নিজস্ব প্রতিবেদকঃ রাজধানীর কড়াইল বস্তিতে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির অবৈধ সংযোগ, আধিপত্য ধরে রাখতেই কুপিয়ে হত্যা করা হয় যুবলীগের কর্মী আল আমিন সরকারকে। বস্তির নুরুল আলমের অনুসারীরা এ হত্যাকাণ্ড ঘটান।
সম্প্রতি মামলার তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) মামলার প্রধান আসামি নুরুলকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে এসব তথ্য জানান।
পিবিআই জানায়, বস্তিকেন্দ্রিক আধিপত্য নিয়ে নুরুল বাহিনীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব রয়েছে জুয়েল সরকারের। ২০২২ সালের আগস্টে বস্তিতে আওয়ামী লীগের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে পরে ১৬ আগস্ট বনানী এলাকার কড়াইল বস্তিতে মসজিদে ঢুকে আল আমিনকে কুপিয়ে হত্যা করেন নুরুল বাহিনীর সদস্যরা। আল আমিন জুয়েল সরকারের ছোট ভাই।
এ ঘটনায় আল আমিনের বড় ভাই জুয়েল সরকার বনানী থানায় ২৩ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ২২ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। পরে আদালত অধিকতর তদন্তের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দেন।
পিবিআই সূত্রে জানা গেছে, এ হত্যাকাণ্ডের পর প্রায় দেড় বছর পালিয়ে থেকে গত ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩, আদালতে আত্মসমর্পণ করেন নুরুল। আদালতে আত্মসমর্পণ করার পর জামিন আবেদন করেন নুরুল। তবে আদালত তাঁর জামিন নাকচ করেন। পরে পিবিআই তাঁকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। এখন তিনি কারাগারে। মামলার বাকি ২২ আসামি জামিনে রয়েছেন।
মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, নুরুল কড়াইল বস্তির একটি ইউনিটের আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ছিলেন। ওই কমিটিতে সভাপতি প্রার্থী ছিলেন তিনি। তবে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) ১৯ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. মফিজুর রহমানের কারণে তিনি সভাপতি পদ পাননি। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে নুরুল ও তাঁর বাহিনী কাউন্সিলরের অনুসারী জুয়েল সরকার ও তাঁর ভাই আল আমিনের ওপর হামলা করেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পরিদর্শক মো. তৈয়ব রহমান বলেন, ‘রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে নুরুল জানিয়েছেন, কড়াইল বস্তিকেন্দ্রিক আধিপত্য বিস্তার, অবৈধ বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ এবং চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে তাঁর ৯ জনের একটি বাহিনী রয়েছে। তাঁর এ বাহিনী মাসে প্রায় চার লাখ টাকা তুলে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়। কিন্তু কমিটিতে জায়গা না পাওয়ায় তাঁর এই আধিপত্য চলে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। আধিপত্য ধরে রাখতেই তাঁরা আল আমিনকে খুন করেন।’
পিবিআই জানায়, কড়াইল বস্তিতে নুরুলের ১০টি ঘর রয়েছে। এ ছাড়া শতাধিক ঘরে তিনি অবৈধ বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ দিয়ে টাকা তোলেন। এই টাকার একটি ভাগ পান সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা। কর্মকর্তাদের টাকা দিয়ে ‘ম্যানেজ’ করার কাজটি করেন নুরুল।
তদন্তসংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, আল আমিন হত্যার পর মুঠোফোন ফেলে ঢাকার দোহারের নবাবগঞ্জের এক আত্মীয়ের বাসায় আত্মগোপন করেন নুরুল। সেখানে কয়েক দিন থাকার পর ওই এলাকার একটি মেসে ওঠেন। গত প্রায় দেড় বছর সেখানেই ছিলেন তিনি। এ সময় তিনি পরিবারের সঙ্গে বিভিন্ন মুঠোফোন অ্যাপে যোগাযোগ করতেন।
সুত্রে আরও জানা যায়, এভাবে পালিয়ে থাকায় বস্তিকেন্দ্রিক তাঁর যে উপার্জন ছিল, তা অনেকটাই বন্ধ হয়ে যায়। এতে পরিবার নিয়ে আর্থিক সংকটে পড়েন নুরুল। তাই সিদ্ধান্ত নেন আর না পালিয়ে থেকে আদালতের মাধ্যমে জামিন আবেদন করবেন। কিছুদিন কারাভোগের পর জামিন পেলে আবার বস্তিতে ফিরবেন।
এদিকে আল আমিনকে খুনের পর নুরুলের পিস্তলসহ একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদে নুরুল পিবিআইকে জানান, তিনি একসময় শর্টফিল্মে অভিনয় করতেন। সেই সময়ের একটি ছবি তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। নুরুল দাবি করেন, ছবিতে তাঁর সঙ্গে থাকা পিস্তলটি ছিল খেলনা।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পিস্তলসহ ছবির বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
আল আমিন হত্যাকাণ্ডের পর এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ জানিয়েছিল, গত ১০ বছরে কড়াইল বস্তিতে ৬টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এসব খুনের নেপথ্যে রয়েছে মাদকের ব্যবসা, বস্তির ঘরের ভাড়া ও অবৈধ গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির টাকা তোলা নিয়ে দ্বন্দ্বের জের। সবশেষ খুন হন যুবলীগ কর্মী আল আমিন। এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিরা ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের এক বড় নেতার অনুসারী।