স্বপ্ন শূন্যতা এবং
উপমন্যু রায়
(পর্ব-০১)
কাল রাতে ফের সেই স্বপ্নটা দেখল কুশল।
হেঁদুয়ার পাশে ফুটপাথ ধরে হাঁটছিল সে। হঠাৎই তার সিগারেট খেতে ইচ্ছে করল। ঠিক বেথুন কলেজের উলটো দিকে এসে পৌঁছনোর পর সিগারেট ধরানোর জন্য দাঁড়িয়ে পড়ল। পকেট থেকে প্যাকেট বের করে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়েই রইল। এলোমেলো চোখে চারদিকে উদ্দেশ্যহীনভাবে তাকিয়ে থাকার পর প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে দিল। তার পর দেশলাইয়ের জন্য ফের পকেটে হাত দিলেও বের করতে পারল না।
তার আগেই হুঁশ করে ঝাঁ–চকচকে একটা দামি গাড়ি একেবারে তার সামনে এসেই থেমে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই খুলে গেল গাড়ির দরজা। নেমে এলো এক সুবেশা সুন্দরী। গাড়ির মতোই চোখ ধাঁধানো চকচকে এই তম্বী। কুশলকে স্তম্ভিত করে দিয়ে ঠিক তার সামনে এসে দাঁড়াল।
তার হাতে দামি লাইটার জ্বলে উঠল নিমেষে। ঠিক তার মুখের সামনে। জ্বলে উঠল সেই সিগারেট। হতবাক কুশল কিছুই বুঝতে না পেরে শুধু জোরে টান দিল। তার পর তার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো একরাশ সাদা ধোঁয়া। আর সেই ধোঁয়ায় ক্রমশ ধূসর হয়ে গেল তার সামনে থাকা সেই অজ্ঞাত পরিচিতা। আর, রোমাঞ্চে ভরা ঘুমটাও কুশলের গেল ভেঙে।
এক
পরে অবশ্য ফের ঘুমিয়েছে সে। কিন্তু, অন্য দিনের মতোই স্বপ্নটার বাকি অংশ আর ফিরে আসেনি তার কাছে।
সন্দেহ নেই স্বপ্নটা ভারি অদ্ভুত। তবে, এই স্বপ্ন কুশল সবসময় দেখে না। যখন শরীর একটু খারাপ থাকে, তখনই দেখে। কেন দেখে, তা অবশ্য সে জানে না। কাল কিন্তু তার শরীর খারাপ ছিল না। কিন্তু খারাপ হল। কারণ, গণপিটুনি। হ্যাঁ, কাল সে মারাত্মক গণধোলাই খেয়েছে। ভালো মতোই খেয়েছে।
তবে এই গণধোলাই তার প্রাপ্য ছিল না। অতি উৎসাহী কিছু মানুষ রীতিমতো অন্যায়ভাবে তাকে যেমন খুশি পিটিয়েছে। খুব লেগেছে তার। কিন্তু কে বুঝবে তখন? সকলেই তো হাতের সুখ নিতে ব্যস্ত ছিল! পারলে তারা তখন তাকে মেরেই ফেলতে চাইছিল!
ঘটনাটা নারীঘটিত। আর, ঘটেছিল বাসে। সে ডানলপ থেকে ফিরছিল। বাসে বেশ ভিড় ছিল। সিট তো পায়ইনি, এমনকী, দাঁড়ানোর জায়গাও ঠিক মতো পাচ্ছিল না। পুরুষ ও মহিলাদের দাঁড়ানোর ঠিক মাঝে বাসের পিছনের দিকে আড়াআড়ি দাঁড়িয়েছিল।
সিঁথির মোড় পার হওয়ার পরই আচমকা ব্রেক কষেছিল বাসটা। সে টাল রাখতে পারেনি। আবার পুরো পড়েও যায়নি। কোনও মতে নিজেকে ধরে রাখতে পেরেছিল মাত্র। কিন্তু হালকা একটা ধাক্কা লেগে যায় তার পাশে দাঁড়ানো এক মহিলার সঙ্গে। আর সঙ্গে সঙ্গে মহিলাটি ঘুরে তার মুখোমুখি দাঁড়ায়। তার পর প্রথমেই তার গালে কষিয়ে দেয় সপাটে এক চড়। একই সঙ্গে ‘‘অসভ্য, জানোয়ার, বাড়িতে মা–বোন নেই’’ ইত্যাদি আরও কী–সব চোখা চোখা শব্দ জুড়ে গালাগালি করতে লাগল। বেশ কয়েকটা এলোপাথারি কিল–ঘুঁষিও মারল।
কে একজন বলে উঠল, ‘‘সত্যি, এইসব অসভ্য লোকদের জন্যই গাড়ি–ঘোড়ায় চড়া এখন রিস্কি হয়ে গেছে!’’
অন্য একজন বলল, ‘‘আরে দাদা, ১৬ ডিসেম্বরের কথা ভুলে গেছেন? চলন্ত বাসের মধ্যে এ রকমই কয়েকটা বদমাশ নির্ভয়াকে ধর্ষণ করে খুন করেছিল!’’
ভাবো অবস্থাটা! কুশল কখনও মেয়েদের চোখের দিকে চোখ রেখে ঠিক মতো কথাই বলতে পারে না। চোখে চোখ পড়লে অপরাধীর মতো নামিয়ে নেয়। যে কারণে কলেজে পড়ার সময় তার বন্ধুরা তাকে ‘কাপুরুষ’ বলে খেপাত! কোনও কোনও মেয়েও তাকে সে কথা বলত। সেই কুশলকেই কিনা ১৬ ডিসেম্বরের সেই ছটি শয়তানের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে!
২০১৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর দিল্লির রাজপথে রাত দশটা নাগাদ যে ঘটনা ঘটেছিল, তা শুধু ভারত নয়, ভারতের বাইরের মানুষও সংবাদ মাধ্যমের সৌজন্যে জেনে গিয়েছে। সেদিন নির্ভয়ার ওপর নারকীয় অত্যাচার চালায় ওই দুষ্কৃতীরা। ২৯ ডিসেম্বর সেই নির্ভয়া সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে মারা যান।
তবু, সে সবে কান না দিয়ে সে বলার চেষ্টা করেছিল, ‘‘কী বলছেন যা–তা!’’
কিন্তু, তার কথা আর শুনবে কে?
অবস্থা আরও জটিল করে দিল সেই মহিলা। অন্য যাত্রীদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘‘এই লোকটা তখন থেকে আমার সঙ্গে অসভ্যতা করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এখন একেবারে গায়ের ওপর— ছিঃ!’’
ব্যস, আর যাবে কোথায়? বাসের অতি–ভালো মানুষ কয়েকজন প্রবল আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ওপর। যেমন খুশি পেটাতে থাকে। কিন্তু, কুশল জানে, মহিলাটি ঠিক বলেনি। না–না, ঠিক তো নয়ই, বরং মিথ্যে বলছে!
বাসের মধ্যে রীতিমতো হই–হট্টগোল চলছে। চলছে চিৎকার–চেঁচামেচি। সব দেখে ড্রাইভার আর ঝুঁকি না নিয়ে স্টপ না আসতেই থামিয়ে দিল বাস। কন্ডাক্টর প্রায় ধাক্কা দিয়েই বাস থেকে নামিয়ে দিল তাকে। লুকিং গ্লাসে সে দৃশ্য দেখার পর ড্রাইভার আর সময় নেয়নি। বাস ছেড়ে দেয়। তবে বাস থেকে কোনও বীরপুরুষই কেন যেন আর নেমে আসেনি! হয়তো সেই বীরপুরুষরা, যারা রাস্তায় তেমন বীরত্ব দেখাতে পারবে কিনা, কিংবা কী থেকে কী–হয়ে যায়, এমনই নানা ভাবনায় সন্দিহান ছিল। তাই তারা আর বাস থেকে নামার চেষ্টা করেনি।
বাসটা চলে যেতেই কুশলও আর দাঁড়াল না। আশপাশে কেউ ছিল না। সম্মান বাঁচাতে সে দ্রুত রাস্তা পার হয়ে চলে এলো অন্য পাড়ে। তার পর শ্যামবাজারের দিকে হাঁটতে লাগল।
গণপিটুনিতে বহু মানুষের প্রাণহানির মতো ঘটনা এ দেশে ঘটেছে। ভাগ্যিস তেমন ভয়ঙ্কর ঘটনা তার সঙ্গে ঘটেনি! বাড়িতে মা–ও বুঝতে পারেনি! পারলে কী–যে হত, কে জানে!
তবু যে পিটুনি সে খেয়েছে, তার যন্ত্রণা তখন বুঝতে না পারলেও বাড়ি ফিরে ভালো মতোই টের পায়। বিশেষ করে খেয়ে শুতে যাওয়ার পর। বিছানায় রীতিমতো কষ্ট পাচ্ছিল সে। বাড়িতে ব্যথা কমার ওষুধ ছিল। বিছানায় বসেই একটা ট্যাবলেট খেল, আর প্রায় সারা শরীরেই মলম লাগাল। তার পর শুয়ে পড়ল।
কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়েও পড়ল। আর, ঘুমিয়েই দেখল সেই স্বপ্নটা! অর্থাৎ, কালও সে প্রায় অসুস্থই ছিল বলা যায়। সেই অসুস্থ অবস্থাতেই স্বপ্নটা দেখল কুশল।
এই স্বপ্নটা এর আগেও সে অনেকবার দেখেছে। যখনই জ্বর বা ওই জাতীয় শরীর খারাপ হয়, তখনই সে এই স্বপ্নটা দেখে। তবে কাল রাতে দেখার যেন একটা অন্য তাৎপর্য আছে। কারণ কাল সে মার খেয়েছে নারীঘটিত কারণে, আর স্বপ্নটা ছিল যথারীতি নারী–কেন্দ্রিক।
ব্যাপারটা সত্যিই অদ্ভুত। যদিও দুটি ব্যাপার সম্পূর্ণ বিপরীত। তবু, বিষয়টাকে বেশি গুরুত্ব দিল না কুশল। বরং, সকলের সামনে নারীর সঙ্গে অভব্যতার অভিযোগে গণপিটুনি খাওয়ার লজ্জা, আর মানসিক দংশন এবং তীব্র একটা ক্ষোভ পরদিন তাকে শারীরিক যন্ত্রণার কথা ভুলিয়ে দিল। (ক্রমশ)