বিশেষ প্রতিবেদন,কলকাতা:চলে গেলেন বাস্তবধর্মী সিনেমা তৈরি করে এক সময় গোটা ভারতে সাড়া ফেলে দেওয়া কিংবদন্তি পরিচালক বাসু চট্টোপাধ্যায়।বৃহস্পতিবার মুম্বইয়ে তিনি প্রয়াত হন। বয়স হয়েছিল ৯৩ বছর। তাঁর মৃত্যুতে বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্র জগতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তাঁর পরিবার সূত্রে বলা হয়েছে, দীর্ঘদিন ধরেই তিনি বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন অমিতাভ বচ্চন, মিঠুন চক্রবর্তী, অমল পালেকর, মাধুরী দীক্ষিত, বিধু বিনোদ চোপড়া, সুভাষ ঘাই, অক্ষয় কুমার, অজয় দেবগন, কাজল, রানি মুখোপাধ্যায়, শাহরুখ খান, আমির খান, রণবীর সিং প্রমুখ অভিনেতা ও পরিচালকরা।
তঁার মৃত্যু সংবাদ প্রথম জানান ইন্ডিয়ান ফিল্ম অ্যান্ড টিভি ডিরেক্টর্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অশোক পণ্ডিত। বৃহস্পতিবার এক টুইট বার্তায় তিনি লেখেন, ‘দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি কিংবদন্তি পরিচালক বাসু চ্যাটার্জি আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন। দুপুর ২টো নাগাদ সান্তাক্রুজ শ্মশানে তঁার শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে। এটা আমাদের শিল্পের ক্ষেত্রে অনেক বড় ক্ষতি। আমরা আপনাকে মনে রাখব স্যর।’ চট্টোপাধ্যায় পরিবারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বৃহস্পতিবার দুপুরে সান্তাক্রুজ শ্মশানে তাঁর মরদেহ পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যায়।
প্রবাদপ্রতিম পরিচালকের তালিকায় বাসু চট্টোপাধ্যায়ের নাম ছিল প্রথমেই। বলিউডের অবাস্তব–বাণিজ্যিক সিনেমার জগতে বাস্তবতার নির্মোহ দণ্ড নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন তিনি। বাস্তবকে অসম্ভব দক্ষতার সঙ্গে রুপোলি পর্দায় তুলে ধরেছিলেন। স্বভাবতই তাঁর তৈরি সিনেমা নিয়ে সমালোচক তথা সিনেমার সচেতন দর্শকদের মধ্যে তুমুল আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। সত্তরের দশকে ভিন্ন ধারার ছবি তৈরি করে বিশেষ খ্যাতি পেয়েছিলেন তিনি। তাঁর পরিচালিত বিভিন্ন সিনেমায় বিভিন্ন সময়ে অভিনয় করেছেন দেব আনন্দ, রাজেশ খান্না, অমিতাভ বচ্চন, মিঠুন চক্রবর্তী, অমল পালেকরের মতো বিখ্যাত অভিনেতারা।
সিনেমা তৈরির পাশাপাশি টেলিভিশনেও সিরিয়াল তৈরি করেছেন। তাঁর পরিচালনায় ‘ব্যোমকেশ বক্সী’ টেলিভিশনে দেখানো সিরিয়ালে বিপ্লব তৈরি করে দিয়েছিল। তঁার জন্ম ১৯২৭ সালের ১০ জানুয়ারি রাজস্থানের আজমেঢ়ে। তাঁর বাবা রেলে কর্মরত ছিলেন। ফলে বদলি হয়ে তাঁর বাবাকে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় থাকতে হত। তাই ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মানুষের জীবন দেখার সুযোগ হয়েছিল বাসু চট্টোপাধ্যায়ের। কিন্তু বাংলার বাইরে থাকলেও তিনি কখনও বাঙালি শিকড়কে ভুলে যাননি।
তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়েছিল অঙ্কনশিল্পী ও কার্টুনিস্ট হিসাবে। তখন মুম্বই থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ট্যাবলয়েড ‘ব্লিটজ’–এ কাজ করতেন। সিনেমায় তাঁর প্রবেশ সহকারী পরিচালক হিসেবে। রাজ কাপুর ও ওয়াহিদা রহমান অভিনীত ‘তিসরি কসম’ সিনেমায় তিনি বাসু ভট্টাচার্যের সহকারী হিসাবে কাজ করেন। তার পর নিজেই সিনেমা পরিচালনা করতে শুরু করেন। তাঁর পরিচালিত প্রথম সিনেমা ‘সারা আকাশ’। সিনেমাটি মুক্তি পায় ১৯৬৯ সালে।
তাঁর পরিচালিত হিন্দি সিনেমাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ছোটি সি বাত, রজনীগন্ধা, এক রুকা হুয়া ফয়সলা, বাতো বাতো মে, জিনা ইহা, আপনে পেয়ারে, পিয়া কে ঘর, খাট্টা মিঠা, চক্রব্যুহ, চিতচোর, মঞ্জিল, শৌকিন, পসন্দ আপনা আপনা, দুর্গা, চামেলি কি শাদি প্রভৃতি। তাঁর পরিচালিত ‘দুর্গা’ সিনেমাটি অসম্ভব প্রশংসিত হয়েছিল। এই সিনেমা পরিচালনার জন্য ১৯৯২ সালে তিনি জাতীয় পুরস্কার পান। এ ছাড়া তাঁর তৈরি ‘এক রুকা হুয়া ফয়সলা’ সিনেমাটি নিয়ে এখনও সমালোচকদের মধ্যে আলোচনা হয়ে থাকে।
মিডল অফ দ্য রোড সিনেমায় তিনিই ছিলেন পথপ্রদর্শক। একটা সময় ছিল, যখন বাসু চট্টোপাধ্যায়, বাসু ভট্টাচার্য এবং হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় মুম্বইয়ে হিন্দি সিনেমা জগতকে দাপটের সঙ্গে শাসন করেছেন। তখন হিন্দি সিনেমা মানেই একসঙ্গে উচ্চারিত হত বহু বাঙালির নাম। তাঁদের মধ্যে এই তিন পরিচালক একটা আলাদা সমীহ আদায় করে নিয়েছিলেন। একের পর এক হিট ছবি উপহার দিয়ে গিয়েছেন তাঁরা।
কয়েকটি বাংলা সিনেমাও পরিচালনা করেছেন বাসু চট্টোপাধ্যায়। তাঁর পরিচালিত হঠাৎ বৃষ্টি, চুপিচুপি, হচ্ছেটা কী সিনেমা তিনটি দর্শকদের মন জয় করে নিয়েছিল। সিনেমাগুলির মধ্যে ‘হঠাৎ বৃষ্টি’ তৈরি হয়েছিল ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনায়। সিনেমাটিতে অভিনয় করেছিলেন বাংলাদেশের ফেরদৌস এবং ভারতের প্রিয়াঙ্কা ত্রিবেদী। ১৯৯৮ সালে মুক্তি পাওয়া এই সিনেমাটি ব্যাপক সাফল্য পেয়েছিল।
উল্লেখ্য, এই সিনেমাটিই ছিল অভিনেতা ফেরদৌসের প্রথম সিনেমা। এ ছাড়া বাংলাদেশের ‘এক কাপ চা’ সিনেমার চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেছিলেন তিনি। এ ছাড়া দূরদর্শনের জন্য ২টি সিরিয়াল পরিচালনা করেছিলেন। তার মধ্যে একটি ছিল অবশ্যই সাড়া জাগানো ‘ব্যোমকেশ বক্সী’। অন্যটি ‘রজনী’। দুটি সিরিয়ালই দর্শকদের কাছে দারুণ সমাদর পেয়েছিল।