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল যযাতির। তাঁরা গোপনে বিয়ে করেন। বা, সোজা কথায়, দু’জনে যৌনতায় মজে যান। ফল, শর্মিষ্ঠার গর্ভে যযাতির তিন সন্তান হয়। তাঁরা হলেন দ্রুহযু, অনু এবং পুরু।
প্রেম ও যৌনতার দিক থেকে পুরাণের যযাতির সঙ্গে আজকের যযাতিদারও বিশাল সাদৃশ্য রয়েছে। পুরাণ বলছে, যযাতি–শর্মিষ্ঠার সম্পর্কের কথা জানতে পেরে দেবযানি প্রচণ্ড আঘাত পান। বাবার কাছে নালিশ করেন।ক্রুদ্ধ শুক্রাচার্যের অভিশাপে যৌবনেই বৃদ্ধ হয়ে যান যযাতি। কিন্তু, বাবার এই অসহায়তা সহ্য করতে পারেননি ছেলে পুরু। তাই বাবা যযাতিকে নিজের যৌবন দান করে ফের স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
আজকের যযাতিদাও যেন তেমনই। তাঁর যৌবন যেন ফুরোনোর নয়। যত বয়স বাড়ছে, ততই তাঁর ব্যক্তিত্ব আর পৌরুষ বেড়ে চলেছে। এই মধ্য পঞ্চাশেও তিনি যেন প্রাক–চল্লিশের ক্ষমতা ধরেন। বয়স যেন বাড়ে না তাঁর। চিরযুবক।
বউদি আসার আগে প্রায় বছর পাঁচেক অবাধ যৌনতায় ভেসে গিয়েছিলেন। সরকারি চাকরি করতেন। মাইনেপত্রও ভালো। একা মানুষ। তার ওপর অসম্ভব ব্যক্তিত্ববান পুরুষ।
আর, খরচ বলতে মাত্র খাওয়া, বিদ্যুৎ বিল, কেবল টিভি ও ফ্ল্যাট ভাড়া। বাকিটা সাশ্রয়। সেই টাকা নিজের শরীরের চাহিদা মেটাতেই ব্যয় করে দিতেন। তবে কখনও নিষিদ্ধপল্লিতে যাননি। তাঁর কথায়, নচিকেতাই ঠিক গান লিখেছেন, ‘দেশজুড়ে আজ সোনাগাছি।’ চোখ–কান খোলা রাখলে নাকি মনোরঞ্জন করার মতো নারীর অভাব হয় না!
অবশ্য যযাতিদার জীবনেরও একটা গল্প আছে। তিনি তখন থাকতেন ডানলপ পেরিয়ে রথতলায়। এক মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে ছিল তাঁর ছোট সংসার। মেয়ের যখন তিন বছর বয়স, তখনই ঘটে সেই বিপর্যয়। কথা প্রসঙ্গে গল্প করতে করতে যযাতিদা সেই গল্প একদিন কুশলকে বলেওছিলেন। তিনি জানতেন না, তবে তাঁর বাড়িতে যাতায়াত ছিল বাইরের এক পুরুষের।
সেই পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাঁর স্ত্রীর। সেই সম্পর্ক এতদূর গড়ায় যে, একদিন তার হাত ধরে স্ত্রী চলে যান। সঙ্গে নিয়ে যান তিন বছরের মেয়েকেও। একটি চিঠি লিখে গিয়েছিলেন। সেই চিঠি পড়েছিল তাঁর পড়ার টেবিলে। চিঠিতে লেখা ছিল, ‘‘তোমার সঙ্গে থাকতে থাকতে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আমি একজনকে ভালবাসি। তার সঙ্গেই চললাম। আমাকে আর খুঁজো না।’’
সেই পুরুষটি যে কে, তা যযাতিদা কখনও জানতে পারেননি। তবে দারুণ আঘাত পেয়েছিলেন ওই ঘটনায়। অভিমানও হয়েছিল খুব। নীরবে সহ্য করেছিলেন সেই যন্ত্রণা। কাটিয়ে উঠতে বেশ কিছুদিন সময় লেগেছিল। কুশলকে তিনি সে কথা বলেননি, তবে তার ধারণা, অনেক রাত হয়তো সে–জন্য চোখের জলে বালিশ ভিজিয়ে কেটেছে তাঁর। হয়তো সেই অভিমানেই স্ত্রীকে খোঁজার বা তাঁকে ফিরিয়ে আনার কোনও চেষ্টাই তিনি করেননি।
তবে কুশল বলেছিল, ‘‘ওই বউদি চিঠিতে যে কথাই লিখে যান না কেন, তোমার কিন্তু তাঁর সঙ্গে একবার হলেও দেখা করা উচিত ছিল। উচিত ছিল কথা বলা।’’
অভিমানি যযাতিদা পালটা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘‘যে আমার সঙ্গে থাকতে চায় না, তাঁর ওপর জোর খাটিয়ে কি কোনও লাভ আছে?’’
কুশল দমে না গিয়ে ফের প্রশ্ন করেছিল, ‘‘কিন্তু ডিভোর্স? তোমাদের মধ্যে ডিভোর্সও তো হয়নি!’’
যযাতিদা বলেছিলেন, ‘‘তাতে কী হয়েছে?’’
কুশল বলেছিল, ‘‘তা হলে তো তিনি এখনও তোমার আইনত স্ত্রী!’’
যযাতিদা ম্লান হেসে বলেছিলেন, ‘‘সে তো আইনের খাতায়। কিন্তু, অত সব আইনের নিয়মকানুন মেনে কি জীবন চলে রে পাগল?’’
কুশল জানতে চেয়েছিল, ‘‘জানি। কিন্তু, এর ফলে ভবিষ্যতে কোনও সমস্যা হবে না তো?’’
যযাতিদা বলেছিলেন, ‘‘তা কী করে বলব? তা ছাড়া, গোটা জীবনটাই তো একটা সমস্যা! আইনের সমস্যা তার চেয়ে বেশি আর কী হবে?’’
যযাতিদার দার্শনিক প্রশ্নের উত্তর দেয়নি কুশল। তবে সে জানে, সেই স্ত্রী যেমন তাঁর কাছ থেকে আইনি বিচ্ছেদ না নিয়েই অন্য পুরুষের সঙ্গে নিজের সন্তান নিয়ে ঘর ছেড়েছেন, তেমনই যযাতিদাও এখন যাঁর সঙ্গে ঘর করছেন, তিনিও তাঁর বৈধ স্ত্রী নন। বর্তমানে সে যাকে বউদি বলে ডাকে, সেই তিনি, অর্থাৎ সংযুক্তা বউদিও আইনি বিচ্ছেদ না নিয়েই নিজের স্বামী ও সন্তানকে ছেড়ে যযাতিদার কাছে চলে এসেছিলেন।
যযাতিদা তাঁকে নিয়ে নতুন ঘর পাতেন। তবে প্রথম স্ত্রী চলে যাওয়ার পাঁচ বছর পর। প্রথম স্ত্রী চলে যাওয়ার পরই রথতলার পুরনো বাড়ি ছেড়ে দিয়ে উঠে আসেন বিধান সরণিতে ক্ষুদিরাম বসু কলেজের কাছে এই অ্যাপার্টমেন্টে।
তার পর থেকে দশ বছর ধরে বিয়ে না করেও চলছে তাঁদের দাম্পত্য। বিয়ে করে যে সংসার যযাতিদা পাঁচ বছরও টিকিয়ে রাখতে পারেননি, বিয়ে না করে নতুন সংসার দশ বছর টিকিয়ে রাখতে পেরেছেন তিনি। অর্থাৎ, এখনও পর্যন্ত নতুন বউদি যযাতিদার কাছেই রয়েছেন।
আর, বউদির সঙ্গে সংসার শুরু করার পর তাঁরও অতি নারী–তৃষ্ণা একেবারে কমে যায়। নতুন বউদিকে নিয়ে এখন তিনি ভালোই আছেন। তবে যৌনতা থেকে রাজনীতি, অর্থনীতি থেকে সমাজ, সমস্ত বিষয়েই খোলামেলা তিনি। হাসিঠাট্টাও করেন অবলীলায়। (ক্রমশ)