স্বপ্ন শূন্যতা এবং
(পর্ব ০৬)
উপমন্যু রায়
ছয়
সুজনদার প্রেসের প্রুফ দেখার কাজটা ছেড়ে দেওয়ার পর কুশলের বেশ কিছুটা সময় উদ্বৃত্ত ছিল। এই সময়টা যদি অন্য কোনও কাজ করা যায়, সে কথাই ক’দিন ধরে ভাবছিল। শেষে একটা সুযোগ এসে গেল। কার্তিক বসু স্ট্রিটে অঞ্জনদার প্রেস। সেখানেই সুযোগটা জুটল।
সুজনদার প্রেসের এক স্টাফ তাকে অঞ্জনদার কাছে যেতে বলে। সুজনদা তাকে অপমান করার পর সেই স্টাফ কয়েকদিন আগে তাকে ফোন করে। সুজনদার আচরণ কথা শুনে ক্ষুব্ধ হয় সে। তাঁর নিন্দা করে সে জানায়, সুজনদা নাকি এমন আচরণ এর আগেও অনেকের সঙ্গে করেছেন! কথা প্রসঙ্গে সে এই প্রেসের কথা বলে।
সেখানে গিয়ে কথা চূড়ান্ত করে ফেলল কুশল। কিছু কাজও নিয়ে নিল। কয়েকদিনের মধ্যেই কাজটা করে দিয়ে যাবে। সপ্তাহ শেষে পেমেন্ট পাওয়া যাবে। এই কাজটা তার প্রয়োজন ছিল। ভালোই লাগল। সুজনদার প্রেসের স্টাফকে মোবাইলে ফোন করে কাজটার কথা জানাল। ধন্যবাদও দিল।
প্রেসের সামনেই আমহার্স্ট স্ট্রিট। ওয়ান ওয়ে বলে এই রাস্তা দিয়ে বাস যাবে না। বাস ধরতে গেলে কলেজ স্ট্রিট যেতে হবে। অবশ্য আসার পথে বাসেই এসে নেমেছিল এই রাস্তার পোস্ট অফিস স্টপে। তাই হাঁটতেই লাগল।
সেন্ট পলস স্কুলের সামনে দেখা হয়ে গেল রণজয়ের সঙ্গে। বিশ্ববিদ্যালয়ে তার সঙ্গেই পড়ত। থাকে আগরপাড়ায়। স্কুলে পড়ায়। কুশলের সঙ্গে দেখা হতেই হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করল, ‘‘কী খবর কুশল? কেমন আছিস?’’
সত্যি, কতদিন পর দেখা! কুশলও হেসে বলে, ‘‘ভালো। তুইও নিশ্চয় ভালো আছিস?’’
রণজয় হাসিমুখে বলে, ‘‘হ্যাঁ।’’ একটু থেমে বলে, ‘‘তার পর? কবিতা লিখিস এখনও?’’
চমকে উঠল কুশল। জিজ্ঞেস করল, ‘‘আমি আবার কবিতা লিখলাম কবে?’’
রণজয় বলে, ‘‘সে কী রে? সব ভুলে গেছিস? ইউনিভার্সিটির ম্যাগাজিনে লিখেছিলিস!’’
কুশল বলে, ‘‘দূর— সে তো ইচ্ছে হয়েছিল, তাই লিখেছিলাম। কিন্তু, কবিতা লেখা আমার হবিও ছিল না। বরং, উপন্যাস, গল্প বেশি পড়তাম। এখনও পড়ি।’’
বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে রণজয় বলে, ‘‘তোর কবিতায় দেশের রাজনীতির বীভৎস ছবি ফুটে উঠেছিল। বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল সেই কবিতাটা।’’
কুশল হাসল।
রণজয় বলল, ‘‘এখন না–হয় কবিতা লিখিস না। কিন্তু, দেশ থেকে রাজনীতি তো হারিয়ে যায়নি! দেখিস না নেতারা কী রকম দাপিয়ে বেড়ান দেশজুড়ে!’’
কুশল ফের হাসল। কিন্তু কিছু বলল না।
রণজয় কিন্তু থামল না। জিজ্ঞাসা করল, ‘‘কী ভাবছিস আজকের রাজনীতির চেহারা দেখে?’’
কুশল হেসে বলল, ‘‘কিছু না।’’
রণজয় বলল, ‘‘বলিস কী! —কিন্তু, কেন?’’
কুশল বলল, ‘‘আমার কাছে যাহা বাহান্ন, তাহাই তিপান্ন!’’
রণজয় হাসল। বলল, ‘‘বুঝেছি। তুইও অন্যদের মতো আধমরা হয়ে গেছিস!’’ তার পর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফের বলল, ‘‘হুম, তোদের ঘা মেরে বাঁচাতে হবে!’’
কুশল জিজ্ঞাসু চোখে তাকায় রণজয়ের দিকে।
রণজয় হেসে বলে, ‘‘জানিস বের্টোল্ট ব্রেখট কী বলেছিলেন? তিনি বলেছিলেন, এই অন্ধকার সময়ে কেউ কি আর গান গাইবে? হ্যাঁ গাইবে— অন্ধকার সময়ের গান। বুঝলি?’’
কুশল বলল, ‘‘বোধ হয় ঠিকই বলেছিলেন ব্রেখট।’’
রণজয় বলল, ‘‘বোধ হয় নয়, ঠিক বলেছিলেন তিনি।’’
কুশল ম্লান হেসে বলল, ‘‘হু।’’
রণজয় বলল, ‘‘হু নয়, হ্যাঁ। আসলে এখন এ দেশের মন্ত্রই হল, জোর যার, মুলুক তার। এ ভাবেই এখন চলছে। যার মানে, বাহুবল, অর্থবল এবং কৌশলই এখন এ দেশে সত্য। রাজনীতি থেকে সমাজ ও সংসার এমন মন্ত্রেই এখন চলছে।’’
এবার আর মুখে হাসি এলো না কুশলের। যাঁরা অবস্থাপন্ন, যাঁদের মাস গেলে আয় নিয়ে চিন্তিত হওয়ার নেই, একমাত্র তাঁরাই দেশের এই অবস্থার কথা আলোচনা করে আমোদ বোধ করবেন!
কুশলের গম্ভীর মুখ দেখে কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল রণজয়। সে–ও আর কথা বাড়াল না। বলল, ‘‘কী হল? চুপ করে গেলি!’’ একটু থেমে সে আবার বলল, ‘‘সিরিয়াস হয়ে গেলি নাকি? ওহো, তুই তো আবার কবিতা লিখতিস! সেই মনটা এখনও ধরে রেখেছিস? ভালো। ঠিক আছে, এ–সব নিয়ে আর আলোচনা করব না।’’ ফের থামল সে। তার পর বলল, ‘‘আচ্ছা, আজ চলি। আবার দেখা হবে।’’ বলেই হাঁটা দিল রণজয়।
তার দিকে চলে যাওয়া দেখল কুশল। তার পর সে–ও নিজের পথে চলতে শুরু করল।
কেশব সেন স্ট্রিটের ক্রশিং পার হয়ে ফুটপাথ ধরে হাঁটতে লাগল। কিছুটা পথ এগোতে না এগোতেই চমকে উঠল সে। একটা বাইক প্রায় তার পায়ের ওপর উঠে যাচ্ছিল। কোনও রকমে সরে গিয়ে নিজেকে বাঁচাল। আর একটু হলেই তাঁর হাঁটুতে লাগত। এমন দশাসই বাইকের ধাক্কা লাগলে তাঁর হাঁটুটাই হয়তো ভেঙে যেত! কিন্তু, বাইক আরোহীর সে দিকে ভ্রূক্ষেপই নেই। নিজের মেজাজে বাইকটাকে এ–দিক ও–দিক করতে করতে এগিয়ে গেল আরোহী।
মাথাটা চট করে গরম হয়ে গেল কুশলের। ক্ষুব্ধ চোখে তাকিয়ে রইল বাইক আরোহীর দিকে। ছেলেটি অবাঙালি। সে তখন এগিয়ে গিয়েছে অনেকটাই। রাস্তায় সিগন্যাল নেই বলে পরপর গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। বাইক আরোহীর অপেক্ষা করার সময় নেই। সে ফুটপাথেই বাইক তুলে নিয়ে এগিয়ে চলেছে। তা–ও নিজে হেঁটে বাইকটাকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে না! বাইকে বসে ফুটপাথ দিয়েই চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে! মগের মুলুক যেন। কেউ কিছু বলছেও না।সত্যিই, কলকাতাটা যেন কী হয়ে গেল! এই কাপুরুষ কলকাতা কেবল রাজনীতি বোঝে। আর কিছু বোঝে না আজ। ফের হঁাটতে লাগল কুশল।
হিন্দু একাডেমি স্কুল পার হওয়ার পর ক্রিকেটার কার্তিক বসুর বাড়ি। তার পরই ফুটপাথ দিয়ে হাঁটা মুশকিল হয়ে গেল। ফুটপাথের বেশ কিছুটা জায়গা দখল করে ফেলেছে একটি বিহারি পরিবার। কোনও রকমে তাদের জায়গা পার হল কুশল। তার পর একটা ফাস্টফুডের দোকান। দেখল সেটাও দোকানের সীমা ছাড়িয়ে ফুটপাথের কিছুটা জায়গা দখল করে নিয়েছে।
তার পর পঞ্চানন ঘোষ লেনের মুখ পার হয়ে রাস্তায় নামতে হল। ফুটপাথের মুখ জুড়ে টয়লেট। তার গায়ে লাগানো একটা গুমটি। সেখানে কী হয় কে জানে! মাঝে একবার চা বানাতে দেখেছিল একটা লোককে। হয়তো চায়েরই দোকান।
রাস্তার ধার দিয়েও যাওয়ার উপায় নেই! বেশ কয়েকটা গাড়ি দাঁড় করানো। তার একটা আবার পুলিশ ভ্যান। তার পরই আমহার্স্ট স্ট্রিট থানার গেট। থানার সামনেই কী করে একটা ফুটপাথ এ ভাবে অকেজো হয়ে যায় কে বলবে!
থানার পর ফুটপাথের কিছুটা পথ আবার দখল হয়ে গিয়েছে। সেখানে আবার বাসা তৈরি করেছে একটি বিহারি পরিবার। তার পর সিটি কলেজের বাসস্টপ।
এ ছাড়া বাকি ফুটপাথ মোটামুটি ভালো। সমস্যা বাঁধল থানার ফুটপাথ ছেড়ে বিদ্যাসাগর স্ট্রিটের গলি পেরিয়ে হৃষিকেশ পার্কের ফুটপাথে উঠতে যেতেই। পুরো ফুটপাথই দখল হয়ে গিয়েছে। ত্রিপল আর বাঁশ দিয়ে প্রায় স্থায়ী ঘরই বানিয়ে ফেলেছে ফুটপাথবাসীরা। রীতিমতো সংসার সাজিয়ে বসেছে! ফলে রাস্তায় নামতে হল কুশলকে।
রাস্তার ধারেও পুরসভার জিনিসপত্র। ফলে অনেক কষ্টে রাস্তা ধরেই হাঁটতে থাকল সে। সকাল নটা থেকে রাত নটা পর্যন্ত আমহার্স্ট স্ট্রিট ওয়ান ওয়ে থাকে। আর রাত নটার পর ডবল ওয়ে হলেও তখন বেপরোয়া গতিতে গাড়ি যায়। ফলে রাস্তা দিয়ে চলাফেরা করাই বিপজ্জনক। কিন্তু কে বুঝতে চাইবে এ কথা?
যত নষ্টের গোড়া ওই ফুটপাথবাসীরা! হঠাৎই মনে হল কুশলের। তার এই মনে হওয়ায় অনেকেই তাকে স্বার্থপর ভাবতে পারেন। কিন্তু, আসল সত্যিটা সে জানে। তাই সে এ–ভাবেই ভাবে।
সে জানে, এই ফুটপাথবাসীরা প্রকৃত ফুটপাথবাসী নয়। সুকিয়া স্ট্রিটে তার এক বন্ধু থাকে। সেখানেই ওই বন্ধুর সঙ্গে একবার আড্ডা দেওয়ার সময় এই ফুটপাথবাসী এক মহিলাকে দেখেছিল সে। মহিলাটি বন্ধুটির পরিচিত। মহিলাটি ট্রেন ধরতে তখন শিয়ালদা যাচ্ছিল।
আসলে সেই মহিলা থাকত দক্ষিণ ২৪ পরগনার কোনও এক গ্রামে। সকালে চলে আসত এখানে। সারাদিন লুকিয়ে চোলাই বিক্রি করত। এখানকার কালোয়ারদের মালবাহক কুলি–মজুর–সহ লরির ড্রাইভার, হেল্পাররা সেই চোলাই খেত। এই মহিলা একা নয়, তার আরও অনেক সঙ্গী আছে। তারাও একই কাজ করত।
পরে একদিন দেখে, সেই মহিলারাই ফুটপাথে শোওয়া–বসা করছে। তার পর তো ধীরে ধীরে ঝুপড়ির মতোই প্রায় বানিয়ে ফেলেছে। ক’দিন পর নিশ্চয়ই স্থায়ী ঘর বানিয়ে ফেলবে। মগের মুলুক আর কাকে বলে!
অথচ সামনেই আমহার্স্ট স্ট্রিট থানা!
পরে যখন সরকারের টনক নড়বে, তখন এই ফুটপাথবাসীরাই নিজেদের অসহায়তার কথা তুলে ধরে সকলের সিমপ্যাথি চাইবে। কিছু তথাকথিত মানবাধিকার সংগঠনও চলে আসবে। সুযোগসন্ধানী স্বঘোষিত সমাজকর্মী নামধারী কিছু ব্যক্তিও মিডিয়ার প্রচার পেতে ওই ফুটপাথবাসীদের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বেন।
মিডিয়ায়ও প্রচার হবে। রাজনৈতিক দলগুলিও সত্য প্রকাশের ঝুঁকি নেবে না। রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে তাদের পাশেই দঁাড়াবে। তাই সরকারও কোনও ঝুঁকি নেবে না। বিরক্ত লাগে কুশলের। এটা একটা দেশ?
সত্যিই, দেশটা যে কী হয়ে গেছে! নিয়ম না মানাটাই এখানে নিয়ম। যে যা পারছে, করছে। কোনও নিয়মনীতি বা নৈতিকতার ধারও ধারে না কেউ। দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে কুশলের। কে বলে এই দেশ মহান? একেবারে মিথ্যে কথা। মনে হয় এই দেশে জন্মানোটাই মহাপাপ! অন্তত সাধারণ, সহজ–সরল মানুষের তো বটেই।
সুকিয়া স্ট্রিটের মোড় পার হওয়ার পর কিছুটা পথ শান্তিতেই হাঁটা গেল। তার পর সত্যিই মগেদের রাজত্ব। ফুটপাথে লোহালক্কর। রাস্তার ধারে হয় লরি, ম্যাটাডোর বা ঠেলা। বাকি অংশ গাড়ির জন্য। মানুষ যাবে কোন পথে? কে দেবে এই প্রশ্নের উত্তর? লোহালক্করের মালিকরা? থানার বড়বাবু? নাকি প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলগুলি?
বিবেকানন্দ রোডে পৌঁছনোর পর কিছুটা পথ এগিয়ে তবেই মুক্ত ফুটপাথ পেল কুশল।
কিন্তু কয়েক পা এগোতেই পকেটের মোবাইল বেজে উঠল। দেখল সংযুক্তা বউদির ফোন। সুইচ টিপতেই কানে এলো, ‘‘তুই কোথায় রে কুশল?’’
কুশল হেসে বলল, ‘‘রাস্তায়।’’
বিরক্ত হলেন সংযুক্তা বউদি। বললেন, ‘‘ধ্যেৎ, ঠিক করে বল।’’
কুশল বলল, ‘‘সত্যিই বলছি বউদি।’’
সংযুক্তা বউদি বললেন, ‘‘মারব ঠাস করে এক চড়।’’ কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বললেন, ‘‘তুই এখন ফ্রি আছিস কিনা জানতে চাইছি।’’
কুশল মাথা নেড়ে বলল, ‘‘তা আছি।’’
বউদি বললেন, ‘‘আসতে পারবি?’’
কুশল হেসে বলল, ‘‘পারব।’’
বউদি জানতে চাইলেন, ‘‘কতক্ষণে আসবি?’’কুশল বলল, ‘‘এখনই আসছি।’’
বউদি বললেন, ‘‘তা হলে চলে আয়।’’ ফোন কেটে দিলেন তিনি।
কুশল বলল বটে এখনই আসছি। কিন্তু, এ–গলি সে–গলি অতিক্রম করে সংযুক্তা বউদির অ্যাপার্টমেন্টের কাছে পৌঁছতে তার মিনিট দশেক সময় লেগে গেল। কিন্তু, অ্যাপার্টমেন্টে ঢোকা হল না তার। দেখল, বউদিই ফুটপাথে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।
কুশলকে দেখেই রেগে গেলেন তিনি। বললেন, ‘‘এই তোর এখনই!’’
কুশল হেসে বলল, ‘‘আরে বাবা, এখনই মানে কি ঘড়ির কাঁটা ধরে হিসেব করছ নাকি? হেঁটে এলাম তো! কোথাও দাঁড়াইনি। একটু তো সময় লাগবে!’’
সংযুক্তা বউদি বললেন, ‘‘ব্যস, আর কথা বলতে হবে না। চল।’’
সংযুক্তা বউদির সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে কুশল জানতে চাইল, ‘‘কোথায় যাচ্ছি আমরা?’’
সংযুক্তা বউদি হেসে বললেন, ‘‘একটু কেনাকাটা করব। তার পর খাব। হাতিবাগানে একটা ভালো বিদেশি রেস্টুরেন্ট শাখা খুলেছে!’’
কুশল বলল, ‘‘বাহ্, ভালোই হবে! চলো।’’
দু’জনেই হাঁটতে লাগল। হাঁটতে হাঁটতে সংযুক্তা বউদি জানতে চাইলেন, ‘‘এখন কী পড়ছিস?’’
কুশল বলে, ‘‘লোটাকম্বল।’’
উচ্ছ্বসিত বউদি বললেন, ‘‘দারুণ বই। আগে পড়িসনি?’’
কুশল বলে, ‘‘না।’’
সংযুক্তা বউদি বললেন, ‘‘এই অসময়েও যে তুই এখনও বই পড়িস, সেইজন্যই তোকে আমার এত ভালো লাগে!’’
কুশল কোনও জবাব দেয় না।
সংযুক্তা বউদি আচমকা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘আচ্ছা, বল তো কুশল, পৃথিবীর বৃহত্তম উপন্যাসের নাম কী?’’
থমকে গেল কুশল। আমতা আমতা করে বলল, ‘‘জানি না তো!’’
সংযুক্তা বউদি হেসে বললেন, ‘‘এ–ভাবে বলছিস কেন? অনেকেই জানে না পৃথিবীর বৃহত্তম উপন্যাসের নাম।’’
কুশল হাসল।
সংযুক্তা বউদি হাসিমুখে বললেন, ‘‘উপন্যাসটির নাম ‘রিমেমব্রেনস অফ থিংস পাস্ট’। লেখকের নাম মার্সেল প্রুস্ত। এই উপন্যাসে ৯৬ লক্ষ ৯ হাজার অক্ষর আছে।’’
হাতিবাগান পৌঁছে প্রথমেই একটি মলে গেলেন সংযুক্তা বউদি। ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন জিনিসপত্র দেখতে লাগলেন। সঙ্গে অবশ্যই কুশল। সে–ও অনেক জিনিস দেখল। তবে কিনল না। বউদি ঘরের বেশ কয়েকটা টুকিটাকি জিনিস কিনে নিলেন।
সেখান থেকে বেরিয়ে কাছেই একটি রেস্তোরাঁয় কুশলকে নিয়ে গেলেন তিনি। এই রেস্তোরাঁটি আগে সিনেমা হল ছিল। উত্তর কলকাতার এই হাতিবাগানে আগে এমনই অনেক সিনেমা আর থিয়েটার হল ছিল। সব হলই উঠে গিয়েছে। কিছু হল হয়েছে ফ্ল্যাটবাড়ি, কিছু হয়েছে শপিং মল, আবার এটি হয়েছে একটি রেস্তোরাঁ।
সংযুক্তা বউদি কুশলকে নিয়ে কাউন্টারে গেলেন। দাম মিটিয়ে খাবার নিলেন। চিকেন স্ন্যাকার এবং হট উইংস। দু’জনের জন্য।
ভালো টেবিল দেখে কুশলকে নিয়ে বসলেন তিনি। কিন্তু, চেয়ারে বসার পর কুশল একটু উসখুশ করছিল। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ধমক দিলেন বউদি। বললেন, ‘‘বেশি জ্যাঠামো করিস না। সব আমি বুঝি।’’
কুশল হাসে।
সংযুক্তা বউদি চিকেন স্ন্যাকারে কামড় দিয়ে বললেন, ‘‘বুঝলি এটা খুব ভালো খাবার।’’
কুশলও খাবারের দিকে তাকাল। স্ন্যাকারের সঙ্গে রয়েছে সালাদ এবং থাউজ্যান্ড আইল্যান্ড সস। স্ন্যাকারে কামড় দিয়ে সে বলল, ‘‘হ্যাঁ, খুব ভালো খাবার এটা।’’
বউদি বললেন, ‘‘জানিস, এটা খুব উপাদেয়। প্রোটিনও আছে ১০৫.৩ গ্রাম আর মোট শক্তি আছে ২৫৭.৫ কিলোক্যালোরি। আলাদা ভাবে বললে, এখানে প্রোটিন আছে ১২.৬৮ গ্রাম, কার্বোহাইড্রেট ৩১.৬১ গ্রাম আর সোডিয়াম আছে ০.৫০ গ্রাম। এ ছাড়া ফ্যাট আছে ৮.৩৯ গ্রাম, মনাউনস্যাটুরাটেড ফ্যাটি অ্যাসিড আছে ৩.০৩ গ্রাম, পলিয়ানস্যাটুরাটেড ফ্যাটি অ্যাসিড ৩.১২ গ্রাম, স্যাটুরাটেড ফ্যাট ২.৭৮ গ্রাম, কিন্তু কোলেস্টেরল নেই।’’ হাসলেন তিনি।
চোখ বড় বড় করে কুশল বলে, ‘‘বাবা, তোমার সব মুখস্ত!’’
সংযুক্তা বউদি ফের হেসে বললেন, ‘‘এটার ব্যাপারও জানি।’’ বলেই হট উইংস দেখালেন কুশলকে। বললেন, ‘‘এটা দু’পিস আছে। এই দু’পিসের মধ্যে কী কী আছে, শুনবি?’’
কুশল বলল, ‘‘রক্ষে করো বউদি। ও–সব আমার মাথায় ঢুকবে না। তাই বলে লাভ নেই।’’
সংযুক্তা বউদি হেসে বললেন, ‘‘আসলে আমি এখানে তোর দাদার সঙ্গে অনেকবার এসেছি। এই খাবারগুলি খেয়েছি। আর—।’’ একটু থেমে ফের বললেন, ‘‘বারবার যে খাবার খেয়েছি, বা খাই, তার মধ্যে কী–কী আছে, তার খোঁজ তো নেওয়া উচিত, তাই না?’’
কুশলের চোখ চিকচিক করে উঠল। বলল, ‘‘সত্যিই বউদি, তোমার জবাব নেই!’’
চোখ পাকিয়ে সংযুক্তা বউদি বললেন, ‘‘ফের পাকামো!’’
হেসে মুখ নামিয়ে নিল কুশল। খাওয়ায় মন দিল।
কুশলকে দেখে হাসলেন সংযুক্তা বউদি। তিনিও খেতে লাগলেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই চিকেন স্ন্যাকার খাওয়া হয়ে গেল দু’জনের।
এবার পালা হট উইংসের। ভালোই খেতে। খাওয়ার ফাঁকে কুশল হেসে বলল, ‘‘বউদি, আমার খুব ইচ্ছে, একদিন তোমাকে খাওয়াব।’’
সংযুক্তা বউদিও হট উইংসে কামড় দিলেন। তার পর হাসিমুখে তাকালেন তার দিকে। বললেন, ‘‘তাই? বেশ তো। আগে তোর একটা ভালো কাজকর্ম হোক। তখন তোকে বলতে হবে না। আমিই খাওয়াবার কথা বলব।’’কুশল ম্লান হাসল। বলল, ‘‘বাবা!’’
সংযুক্তা বউদি ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করলেন, ‘‘কেন?’’
কুশল বলল, ‘‘গাছে কাঁঠাল, গোঁফে তেল!’’
সংযুক্তা বউদি চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘‘আবার—!’’
কুশল বলল, ‘‘আরে, আমি কবে ভালো কাজ জোগাড় করব, তার কি ঠিক আছে? এখন যা রোজগার করি, জানি তা খুব কম। তবু, একবার তো তোমাকে খাওয়াতেই পারি!’’
কুশল থামল। দেখল বউদি তাদের টেবিল থেকে অন্যদিকে তাকিয়ে। বোধ হয় কিছু দেখছেন। কিন্তু—।
ভালো করে লক্ষ্য করল কুশল। না, তিনি কিছু দেখছেন না। শূন্য চোখে চেয়ে আছেন।
রেস্তোরাঁর একধারের কাচ দিয়ে বাইরেটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। দেখেই অবাক হয়ে গেল সে। কখন যে বৃষ্টি নেমেছে, তা বুঝতেই পারেনি। বাইরে অঝোর ধারায় ঝরে চলেছে।
কিন্তু সংযুক্তা বউদি সে–সবও কিছু দেখছেন না। হঠাৎ তার মনে হল, হয়তো কিছু ভাবছেন। কিন্তু, কেউ যদি শূন্য চোখে কোথাও তাকিয়ে থাকে, সে কি কিছু ভাবতে পারে? কে জানে!
আচমকা কুশল চমকে গেল।
বউদি মায়াবী গলায় বললেন, ‘‘তোমার শরীর,
তাই নিয়ে এসেছিল একবার, —তার পর মানুষের ভিড়
রাত্রি আর দিন
তোমারে নিয়েছে ডেকে কোন দিকে জানিনি তা, —হয়েছে মলিন
চক্ষু এই, —ছিঁড়ে গেছি, —পৃথিবীর পথে হেঁটে–হেঁটে
কতো দিন–রাত্রি গেছে কেটে!
কতো দেহ এলো, —গেল, —হাত ছুঁয়ে–ছুঁয়ে
দিয়েছি ফিরায়ে সব, —সমুদ্রের জলে দেহ ধুয়ে
নক্ষত্রের তলে
বসে আছি, —সমুদ্রের জলে
নক্ষত্রের তলে
বসে আছি, —সমুদ্রের জলে
দেহ ধুয়ে নিয়া
তুমি কি আসিবে কাছে প্রিয়া!’’
সংযুক্তা বউদির কবিতা শুনে কয়েক মুহূর্তের জন্য আনমনা হয়ে গিয়েছিল কুশল। কিন্তু সংবিৎ ফিরতেই সে দেখে তার হাতটা সংযুক্তা বউদির মুঠোর মধ্যে ধরা। অদ্ভুত নরম আর কোমল সংযুক্তা বউদির হাত! তা ছাড়া, কী একটা যেন ওই হাতে আছে, যা হাতটাকে অন্য রকম করেছে। যেন যুগ–যুগ ধরে এমন হাতই সংসারের সমস্ত দুঃখ ও যন্ত্রণা দূরে সরিয়ে দিতে পারে।
— ‘‘জীবনানন্দ দাশ!’’ হাসিমুখে বলল কুশল।
আনমনা বউদি উত্তর দিলেন, ‘‘হুঁ। কবিতার নাম ১৩৩৩। কবিতাটা আছে ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ বইতে।’’
খুব ভালো লাগল কুশলের। কিন্তু, ভালো লাগাটা বেশি সময় থাকল না। সংযুক্তা বউদি বললেন, ‘‘কোল্ড কফি খাব। দাঁড়া নিয়ে আসি।’’
কুশল বলল, ‘‘দাঁড়াও, হট উইংসটা এখনও কিছুটা বাকি আছে। খেয়ে নিই।’’
সংযুক্তা বউদি হেসে বললেন, ‘‘আচ্ছা, সেই ভালো।’’
মিনিট কয়েকের মধ্যে দু’জনের হট উইংস শেষ হয়ে গেল। তার পরই সংযুক্তা বউদি কোল্ড কফি আনতে চলে গেলেন। সঙ্গে গেল কুশলও।
কফি নিয়ে ফিরে আসার পর দু’জনে বেশ জমিয়ে বসল।
বাইরে তখনও অবিরাম বৃষ্টি পড়ে চলেছে। ঝাপসা লাগছে চারদিক। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। তবে বেশ ভালো লাগছে কুশলের।
সে দিকে তাকিয়ে কফি পান করার পর হঠাৎই সংযুক্তা বউদি বললেন, ‘‘হ্যাঁ রে কুশল, তুই যখন ফুটফুটে সুন্দরী মেয়ে দেখে বিয়ে করবি, তখন আমাকে তোর মনে থাকবে?’’
সংযুক্তা বউদির কথায় চমকে উঠল কুশল। চট করে কোনও জবাব দিতে পারল না। কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে অবশেষে বলল, ‘‘ধ্যাৎ, কী যে বলো না! আমি কি বাচ্চা ছেলে?’’
এবার অবাক হলেন সংযুক্তা বউদি। হাসিমুখে বললেন, ‘‘এর সঙ্গে বাচ্চা ছেলে হওয়ার সম্পর্ক কী?’’
কুশল বলল, ‘‘ও–সব কথা তো বাচ্চাদের বলা হয়। ফুটফুটে একটা সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করবে!’’
সংযুক্তা বউদি ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন। কফিতে চুমুক দিয়ে হাসিমুখে বললেন, ‘‘তা না হয় হল! আচ্ছা, একটু পালটে বলছি। তোর মনের মতো মেয়েকেই বিয়ে করলি। তার পর?’’ একটু থেমে প্রশ্ন করলেন, ‘‘তার পর আমাকে তোর মনে থাকবে?’’
কুশল গম্ভীর হয়ে গেল। বলল, ‘‘দ্যাখো বউদি, আমি বাস্তবটা ভালো করেই বুঝি। এ–ও বুঝেছি, পৃথিবীতে সব কিছু সবার জন্য নয়।’’
কুশল থেমে গেল। কফিতে চুমুক দিল।
সংযুক্তা বউদিও কিছু বললেন না। চুপ করে কফি পান করতে লাগলেন।
বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। অথচ কাচ ভেদ করে বৃষ্টির শব্দ ভিতরে আসছে না।
কুশল বলল, ‘‘আমার মনে হয়, পৃথিবীর এই জুয়া খেলায় কাউকে না কাউকে হেরে যেতে হয়। আমি হয়তো সেই হেরে যাওয়াদের দলে। তাই আমাকে বেশি দূর ভাবতে নেই বউদি। আমি জানি।’’
সংযুক্তা বউদি হাসলেন। কুশলের মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘‘আমারই ভুল হয়েছে। তোর মতো অবস্থায় থাকলে আমিও হয়তো এই কথা বলতাম!’’
কুশল বলল, ‘‘না বউদি, কথাটা তা নয়। সত্যিটা তো আমার জীবন। আর, আমার জীবনকে তো আমি জানি। দেখছি প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে।’’ একটু থামল সে। ফের বলল, ‘‘একটা ব্যাপার এতদিনে আমি বুঝতে পেরে গিয়েছি। আসলে আমি এই পৃথিবীতে বড় বেমানান। প্রতিটা মুহূর্তে আমার অভিজ্ঞতা আমাকে এ কথাটাই জানান দিয়ে যায়। কিন্তু, কী করব বলো? পৃথিবীর আমাকে পছন্দ না হলেও আমার তো কিছু করার নেই! আমি তো ইচ্ছে করে এই পৃথিবীতে আসিনি! তাই আমার বুড়ো মা যতদিন আছেন, আমাকে একটা কিছু করে জীবনটাকে টেনে নিয়ে যেতে হবেই। আর—।’’চোখ বড় বড় করে সংযুক্তা বউদি বললেন, ‘‘মানে? কী বলছিস তুই?’’
হেসে কুশল বলে, ‘‘না, ভয় নেই। তবে—।’’ থেমে গেল সে।
সংযুক্তা বউদি কোনও কথা বললেন না।
একটু ভেবে কুশল বলল, ‘‘ভয় একটা আছেই। তা হল, মৃত্যুর ভয়। মৃত্যুকে আমি খুব ভয় পাই। তাই নিজে থেকে আমি মরতে পারব না। আমার দ্বারা আত্মহনন হবে না। নিশ্চিন্ত থাকো।’’
সংযুক্তা বউদি কফির কাপ টেবিলে রেখে দু’হাতের মুঠোয় কুশলের হাত ধরলেন। বললেন, ‘‘না কুশল, কখনও ও–ভাবে ভাববি না। বরং ভাববি, তুই আছিস তোর মতোই। তুই সে ভাবেই বেঁচে থাক। বুক ফুলিয়ে চলবি। আর, সেটাই তো জেতা। জীবনের কঠিন সময়কে হারিয়ে এগিয়ে চলতে পারাটাই তো জেতা!’’
কুশল ফ্যালফ্যাল করে সংযুক্তা বউদির দিকে তাকিয়ে থাকে।
বউদি বললেন, ‘‘তা ছাড়া আমি আর তোর যযাতিদা তো আছিই। আমরাই তোর সবচেয়ে কাছের মানুষ। বন্ধু। আত্মীয়। আর আমি তো তোর বিশেষ বন্ধু। বল, ঠিক না?’’ হাসলেন তিনি।
কুশল মাথা নাড়ে। তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।
বাইরে তখনও অবিশ্রান্ত বৃষ্টি পড়ে চলেছে। (ক্রমশ)