ওয়েব ডেস্ক: ‘মেয়ের নাম মাসুদের সঙ্গে মিলিয়ে মাসুমা রাখতে চেয়েছিলাম। এখন কী হবে আমাদের? আমার আর মেয়ের দায়িত্ব কে নেবে?’ পাঁচ দিনের কন্যাসন্তানকে কোলে নিয়ে হাসপাতালের মর্গের বাইরে বেঞ্চে বসে কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন নিহত সাবেক ছাত্রলীগনেতা আবদুল্লাহ আল মাসুদের স্ত্রী মোসা. বিউটি আরা।
নিহত আবদুল্লাহ আল মাসুদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সাধারণ সম্পাদক। শনিবার (৭ সেপ্টেম্বর) নগরীর বিনোদপুরে মারধরের শিকার হন মাসুদ। পরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত সাড়ে ১২টার দিকে তার মৃত্যু হয়।
হঠাৎ মাসুদের এমন মৃত্যুতে পাঁচ দিন আগে জন্ম নেওয়া কন্যাসন্তান নিয়ে দুই চোখে অন্ধকার দেখছেন স্ত্রী বিউটি আরা। স্বামী মাসুদকে হারিয়ে শোকে চোখের পানি শুকিয়ে গেছে তার। অনেকটা নির্বাক হয়ে সন্তান কোলে নিয়ে বসেছিলেন। বিউটি আরা গভীর রাতে স্বামীর মৃত্যুর খবর পান।
মাসুদের স্ত্রী বিউটি আরা বলেন, বৃহস্পতিবার মিশন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছি। এরপর সোজা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারে গিয়ে উঠি। নিজে অসুস্থ থাকায় সংসাসের কাজকর্মও ঠিকভাবে করা যাচ্ছিল না। মাসুদ বিকেলে বের হয় ওষুধ কেনার জন্য। সে যে গেল আর ফিরে এলো না।
তিনি বলেন, দেড় বছর আগে দুই পরিবারের অমতে আমরা বিয়ে করেছিলাম। আমাদের পরিবারের কেউ মেনে নেয়নি। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারে থাকি। মাসুদ বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করার জন্য কোয়ার্টার পেয়েছিল। সে নিজেও অসুস্থ ছিল। ১০ বছর ধরে তার স্বাভাবিক জীবনযাপন ছিল না। কৃত্রিম পা লাগিয়ে চলাফেরা করত। মাসুদের কী দোষ ছিল? সে তো আন্দোলনের সময় অফিসে যেত, অফিস শেষ হলে বাসায় ফিরে আসত।
জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ওপর হামলার অভিযোগে শনিবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বিনোদপুর বাজারে মাসুদের ওপর হামলা হয়। পরে একদল শিক্ষার্থী তাকে প্রথমে মতিহার থানায় নিয়ে যান। কিন্তু মতিহার থানায় ৫ আগস্টের সহিংসতার ঘটনায় কোনো মামলা না হওয়ায় তাকে বোয়ালিয়া থানায় নেওয়া হয়। তার শারীরিক অবস্থা দেখে পরে সেনাবাহিনীর সহায়তায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে রাত সাড়ে ১২টার দিকে তার মৃত্যু হয়।
দুপুরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মাসুদের মরদেহের ময়নাতদন্ত শেষ হয়। এরপর গ্রামের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের উদ্দেশে স্বজনরা মরদেহ নিয়ে যান। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে শিবগঞ্জ উপজেলার বিনোদপুর কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে বিনোদপুর কেন্দ্রীয় কবরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন হয়।
পরিবারের সদস্যদের দাবি, রাজনৈতিক কারণেই এই হত্যাকাণ্ড হয়েছে। এক পা না থাকা একটি পঙ্গু মানুষ কীভাবে ৫ আগস্ট শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালাবে? এটি তারা বুঝতে পারছেন না!
গত শনিবার নবজাতক শিশুর ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে মাসুদ লেখেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ। সকল প্রশংসা মহান আল্লাহ তাআলার। গত ৩-৯-২০২৪ তারিখে কন্যাসন্তানের পিতা হয়েছি। মহান আল্লাহ তাআলার কাছে নেক হায়াত ও সুস্থতা কামনা করি। সব আত্মীয়-স্বজন, শুভাকাঙ্ক্ষী ও বন্ধুবান্ধবের কাছে আমার ও আমার মেয়ের জন্য দোয়া প্রার্থনা করছি।’
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ইনচার্জ ডা. শংকর কে বিশ্বাস জানান, মৃত্যুর কারণ হিসেবে আপাতত মনে করা হচ্ছে শরীরে বিভিন্ন স্থানে জখম এবং অসুস্থতা ও গণপিটুনি। তবে, বিস্তারিত জানতে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে নগরীর মতিহার থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আরিফুল ইসলামকে মুঠোফোনে কয়েকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
জানা গেছে, আবদুল্লাহ আল মাসুদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সদস্য। ২০১৪ সালের ২৯ এপ্রিল সকালে ক্লাসে যাওয়ার পথে বিশ্ববিদ্যালয়ের জিয়া হলের সামনে হামলার শিকার হন মাসুদ। ওই সময় তার ডান পায়ের নিচের অংশ গোড়ালি থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। বাম পা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কেটে দেওয়া হয় তার হাতের রগ। ওই হামলায় পা হারিয়ে মাসুদ একটি প্লাস্টিকের পা লাগিয়ে চলাচল করতেন। তার অন্য পা শনিবার রাতে ভেঙে দেওয়া হয়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন বেকার থাকার পর নিজের দুর্দশার কথা জানিয়ে একটি চাকরি চেয়ে ২০২২ সালের শেষ দিকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিঠি লেখেন আবদুল্লাহ আল মাসুদ। ওই বছরের ৬ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক-৭ মীর তাফেয়া সিদ্দিকা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে পাঠানো চিঠিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকশন অফিসার পদে আবদুল্লাহ আল মাসুদকে নিয়োগ দিতে বলেন।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালের ২০ ডিসেম্বর আবদুল্লাহ আল মাসুদকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে স্টোর অফিসার পদে নিয়োগ দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। নিয়োগপত্র পেয়ে ২২ ডিসেম্বর চাকরিতে যোগ দেন তিনি। সেই থেকে তিনি এ পদেই বহাল ছিলেন।