স্বপ্ন শূন্যতা এবং
(পর্ব ০৫)
উপমন্যু রায়
পাঁচ
সকাল সাড়ে নটা। বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল কুশল। সাড়ে দশটার মধ্যে আর এন মুখার্জি রোডে পৌঁছতে হবে। সেখানে একটা অফিসে সে ডাক পেয়েছে। ইন্টারভিউ।
—ইন্টারভিউ না ছাই! একটা ছোটখাটো চা–কোম্পানির অফিস। চেয়েছিল অফিস স্টাফ। মাইনে দেবে মাত্র চার হাজার! ডিউটি সকাল সাড়ে নটা থেকে পাঁচটা। যদিও ওই সময়টা লোক দেখানো। আসলে কাজ করতে হবে আরও বেশি। ইন্টারভিউর লাইনে যখন সে দাঁড়িয়েছিল, তখন অফিস বেয়ারার সঙ্গে লাইনে দাঁড়ানো কয়েকজন অত্যুৎসাহী আলাপ জমিয়েছিল। তখনই শুনল, অফিসে ঢোকার সময় সাড়ে নটা। বের হতে হতে সাড়ে ছটা তো বটেই কোনও কোনও দিন সাতটা–সাড়ে সাতটাও বেজে যায়।
অর্থাৎ, এই চাকরি করলে টিউশনিগুলো ছাড়তে হবে। চাকরি পেলে তো সব ছেড়ে দিতে অসুবিধে নেই। কিন্তু, চার হাজার টাকা মাইনের জন্য সে সব ছেড়ে দেবে কী করে? এখানে তো তার টিউশনির থেকেও কম মাইনে! আর প্রায় জনা পঞ্চাশেক ইন্টারভিউ দিতে এসেছে। বিজ্ঞাপনে দেখেছে, তিনদিন ইন্টারভিউ হবে। তার মানে, বাকি দু’দিনেও যদি গড়ে এমনই চাকরি প্রার্থী আসে, তা হলে তিনটি পোস্টের জন্য দেড়শো জনের মতো ইন্টারভিউ দেবে! হায়, ভগবান!
আর ভাবতে পারল না কুশল। ইন্টারভিউ দেওয়ার আগেই মনটা দমে গিয়েছিল। তাই ইন্টারভিউটাও তেমন ভালো হল না। ধরেই নেওয়া যায় চাকরিটা তার হচ্ছে না। হলেও করত কিনা, তা অবশ্য সে নিজেই জানে না।
রাস্তায় নামতেই সে বুঝতে পারল তার মোবাইল বাজছে। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করতেই দেখল যযাতিদার ফোন। মোবাইলের বোতাম টিপে বলল, ‘‘হ্যাঁ দাদা, বলো।’’
— ‘‘তুই কোথায়?’’
— ‘‘এই একটা ইন্টারভিউ দিতে এসেছিলাম।’’
— ‘‘তাই নাকি? এ তো খুব ভালো খবর! বলিসনি তো?’’
— ‘‘বলার সুযোগ পাইনি। গতকালই বিজ্ঞাপন দেখে ফোন করেছিলাম। আজ যেতে বলল। আবেদনকারীর সংখ্যা মনে হয় কম নয়। কাল, পরশু, আরও দু–দিন ইন্টারভিউ হবে।’’
— ‘‘সে যাই হোক, লাস্ট অবধি কী হল, তা–ই বল?’’
দমে যাওয়া গলায় কুশল বলল, ‘‘মোটেও ভালো খবর নয়।’’ বলেই বিজ্ঞাপন দেখা থেকে শুরু করে কোম্পানির কাছ থেকে ফোন পাওয়া, ইন্টারভিউ দেওয়া, মাইনেপত্র, ডিউটি আওয়ার্স, ইন্টারভিউ দিতে আসা অন্য কর্মপ্রার্থীদের কথা, সবই বলল।
সব শুনে যযাতিদা বললেন, ‘‘তা হলে ভালোই হয়েছে। যাক ও–সব কথা, হ্যাঁ, শোন—।’’
কুশল বলল, ‘‘বলো।’’ ইন্টারভিউটা মন ভেঙে দিলেও যযাতিদার ফোন তার মন অনেকটাই ভালো করে দিল। সত্যিই, জাদু জানেন যযাতিদা। বললেন, ‘‘হ্যাঁ, শোন। আজ রাতে আমার সঙ্গে এক জায়গায় যাবি?’’
কুশল লাফিয়ে উঠল, ‘‘নিশ্চয়ই। কোথায় যাবে?’’
যযাতিদা বললেন, ‘‘লাভপুর। আমার এক বন্ধু আর আমি যাচ্ছি। বন্ধুর দেশের বাড়ি সেখানে। কাল দুপুর অবধি থাকব। বিকেল নাগাদ রওনা দেব। রাত নটা–দশটার মধ্যে মনে হয় ফিরে আসতে পারব।’’
কুশল বলল, ‘‘ঠিক আছে।’’
যযাতিদা বললেন, ‘‘তা হলে এখন সোজা বাড়ি চলে যা। মাসিমাকে সব বল। আর তৈরি হয়ে নে। রাত নটার মধ্যে ফ্ল্যাটে চলে আয়।’’
যযাতিদার সঙ্গে ঘুরতে যেতে খুব ভালো লাগে কুশলের। এর আগেও পাঁচবার গিয়েছে। দু’বার শুধু যযাতিদার সঙ্গেই গিয়েছে। বাকি তিনবার সংযুক্তা বউদিও ছিলেন।’’
আসলে ঘুরতে খুবই পছন্দ করে কুশল। কিন্তু বাড়িতে মা একা। তাই বেশি দিনের জন্য কোথাও যেতে পারে না। গেলে এক–দু’দিনের বেশি কোথাও থাকে না।
বাড়ি ফিরে যযাতিদার সঙ্গে ঘুরতে যাওয়ার কথা মাকে বলল কুশল। যযাতিদার সঙ্গে গেলে মা কোনও দিনই আপত্তি করেন না। এবারও করলেন না। শুধু বলে দিলেন, ‘‘ঠিকমতো থাকবি। যযাতিদার কথা শুনবি। আর আমাকে ফোন করবি।’’
রাত সাড়ে আটটা নাগাদ খেয়েদেয়ে যযাতিদার ফ্ল্যাটে পৌঁছে গেল কুশল। সঙ্গে একটা ব্যাগ, ব্যাগে এক জোড়া জামা–প্যান্ট, আর গামছা, সাবান, টুথ ব্রাশ, পেস্ট, এই সব টুকিটাকি আর কী! আর আছে মোবাইল। ফোন করে মায়ের সঙ্গে সবসময় যোগাযোগ রাখতে হবে।
ফ্ল্যাটের দরজা খুললেন সংযুক্তা বউদি।
ভিতরে ঢুকে দেখল যযাতিদা খেতে বসেছেন। বললেন, ‘‘আয়, বসে পড়। ভালো রান্না করেছে তোর বউদি।’’
কুশল বলল, ‘‘না–না, পারব না। মা জোর করে বেশি খাইয়ে দিয়েছে।’’
সংযুক্তা বউদি হাসলেন। বললেন, ‘‘আসলে মা তো! ছেলে বাইরে যাচ্ছে। তাই তোকে বেশি করে খাইয়ে দিয়েছেন যাতে রাস্তায় খিদে না পায়! তোর মা কিন্তু তোকে খুবই ভালবাসেন!’’
যযাতিদা খেয়েদেয়ে তৈরি হলেন। কিন্তু, যযাতিদার বন্ধু আসতে সাড়ে নটা বাজিয়ে দিলেন। তাই তিনি এসে পৌঁছতেই কেউ আর দেরি করল না। সকলেই উঠে বসল তাঁর পাজেরোতে। পিছনের সিটে যযাতিদা আর কুশল। সামনের সিটে ড্রাইভারের পাশে সেই বন্ধু। সকলে উঠে বসতেই তাড়াতাড়ি গাড়িতে স্টার্ট দিল ড্রাইভার।
যযাতিদার বন্ধুর নাম পরম। মানুষটা বেশ মজার। বেশ হাসিঠাট্টা করতে শুরু করলেন প্রথম থেকেই। তার পর ক্রমে সেই হাসিঠাট্টা থেকে সিরিয়াস বিষয়েও আলোচনা শুরু হয়ে গেল। পরমবাবু বললেন, ‘‘বুঝলে যযাতি, যেখানে যাচ্ছি, দেখতে পাবে, সেখানকার মানুষ কেমন, আর তারা কী অবস্থায় রয়েছে!’’
যযাতিদা বললেন, ‘‘আমি শান্তিনিকেতনে গিয়েছি। গিয়েছি তারাপীঠও। কিন্তু, লাভপুরে কখনও যাইনি।’’
কুশল বলল, ‘‘লাভপুরেই তো জন্মেছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।’’
যযাতিদা বললেন, ‘‘হ্যাঁ, সেটা জানি। এখান থেকেই তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাশ করেন। তাঁর বহু লেখায় বারবার লাভপুর উঠে এসেছে।’’
পরমবাবু বললেন, ‘‘এ ছাড়াও লাভপুরকে নিয়ে অনেক কাহিনি প্রচলিত আছে। যেমন পুরাণ অনুযায়ী, মহাদেব যখন সতীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে পাগলের মতো নেচেছিলেন, নারায়ণ তখন চক্র দিয়ে সতীর দেহ ছিন্ন করেন। সতীর কাটা ঠোঁট তখন ফুল্লরায় পড়েছিল। ফুল্লরা রয়েছে এই লাভপুরেই। ফুল্লরার যেখানে ঠোঁট পড়েছিল, সেই জায়গাটি ভারতের ৫১ শক্তিপীঠের একটি হিসেবে পরিচিত।’’
কুশল বিষয়টি জানত না। বলল, ‘‘এটা আমি প্রথম জানলাম। এর আগে শক্তিপীঠ হিসেবে তারাপীঠ, কঙ্কালীতলা, কালীঘাট, কামাক্ষ্যার কথা জানতাম।’’
যযাতিদা শুধরে দিয়ে বললেন, ‘‘তারাপীঠকে শক্তিপীঠ বলা হয় না। বলা হয় সিদ্ধপীঠ। বামাক্ষ্যাপা এখানেই সিদ্ধিলাভ করেছিলেন।’’
পরমবাবু বললেন, ‘‘আরও একটা জনশ্রুতি আছে। ফুল্লরার শক্তিপীঠে যে মন্দির আছে, তার পাশে একটি পুকুর আছে। শ্রীরামচন্দ্র রাবণ বধের জন্য যে দুর্গাপুজোর আয়োজন করেছিলেন, সেই পুজোয় ১০৮টি নীল পদ্মের প্রয়োজন হয়। হনুমান সেই ১০৮টি নীল পদ্ম সংগ্রহ করেছিলেন সেই পুকুর থেকেই।’’
গাড়ি ছুটছে লাভপুরের দিকে। দু’পাশে অন্ধকারের বিস্তার বাড়ছে। মাঝে মাঝে আলো দেখা যাচ্ছে। চারদিকের গাছপালা আর বাড়িঘর দ্রুত সরে যাচ্ছে চোখের সামনে থেকে।
কয়েক মুহূর্ত সকলেই চুপ করে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল। তার পর এক সময় যযাতিদা বললেন, ‘‘পরম, এখানেই তো তোমাদের পূর্বপুরুষের বাড়ি। তাই না?’’
পরমবাবু বললেন, ‘‘হ্যাঁ, বিশাল বাড়ি। প্রায় এক বিঘা জমি জুড়ে এই বাড়ি। অনেক গাছপালাও আছে। তাই তো মাঝে মধ্যে আসতে হয় এখানে।’’
যযাতিদা বললেন, ‘‘এখানে এখন কে আছে?’’
পরমবাবু বললেন, ‘‘এখন কেউ নেই। থাকার মধ্যে আমার এক নিঃসন্তান পিসি ছিলেন। তিনিও মারা গিয়েছেন।’’
যযাতিদা জানতে চাইলেন, ‘‘তা হলে বাড়ি কি ফাঁকাই পড়ে থাকে?’’
পরমবাবু বললেন, ‘‘না, এখন বাড়ি দেখাশোনার জন্য একজন আছেন। পরিবার নিয়ে তিনি সেখানেই থাকেন।’’
যযাতিদা এবার কুশলকে বললেন, ‘‘বুঝলি কুশল, পরমের সেই বাড়িতেই আমরা যাচ্ছি।’’
কুশল সোৎসাহে হাসিমুখে বলে, ‘‘বুঝতে পেরেছি!’’
কিন্তু পরমবাবু বললেন, ‘‘হ্যাঁ, লাভপুর জায়গাটা বেশ ভালো। এর ইতিহাসও প্রাচীন। তবে, এত পুরাণ–কথা, জনশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও দেখতে পাবে লাভপুরে দারিদ্রও কম নেই। দিনে দু’বেলাও কত মানুষ যে ঠিকমতো খেতে পায় না!’’
যযাতিদা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘‘এটাই ভারতের প্রকৃত চেহারা। কলকাতা, মুম্বই, দিল্লির মাল্টিপ্লেক্সে বসে এই চেহারার কথা ভাবা সত্যিই কঠিন। অথচ ওই মাল্টিপ্লেক্স ছবিটাই ভারতের মুখ হিসেবে এখন সরকারি ভাবে তুলে ধরা হয়।’’
কুশল বলল, ‘’এটা তো আত্ম–প্রতারণা!’’
পরমবাবু বললেন, ‘‘এটাই ভারতের ট্রাজেডি।’’
যযাতিদা বললেন, ‘‘আমাদের সত্যজিৎ রায় তাঁর অনেক ছবিতে এই ব্যাপারগুলি তুলে ধরতেন বলে হিন্দি সিনেমার অভিনেত্রী নার্গিস তাঁর সমালোচনা করেছিলেন। বলেছিলেন, ভারতের দারিদ্র বিক্রি করেন কিছু ভারতীয় পরিচালক।’’
পরমবাবু বললেন, ‘‘ঋত্বিক ঘটক তাঁর ছবিতে এমন দারিদ্র আরও স্পষ্ট ও গভীর করে ছবির পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন।’’
যযাতিদা মাথা নেড়ে সায় দিলেন।
পরমবাবু বললেন, ‘‘অথচ ওটাই বাস্তব। বাকি সব মিথ্যে, বা স্বপ্ন।’’
যযাতিদা হাসলেন।
কুশল জানতেই চাইল, ‘‘প্রতিবার ভোটের পর যখন সরকার গঠিত হয়, ভাবি, এবার হয়তো পরিবর্তন কিছু হবে। কিন্তু, বছরের পর বছর কেটে যায়। আর একটা ভোট আসে। কিছু পরিবর্তন হতে আর দেখি না!’’
পরমবাবু বললেন, ‘‘হবে কী করে? আসলে দুর্নীতি আমাদের রক্তে মিশে গিয়েছে। যে যায় লঙ্কায়, সেই হয় রাবণ!’’
যযাতিদা হাসিমুখে বললেন, ‘‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছ পরম। স্বাধীনতার পর থেকে এতদিন পর্যন্ত আমরা আর কিছু করি, বা না–ই করি, দুর্নীতির অনুশীলনটা ভালো মতোই করেছি। ফলে ব্যাপারটা বেশ পোক্ত হয়েছে এতদিনে।’’
পরমবাবু বললেন, ‘‘দুর্নীতির শিকড় আজ এ দেশের সমাজ–ব্যবস্থার গভীরে পৌঁছে গিয়েছে। দুর্নীতিমুক্ত মানুষও যখন তেমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়, তখন সে–ও সেই দুর্নীতির জালে জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু সামান্য কয়েকজন মানুষ, যাঁরা দুর্নীতির সঙ্গে কখনও আপস করেননি, তাঁরা হারিয়ে গিয়েছেন। দুর্নীতি করলে ভালো, না করলে হারবে। যদিও সমাজ তোমার হার মেনে নেবে। কিন্তু, সমাজকে দু্র্নীতিমুক্ত করতে যেও না কখনও। গেলেই মরবে।’’
কুশল বলল, ‘‘হিন্দি সিনেমার মতো!’’ হাসলেন পরমবাবু। বললেন, ‘‘হ্যাঁ, কিছুটা তো বটেই।’’
রাত তিনটে নাগাদ লাভপুর পৌঁছে গেল পরমবাবুর গাড়ি। ঘুটঘুটে অন্ধকারে চারদিকটা পুরোপুরি বোঝা গেল না। তবে গাছপালা আর ঝিঁঝির ডাক ভালোই শুনতে পেল কুশল। একটা বাড়ির সামনে পৌঁছে পরমবাবুর নির্দেশে গাড়ি থামাল ড্রাইভার।
গেটের কাছেই তিনটে ঘর রয়েছে। সেখানে থাকেন স্ত্রী–সহ কেয়ারটেকার। তাঁকে আগেই বলা ছিল। ডাকতেই তিনি বেরিয়ে এলেন। গেট খুলে দিলেন। গেট পেরিয়ে কিছুটা এসে গাড়ি পার্ক করল ড্রাইভার।
গেট থেকে বেশ কিছু্টা পথ পেরিয়ে যেতে হয় মূল বাড়িতে। মূল বাড়িটা তিনতলা এবং বেশ বড়। তিনতলারই পাশাপাশি দুটি ঘর পরমবাবু থাকার জন্য ঠিক করলেন। একটি ঘরে পরমবাবু এবং অপর ঘরে যযাতিদা ও কুশল।
কুশল চাইছিল গল্প করে রাতটা কাটাতে। কিন্তু, পরমবাবু রাজি হলেন না। বললেন, ‘‘কাল সকাল–সকাল উঠতে হবে। অনেক কাজ আছে। তাড়াতাড়ি সব কাজ শেষ করে কালই তো ফিরতে হবে। আজ না ঘুমোলে কাল এত কাজ করতে অসুবিধে হবে।’’
যযাতিদা হাসতে হাসতে বললেন, ‘‘রাতে কিছুটা দেখতে না পেলেও জায়গাটা মনে হয় ওর খুব ভালো লেগে গিয়েছে!’’
কুশল হেসে বলে, ‘‘সব কিছু কেমন যেন রহস্যময় মনে হচ্ছে। বেশ ভালো লাগছে।’’
যযাতিদা হাসতে হাসতে পরমবাবুকে বললেন, ‘‘তাই রাতে গল্পগুজব করে সেই রহস্যটা কুশল মনেপ্রাণে অনুভব করতে চাইছে।’’
পরমবাবু হাসলেন। কিন্তু রাত জেগে গল্প করতে রাজি হলেন না। সেদিন রাতে কেউ জাগল না। যযাতিদার সঙ্গে কুশল একটি ঘরে শুয়ে পড়ল। আর, অন্য ঘরে পরমবাবু শুয়ে পড়লেন।
…পরদিন কুশলের ঘুম ভাঙতে সাড়ে আটটা বেজে গেল। ঘুম থেকে উঠে সে দেখে, সারা বাড়ি লোকজনে জমজমাট। ঘর থেকে বেরিয়ে তিনতলার বারান্দায় এলো সে। দেখল, নীচে লোকজনের ভিড়।
সকলের মধ্যে একটা ব্যস্ততা। এখন সে ভালো করে লক্ষ্য করল, বাড়ি থেকে মূল গেট বেশ কিছুটা দূরে। মাঝে বেশ বড় জমি। নানা ধরনের গাছপালা সেখানে। মাঝে একটা রাস্তা করা হয়েছে বাড়ি থেকে গেটে যাতায়াতের জন্য। জমির একটা ধার ত্রিপল দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে। সেখানে জনাকয়েক ঠাকুর রান্না করছে।
যযাতিদা এসে তাঁর পাশে দাঁড়ালেন। হেসে বললেন, ‘‘কী রে, ভাবছিস এত লোক কেন?’’
কুশল জিজ্ঞাসার চোখে তাকায়।
যযাতিদা বললেন, ‘‘প্রতি বছর একবার করে পরম গ্রামের গরিবদের জন্য খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করে। নিজে একা পারে না। তাই এলাকার ক্লাবকে বলে রাখে। ক্লাবের সকলে হাসিমুখে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে।’’
কুশল জিজ্ঞাসা করে, ‘‘প্রতি বছর এই সময়েই এমন ব্যবস্থা করেন পরমদা?’’
যযাতিদা বললেন, ‘‘না, সময়টা ঠিক থাকে না। তবে বছরে একবার করে। করার এক সপ্তাহ আগে ফোন করে ক্লাবকে বলে দেয়।’’
বেলা এগারোটা থেকেই লোক আসতে শুরু করল। যদিও খাওয়া শুরু হতে হতে বারোটা বেজে গেল। ক্লাব থেকে বলা হয়েছিল, পাঁচশো লোকের মতো আসবে। কিন্তু, খাওয়ার সময় দেখা গেল, এসে গিয়েছে ছশোরও অনেক বেশি। ভাগ্যিস সাড়ে ছশো জনের মতো খাবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তাদের সঙ্গে কেয়ার টেকার ও তাঁর স্ত্রী খেয়ে নিলেন।
সকলেই আনন্দের সঙ্গে খাচ্ছে। যেন কোনও উৎসব আজ। যেন সকলেই সেই উৎসবে অংশ নিয়েছে। মাংস–ভাত আর ডাল, সঙ্গে একটা তরকারি। আর, —কী!
সত্যিই উৎসবের খাওয়া! তবে, সেখানেই কাহিনির শেষ নয়। খাওয়ার পর্যায় যখন শেষ হল, মানে যখন যযাতিদা, পরমদা এবং কুশল–সহ ক্লাবের সকলের খেতে বসার কথা, দেখা গেল, তখনও লোকের আসা শেষ হয়নি! দূরের কোনও গ্রাম থেকে আরও পঁচিশ–তিরিশজন এসে হাজির হয়েছে।
তারা নাকি অনেক দেরি করে খবর পেয়েছে। তাই ঠিক সময়ে এসে পৌঁছতে পারেনি। ক্লাবের মেম্বাররা তাদের খাবার শেষ বলে ফিরিয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু, যযাতিদা বললেন, ‘‘যা খাবার আছে, তাই ওদের দিয়ে দাও। আমাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা যাবে।’’
একই কথা বললেন পরমদা। ক্লাবের সকলে তা মেনে নিল।
পঁচিশ–তিরিশ জন খেয়ে ওঠার পর ক্লাবের ছেলেরা এসে তাদের বসে পড়তে বলল। কিন্তু, বাদ সাধলেন সেই যযাতিদাই। বললেন, ‘‘তোমরা আগে খেয়ে নাও।’’
কিন্তু, তারা কিছুতেই যযাতিদার কথা শুনবে না। তারা চায়, কুশলরা যেন আগে খেয়ে নেয়।
কিন্তু, কোনও কথাই শুনলেন না যযাতিদা। বললেন, ‘‘তোমরা অনেক খাটাখাটুনি করেছ। তোমাদের আগে খাওয়া হয়ে যাক, তার পর আমরা খাব।’’
ক্লাবের সেক্রেটারি এসে স্পষ্টই বলে দিলেন, ‘‘খাবার যা আছে, আমাদের ছেলেরা যদি আগে বসে পড়ে, তা হলে এই খাবারে তাদেরই কুলোবে না। তার পর আপনারা আছেন। আপনাদের জন্য তো অবশিষ্ট কিছুই থাকবে বলে মনে হচ্ছে না!’’
পরমদা বললেন, ‘‘না থাকুক, আপনারা বসে পড়ুন। আপনারা সকলে খেলে আমাদের এখানে আসা সার্থক হবে।’’
যযাতিদা বললেন, ‘‘আমরা বরং রাস্তায় কিছু খেয়ে নেব।’’
অগত্যা ক্লাবের সকলে খেতে বসল। একটু কম হলেও বেশ তৃপ্তির সঙ্গেই খেল সবাই। এমনকী, ভাত কিছুটা বেঁচেও গেল। ঠিক এই সময়েই ঘটল আরেকটি ঘটনা। আরও জনা দশেক গ্রামবাসী এসে হাজির। তারা কাদের মুখে যেন এখানে খাওয়াদাওয়ার আয়োজনের কথা শুনেছে। তাই চলে এসেছে। অর্থাৎ, লোকমুখে এই খাওয়াদাওয়ার খবর রাষ্ট্র হয়ে গিয়েছে!
ক্লাবের ছেলেরা তাদের পরিষ্কার জানিয়ে দিল, ‘‘খাবার শেষ হয়ে গেছে। আর হবে না।’’
কিন্তু, ঝুড়িতে যে ভাত আছে, তা তাদেরই একজন দেখে ফেলেছে। সে বলল, ‘‘ওই তো ভাত আছে!’’
ক্লাবের একটি ছেলে বলল, ‘‘আছে তো। কিন্তু, খাবে কী দিয়ে?’’
আরেকজন জানতে চাইল, ‘‘হাঁড়িতে মাংস নেই?’’
ক্লাবের ছেলেটি উত্তর দিল, ‘‘এতক্ষণ পর মাংস থাকে? —না, নেই।’’
সে করুণ গলায় ফের জিজ্ঞাসা করল, ‘‘একটুও নেই?’’
বিস্ময়ের সঙ্গে তাদের কথা শুনছিল কুশল। খুব খারাপ লাগল তার।
ছেলেটি বলল, ‘‘না। —বিশ্বাস না হলে গিয়ে দেখো।’’
সে সত্যিই হাঁড়ির কাছে চলে গেল। গিয়ে দেখে বলল, ‘‘ঝোল আছে। আমাদের তাতেই হয়ে যাবে। দেবে?’’
ক্লাবের সেক্রেটারি ততক্ষণে তাদের কাছে এসে হাজির। তিনি বললেন, ‘‘খেতে পারলে খেয়ে নাও।’’
তারা ঝুড়ি থেকে ভাত আর হাঁড়ি থেকে ঝোল নিয়ে খেতে বসে গেল।
দৃশ্যটায় চোখ আটকে গেল কুশলের। তার চোখ দিয়ে জল এসে গেল। চুপ করে একধারে দাঁড়িয়ে তাদের খাওয়া দেখতে লাগল।
ব্যাপারটা চোখ এড়াল না যযাতিদার। তিনি এসে কুশলের পাশে দাঁড়ালেন। জানতে চাইলেন, ‘‘কী দেখছিস?’’
কুশল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাঙা গলায় বলল, ‘‘দ্যাখো যযাতিদা, কতদূর থেকে খাবারের খবর পেয়ে ওরা ছুটে এসেছে! খাবার শেষ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু, উচ্ছিষ্ট যা পড়ে আছে, তা–ই কেমন তৃপ্তির সঙ্গে খাচ্ছে!’’
যযাতিদা হাসলেন। গভীর গলায় বললেন, ‘‘হ্যাঁ, এটাই ভারতবর্ষ।’’ একটু থেমে ফের বললেন, ‘‘এরই নাম ভারতবর্ষ! আমাদের ভারতবর্ষ।’’
কুশল আর কোনও কথা বলল না।
যযাতিদা বললেন, ‘‘এমন মানুষ আমাদের দেশে কত আছে জানিস?’’
তাঁর প্রশ্নের জবাব দিল না কুশল। বলল, ‘‘অথচ আমাদের দেশ পরমাণু শক্তিধর। আমাদের দেশ মহাকাশে উপগ্রহ পাঠায়, মানুষ পাঠায়! রাস্তায় দামি গাড়ি ছোটে! এ দেশেরই মানুষ শপিং মলে কেনাকাটা করে, মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমা দেখে!’’
কুশলের কথার প্রেক্ষিতে যযাতিদা চট করে কোনও কথা বলতে পারলেন না। তাকে নিয়ে বাড়ির ভিতরে চলে এলেন।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে সে বলল, ‘‘আর, এই মানুষগুলো দেখো—!’’ একটু চুপ থেকে সে প্রশ্ন করল, ‘‘কিন্তু, কেন যযাতিদা?’’
যযাতিদা বললেন, ‘‘এই কেন–র উত্তরই তো তোর–আমার মতো মানুষ খুঁজে যায়!’’ একটু হেসে ফের বললেন, ‘‘কিন্তু, সমস্যাটা কী জানিস? আমাদের সারাজীবন কেটে যায় এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই। উত্তর আর মেলে না!’’
কুশলের চোখ ঘন হয়ে আসে। কোনও কথা বলতে পারে না।
যযাতিদা বললেন, ‘‘অথচ, আমাদের সমাজের ট্রাজেডি হল, যারা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে সত্যিই কাজ হত, তাদের কিন্তু তা নিয়ে ভাবার মতো সময় হয় না।’’ চুপ করে যান তিনি।
কোনও কথা বলে না কুশলও।
কিন্তু পরমদার কথায় সকলের ঘোর ভাঙে। তিনি বললেন, ‘‘যযাতি, চলো এবার ফেরা যাক।’’
যযাতিদা বললেন, ‘‘হ্যাঁ, তাই চলো।’’ একটু থেমে বললেন, ‘‘ক্লাবের সবাই চলে গেছে?’’
পরমবাবু বললেন, ‘‘হ্যাঁ। এমন কী, ঠাকুররাও চলে গেছে।’’
যযাতিদা বললেন, ‘‘তা হলে চলো ফেরাই যাক এবার।’’ তার পর কুশলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘তোর খুব খিদে পেয়েছে, তাই না রে?’’
কুশল হাসিমুখে মাথা নেড়ে বলে, ‘‘নো প্রবলেম। চলো, আমরা বের হই।’’
যযাতিদা বললেন, ‘‘হ্যাঁ, তাই চলো। আর, রাস্তায় কিছু খেয়ে নেওয়া যাবে।’’
ক্লাবের সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তারা পরমদার গাড়িতে উঠে বসল। (ক্রমশ)