স্পোর্টস ডেস্ক: বিশ্বকাপ জিতবে কে? বাজি ধরবেন? উত্তর নিশ্চয়ই ‘না’। কারণ, ক্রিকেট নিয়ে বাজি ধরা বোকামি। ক্রিকেট যে অনিশ্চয়তার খেলা! বাংলাদেশ নিয়ে? তা তো আরো ঝুঁকিপূর্ণ। ধারাবাহিকতা নেই- এমন র্যাংকিং করলে বাংলাদেশ হয়তো শীর্ষের দিকেই থাকবে। তার চেয়ে মাঠে চোখ রাখাই ভালো। কে চ্যাম্পিয়ন হয় আর বাংলাদেশ কোন পর্যন্ত যায় তাতো দেখাই যাবে।
বাংলাদেশ কি করবে এই বিশ্বকাপে? কোটি টাকার প্রশ্ন! দেখতে দেখতে ৬ বিশ্বকাপ খেলে সপ্তমটিতে মাঠে নামার অপেক্ষায়। ১৯৯৯ থেকে ২০১৯ সাল- এই ২০ বছরে হওয়া ৬ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের অর্জন কি? যা নিয়ে বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়া, কিংবা ফাইনাল খেলার স্বপ্ন দেখা যায়। এমনকি সেমিফাইনালের আশাও জাগতে পারে। তারপরও স্বপ্নতো দেখতেই হবে।
স্বপ্নের কথাটি প্রথম আসা উচিত হেড অব টিম থেকে। কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে তো স্বপ্ন দেখাকেও স্বপ্ন মনে করেছিলেন। যদিও আফগানিস্তানের বিপক্ষ্যে ম্যাচ দিয়ে বিশ্বকাপ শুরুর আগের দিন তিনি নিজেই একটা স্বপ্নের কথা বলেছেন। সেই স্বপ্ন শেষ চারে যাওয়ার। মানে সেমিফাইনাল।
আমি বলবো ‘পারফেক্ট স্বপ্ন।’ বাংলাদেশের আসলে সেমিফাইনালকেই ‘পাখির চোখ’ করে ম্যাচ বাই ম্যাচ খেলা উচিত। সেমিফাইনাল নিশ্চিত হলে এরপর অনেক কিছুই ঘটতে পারে। কারণ, ক্রিকেট যে অনিশ্চয়তার খেলা!
এক-দুই-তিন করে করে সাতে পা দিয়েছে বাংলাদেশ। বৃহস্পতিবার ভারতে শুরু হওয়া আইসিসি ওয়ানডে ক্রিকেট বিশ্বকাপ বাংলাদেশের সপ্তম। অথচ মনে হবে এই তো সেদিন বাংলাদেশ প্রথম বিশ্বকাপ খেললো ইংল্যান্ডে। বছরের হিসেবে ২৪। সবার প্রত্যাশা এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশ পারফরম্যান্স অতীতের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে যাক। ‘লাকি সেভেন’ হয়ে উঠুক সপ্তম অংশগ্রহণ।
আগের পারফরম্যান্সের রেকর্ড বলতে একটা সংখ্যা যেন আঠার মতো লেগে আছে বাংলাদেশের গায়ে। তা হলো ৩। টানা চারটি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ তিনটি করে ম্যাচ জিতেছে। এবার জয়টা যদি ৪ হয়? তাহলে অনেকেই বলবেন পারফরম্যান্সের উন্নতি হয়েছে। হ্যাঁ, চতুর্থ জয়ে বাংলাদেশের যদি সেমিফাইনাল নিশ্চিত হয় সেটা হবে দারুণ ব্যাপার। তখন বলা যাবে উন্নতি। গত বিশ্বকাপে ৫টি জয় নিয়েও বিদায় নিয়েছিল পাকিস্তান। তাই সেমির মঞ্চে উঠতে হলে হয়তো গোটা ছয়েক জয় লাগবেই।
বিশ্বকাপ। ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় ও মর্যাদার টুর্নামেন্ট। অথচ এই টুর্নামেন্টেরই কোনো নির্ধারিত ফরম্যাট নেই। কখনো ১২ দেশ নিয়ে। কখনো ১৪ দেশ নিয়ে, আবার কখনো ১৬ দেশ নিয়ে আয়োজন। এ নিয়ে টানা দুই আসর ১০ দেশ নিয়ে। লিগ ভিত্তিক খেলা। বিষয়টা এমন যে, যেহেতু বিশ্বকাপ- তাই সবার সঙ্গে সবার শক্তি পরীক্ষা না করলে কি হয়?
সেটা ভিন্ন বিষয়। আয়োজকদের খেয়ালখুশি। পথ যেভাবেই ঘুরিয়ে নির্ধারণ করুক, লক্ষ্য একটাই ট্রফি। বাংলাদেশের কি ওই ট্রফিতে নজর দেওয়ার সময় এখনো হয়নি? ১৯৯৯ ও ২০০৩ সালের দুই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স ছিল মিশ্র। প্রথম আসরে দুটি জয়। যার একটি পাকিস্তানের মতো দলের বিপক্ষে। পরের বিশ্বকাপে জয়হীন। কানাডা-কেনিয়ার মতো দেশের কাছে হার। বিশ্বকাপের নবীন দেশ হিসেবে ওই দুই আসরের ফলাফলকে হয়তো অনেকেই ধর্তব্যের মধ্যে আনেন না। পরের চার আসরে কি করলো বাংলাদেশ? সেখানেই বড় প্রশ্ন।
৬ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ খেলেছে ৪২ ম্যাচ। জয় মাত্র ১৪টি। ২৫ হার। তিন ম্যাচের নো-রেজাল্ট। পারফরম্যান্স অবশ্যই ঝকঝকে নয়। ২০০৭ সালে সুপার এইট আর ২০১৫ সালে কোয়ার্টার ফাইনাল- বাংলাদেশের সেরা সাফল্য বলতে এতটুকুই। অথচ এই বাংলাদেশই ১৯৯৯ সালে অভিষেক আসরে পাকিস্তনের মতো দেশকে হারিয়ে ক্রিকেট বিশ্বকে চমকে দিয়েছিল।
বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পারফম্যান্স কেমন? চোখ বোলানো যাক আগের ৬ আসরে। আইসিসি চ্যাম্পিয়ন হয়ে ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে প্রথম অংশ নেয় বাংলাদেশ। ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস ও ওয়েলসে হওয়া ওই বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ছিল ‘বি’ গ্রুপে।
নিউজিল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে হারের পর বাংলাদেশের ঐতিহাসিক জয় স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে। মিনহাজুল আবেদীন নান্নুর হার না মানা ৬৮ রান আর হাসিবুল হোসেন শান্তর ২৬ রানে ২ উইকেট বাংলাদেশকে এনে দিয়েছে ২২ রানে বিশ্বকাপের প্রথম জয়টি। পরের ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে গ্রুপের শেষ ম্যাচে বাংলাদেশ মুখোমুখি হয়েছিল পাকিস্তানের। আকরাম খান ও খালেদ মাহমুদ সুজনরা হাসিয়েছিলেন দেশকে। ২২৩ রানের পূঁজি নিয়েও পাকিস্তানকে হারিয়েছিল ৬২ রানে।
বিশ্বকাপে এমন এক সূচনার পর পরের আসরে বাংলাদেশের যে পারফরম্যান্স ছিল তা সবাই ভুলে যেতেই চাইবেন। দক্ষিণ আফ্রিকা, কেনিয়া ও জিম্বাবুয়েতে হওয়া ২০০৩ সালের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ৬ ম্যাচ খেলে পাঁচটিতেই হেরেছে। একটি ম্যাচ (ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে) বৃষ্টিতে পরিত্যক্ত হওয়ায় পয়েন্ট ভাগাভাগি হয়েছে।
২০০৩ সালের বিশ্বকাপের শুরুটাই ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। ডারবানে কানাডার কাছে ৬০ রানে হেরে দেশের মানুষকে বিস্মিত করেছিলেন ক্রিকেটাররা। কানাডার ১৮০ রানের জবাবে বাংলাদেশ ২৮ ওভারে অলআউট হয়েছিল ১২০ রানে।
পরের ম্যাচে শ্রীলংকার বিপক্ষে উড়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ। চামিন্দা ভাসের বোলিং আগুনে ছারখার হয়ে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের ব্যাটাররা। বাংলাদেশের ১২৪ রান টপকাতে কোনো উইকেটই হারাতে হয়নি লঙ্কানদের। শেষ তিন ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে ১০ উইকেটে, নিউজিল্যান্ডের কাছে ৭ উইকেটে ও কেনিয়ার কাছে ৩২ রানে হেরে ব্যর্থ মিশন শেষ করেছিল বাংলাদেশ।
ভারতকে ৫ উইকেটে হারিয়ে বৃষ্টি বিঘ্নিত পরের ম্যাচে শ্রীলংকার কাছে ১৯৮ রানে হারলেও গ্রুপের শেষ ম্যাচে (বৃষ্টি বিঘ্নিত) দূর্বল বারমুডাকে ৭ উইকেটে হারিয়ে ২০০৭ সালের বিশ্বকাপের সুপার এইটে জায়গা করে নিয়েছিল বাংলাদেশ।
সুপার এইটের ৭ ম্যাচের একটি মাত্র জিতেছিল বাংলাদেশ। মোহাম্মদ আশরাফুলের ৮৩ বলের ৮৭ রানের দুর্দান্ত ইনিংসের ওপর ভর করে বাংলাদেশ ৬৭ রানে হারিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকাকে। অন্য ৬ ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার কাছে ১০ উইকেটে, নিউজিল্যান্ডর কাছে ৯ উইকেটে, ইংল্যান্ডের কাছে ৪ উইকেটে, আয়ারল্যান্ডের কাছে ৭৪ রানে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে ৯৯ রানে এবং শ্রীলংকার কাছে ১৯৮ রানে হারে বাংলাদেশ।
২০০৭ বিশ্বকাপ থেকে যেন তিনটি জয় নির্ধারণ হয়ে হয়ে গেছে বাংলাদেশের জন্য। ২০১১ সালে ঘারের মাঠের বিশ্বকাপেও সেই তিন জয়ের বেড়াজালটা ছিড়তে পারেনি টাইগাররা। ৬ ম্যাচ খেলে তিনটি জিতেছে। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ২৭ রানে, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২ উইকেটে ও নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ৬ উইকেটে। হেরেছিল ভারতের কাছে ৮৭ রানে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৯ উইকেটে ও দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে ২০৬ রানে।
বাংলাদেশের কোয়ার্টার ফাইনাল খেলা বিশ্বকাপ ছিল ২০১৫ সালে। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে হওয়া ওই বিশ্বকাপ ছিল ১৪ দেশের। গ্রুপপর্বে বাংলাদেশ ৬ ম্যাচের তিনটি জিতে ২টিতে হেরেছিল। বাতিল হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচটি। বাংলাদেশ জিতেছিল আফগানিস্তানের বিপক্ষে ১০৫ রানে, স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ৬ উইকেটে ও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৫ রানে। হেরেছিল শ্রীলংকার কাছে ৯২ রানে ও নিউজিল্যান্ডের কাছে ৩ উইকেটে। কোয়ার্টার ফাইনালে ভারতের সামনে পড়েছিল বাংলাদেশ। ১০৯ রানের বড় ব্যবধানে হেরে বিদায় নেয় মাশরাফিরা।
অনেক বড় স্বপ্ন নিয়ে ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে অনুষ্ঠিত ২০১৯ সালের বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছিল টাইগাররা। ১০ দলের বিশ্বকাপ, সবার সঙ্গে খেলা। আগের ৩ বারের তিন জয়ের গিট্টুটা খুলে ৫ করতে পারলেই সেমিফাইনালের সম্ভাবনা। বাংলাদেশ আটকে থাকলো সেই তিনেই। ৩ জয় ও ৫ হারে ১০ দলের মধ্যে অষ্টম হয়ে ফেরা। অনেক আশার বিশ্বকাপ শেষ হলো হতাশা নিয়ে।
অথচ কি দুর্দান্ত শুরুটাই না ছিল বাংলাদেশের! দক্ষিণ আফ্রিকাকে ২১ রানে হারিয়ে বিশ্বকাপ শুরুর পর বাংলাদেশকে নিয়ে প্রত্যাশার পারদ ওপরে উঠেছিল তরতর করে। নিউজিল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের কাছে হারের পর শ্রীলংকার ম্যাচ বৃষ্টিতে বাতিল হলে বড় ধাক্কা আসে বাংলাদেশের সেমির স্বপ্নে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও আফগানিস্তানের বিপক্ষে জয়ে সম্ভাবনা জাগলেও শেষ দুই ম্যাচে ভারত ও পাকিস্তানের কাছে হারের পর বাংলাদেশের বিদায় নিশ্চিত হয়। মাঝে অস্ট্রেলিয়ার কাছেও হেরে যায় বাংলাদেশ।
এসব এখন অতীত। সামনে চোখ রেখেই বাংলাদেশ এবারের বিশ্বকাপ মিশন শুরুর অপেক্ষায় আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে। পথ অনেক লম্বা। ৯ টি ম্যাচ খেলতে হবে। এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের চাই শক্ত মনোবল।
আফগানিস্তানের বিপক্ষে জয় দিয়ে শুরু করতে পারলে সেই মনোবল বাড়বে নিশ্চয়ই। বিশ্বকাপে আফগানিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের রয়েছে শতভাগ জয়ের রেকর্ড। দুটি ম্যাচ খেলে দুটিতেই সহজ জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। আরেকটা দারুণ শুরুর অপেক্ষায়। যে শুরুটায় বাংলাদেশের জন্য অন্যরকম এক বিশ্বকাপ হতে পারে এবার।
কেবল তিন জয়ের বৃত্ত ভেঙ্গে নয়, বাংলাদেশ সাফল্য নিয়ে আসুক নিদেনপক্ষে সেমিফাইনাল খেলে। ক্রিকেট নিয়ে মানুষের প্রত্যাশা যে এখন আর ‘তিন জয়ে’ আটকে নেই।