বৃহস্পতিবার, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:৫৪ অপরাহ্ন
ওয়েব ডেস্ক: বাংলাদেশের পুলিশ প্রশাসন নতুন কাঠামো, তদারকি এবং জবাবদিহিতার এক নতুন যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে এক দফা আলোচনার পর পুনরায় ‘পুলিশ কমিশন অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর চূড়ান্ত খসড়া প্রস্তুতের নির্দেশ দেওয়া হয়। দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আধুনিকীকরণ, পেশাদারত্ব বৃদ্ধি এবং জনবান্ধব করার উদ্যোগকে কেন্দ্র করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কাজ শুরু করেছে।
সরকারের দাবি, নতুন কাঠামো পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, পেশাগতভাবে স্বাধীন এবং কার্যক্রমে আরও জবাবদিহিমূলক করবে। এ কমিশন গঠিত হলে পুলিশের জবাবদিহিতা বৃদ্ধির পাশাপাশি পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার যে প্রথা রয়েছে, তা থেকে অনেকটা মুক্তি মিলবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী উপদেষ্টা পরিষদের সভায় সংশোধিত এ খসড়া উত্থাপিত হতে পারে।
পুলিশ অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।
কমিশন হবে শক্তিশালী সংবিধিবদ্ধ সংস্থা : থাকবে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি
দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, এ কমিশনকে একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা হিসেবে গঠন করা হবে। এই অধ্যাদেশের বিধানাবলি সাপেক্ষে এই কমিশন স্থাবর ও অস্থাবর উভয় প্রকার সম্পত্তি অর্জন করতে, অধিকারে রাখতে এবং হস্তান্তর করার ক্ষমতা পাবে। এ কমিশনের একটি প্রধান কার্যালয় থাকবে, যা ঢাকার যেকোনো সুবিধাজনক স্থানে অবস্থিত হবে। এছাড়া প্রয়োজন অনুসারে সরকারের পূর্বানুমোদনক্রমে প্রশাসনিক বিভাগ পর্যায়ে কার্যালয় স্থাপন করার ক্ষমতা থাকবে। পাশাপাশি সরকার কর্তৃক অনুমোদিত স্থায়ী ও প্রেষণে নিয়োজিত জনবল দ্বারা কমিশনের দাপ্তরিক কাজ পরিচালিত হবে— এমন প্রস্তাব করা হতে পারে।
যেভাবে গঠিত হবে পুলিশ কমিশন, সদস্য থাকবেন যারা
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক অতিরিক্ত সচিব বলেন, সংশোধিত এ খসড়ায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বা হাইকোর্ট বিভাগের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারককে চেয়ারম্যান করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া, অন্য সদস্যদের মধ্যে থাকবেন সরকারের জাতীয় বেতন স্কেলের (গ্রেড-১) পদমর্যাদার নিচে নন এমন একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এবং মানবাধিকার উন্নয়ন, বাস্তবায়নে কিংবা সুশাসন প্রতিষ্ঠার বিষয়ে অন্যূন ১৫ (পনেরো) বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন মানবাধিকারকর্মী। এদিকে অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শকের নিচে নন, এমন একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তাকে সদস্যসচিব করার প্রস্তাব করা হচ্ছে। এর বাইরেও কমিশনের সদস্যদের মধ্যে কমপক্ষে দুজন নারী রাখতে হবে এমন বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
এর আগের খসড়ায় কমিশনের সদস্যদের মধ্যে জাতীয় সংসদের সংসদ নেতার (সংসদ সদস্য হতে হবে) একজন প্রতিনিধি এবং সংসদের বিরোধীদলীয় নেতার (সংসদ সদস্য হতে হবে) একজন প্রতিনিধির সদস্যপদ প্রাপ্তির কথা থাকলেও চূড়ান্ত খসড়ায় সেটি বাদ দেওয়া হতে পারে। এতে কমিশনের ওপর অযাচিত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও পুলিশকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার যে প্রবণতা রয়েছে, সেটি নিরসন হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
যেভাবে নিয়োগ হবে পুলিশ মহাপরিদর্শক
দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, সংশোধিত এই খসড়ায় কমিশন সততা, মেধা, দক্ষতা, জ্যেষ্ঠতা ও সন্তোষজনক দায়িত্ব পালনের ভিত্তিতে পুলিশ বাহিনীতে কর্মরত অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শকের নিম্নপদস্থ নন, এমন তিনজন কর্মকর্তার নাম অন্তর্ভুক্ত করে একটি প্যানেল সরকারের নিকট সুপারিশ আকারে প্রেরণ করবে। ফলে, পুলিশ মহাপরিদর্শক নিয়োগের ব্যাপারে দায়িত্ব থাকবে সরকার তথা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ওপর।
সদস্যরা যেসব কারণে অযোগ্য বিবেচিত হবেন
সংশোধিত এ খসড়া অনুযায়ী, কোনো সদস্য যদি দেউলিয়া বা ঋণখেলাপি ঘোষিত হন, বাংলাদেশের নাগরিক না হন কিংবা বাংলাদেশের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও অন্য দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন, যদি কোনো প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকেন বা সাময়িক অব্যাহতি গ্রহণ না করেন, দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন বা অন্য কোনো অসদাচরণের কারণে সরকারি চাকরি থেকে বরখাস্ত বা অপসারিত হন, ফৌজদারি অপরাধে কারাদণ্ড ভোগ করেন কিংবা কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য হন— তবে তিনি কমিশনের সদস্য হওয়ার অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পূর্বের খসড়ায় দুজন সংসদ সদস্যকে কমিশনের সদস্য করার বিষয়ে যে প্রস্তাবনা ছিল, সেখানে দুটি জটিল দিক সামনে আসত। প্রথমত, সংসদ সদস্য অবশ্যই কোনো রাজনৈতিক দলের হলে কমিশনের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হতে পারত। কমিশনে সরাসরি রাজনৈতিক প্রভাবের পাশাপাশি পূর্বের থেকেও বেশি পরিমাণে পুলিশকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হতে পারত।
দ্বিতীয়ত, কমিশনের সদস্য ইস্যুতে পূর্বের খসড়ায় একদিকে বলা হয়েছিল দুজন সংসদ সদস্য এর সদস্য হতে পারবেন, কিন্তু সদস্যদের অযোগ্যতা নিয়ে যে বিধান রয়েছে সেখানে বলা হয়েছে— কোনো রাজনৈতিক দলের কেউ সদস্য হতে পারবেন না। এটি একটি পরস্পরবিরোধী আইন হতে যাচ্ছিল। কারণ আমাদের দেশের চর্চা অনুযায়ী সংসদ সদস্য বলতেই অবশ্যই কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মী হতে হয়। স্বতন্ত্র পদ্ধতিতেও যারা সংসদে যান, তারাও কোনো না কোনো দলের অনুসারী হয়ে থাকেন। সুতরাং এ বিষয়ে একটি বড় ধোঁয়াশা থেকে যেত। এবারের খসড়ায় রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের যে বাদ দেওয়া হয়েছে, সেটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হতে পারে। এতে পুলিশ তাদের কার্যক্রম যথাযথভাবে পরিচালনা করতে পারবে।
চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে দায়িত্ব পাবেন জ্যেষ্ঠ সদস্য
সূত্র জানিয়েছে, সংশোধিত এ খসড়ায় কমিশনের চেয়ারপারসন এবং সদস্যগদের পদমর্যাদা সরকার কর্তৃক নির্ধারণ করার প্রস্তাব রয়েছে। এছাড়া কমিশনের চেয়ারম্যানের পদ শূন্য হলে কিংবা তার অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে, শূন্য পদে নবনিযুক্ত চেয়ারপারসন তার কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত কিংবা চেয়ারপারসন পুনরায় দায়িত্ব পালনে সমর্থ না হওয়া পর্যন্ত, কমিশনের জ্যেষ্ঠ সদস্য চেয়ারপারসনরূপে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন— এমন প্রস্তাব করা হচ্ছে।
রাষ্ট্রপতি নিজেই বাছাই ও নিয়োগ করবেন চেয়ারপারসন ও সদস্যদের
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সংশোধিত খসড়া অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নিজেই বাছাই কমিটির সুপারিশক্রমে কমিশনের চেয়ারপারসন ও সদস্যদের নিয়োগ করার ক্ষমতা পাবেন— এমন প্রস্তাব করা হচ্ছে। এছাড়া মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে চেয়ারপারসন বা কোনো সদস্য পদত্যাগ করতে চাইলে রাষ্ট্রপতির উদ্দেশ্যে স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে তারা পদত্যাগ করতে পারবেন। খসড়া অনুযায়ী, কমিশনের চেয়ারপারসন ও সদস্যদের যোগদানের তারিখ থেকে চার বছরের জন্য নিয়োগ দেওয়ার বিধান করা হচ্ছে; তবে নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হওয়ার পর চুক্তিভিত্তিক বা পুনর্নিয়োগের সুযোগ থাকবে না।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এমন আইন হলে দেশের প্রধানমন্ত্রী কার্যত অকার্যকর বিবেচিত হবেন। কমিশনের চেয়ারপারসন ও সদস্যরা যদি সরাসরি রাষ্ট্রপতি নিয়ন্ত্রিত হন, তাহলে দেশের সব প্রয়োজনে এবং জবাবদিহিমূলক পুলিশিং পদ্ধতি নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী কোনো ভূমিকা রাখতে পারবেন না। তারা আশঙ্কা করছেন, এমনটা হলে প্রধানমন্ত্রী তাদের কোনো নির্দেশ দিতে যেমন আইনি বাধার সম্মুখীন হবেন, তেমনি তার নির্দেশ যথাযথ প্রতিপালন না করারও প্রবণতা তৈরি হতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলছেন, কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ এসব পদে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ না থাকলে রাজনৈতিকভাবে আর পুলিশকে ব্যবহার করা যাবে না— যেমনটা বিগত সরকারপ্রধানরা করেছেন। তবে প্রধানমন্ত্রীর এই ক্ষমতা না থাকলে দেশের আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হতে পারে। তাছাড়া রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এলে এ কমিশনকে গতিহীন করার ঝুঁকিও নেহায়েত কম নয়।
চেয়ারপারসন ও সদস্য বাছাই করবেন কারা?
সংশোধিত খসড়া অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি সরাসরি কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ এসব পদে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষমতা পেলেও এর পূর্বে একটি বাছাই কমিটি যোগ্যদের বাছাই করবে। বাছাই কমিটি মৃত্যু বা অন্য কোনো কারণে সদস্যদের শূন্য পদের বিপরীতে নিয়োগযোগ্য ব্যক্তিদের নামের তালিকা তৈরি করে রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ প্রদান করবে। সুপারিশকৃত নামের তালিকা সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে। সেই তালিকা থেকেই রাষ্ট্রপতি যথাযথ নেতৃত্ব বাছাই করবেন। গুরুত্বপূর্ণ এই বাছাই কমিটি পূর্বে পাঁচজন সদস্য নিয়ে হবে এমন প্রস্তাব করা হলেও চূড়ান্ত খসড়ায় সাতজন সদস্য নিয়ে এই কমিটি গঠন করার কথা বলা হয়েছে। বাছাই কমিটি কর্তৃক বাছাই প্রক্রিয়া শুরুর ৩০ দিনের মধ্যে এই কাজ শেষ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ এ কমিটিতে থাকবেন প্রধান বিচারপতি কর্তৃক মনোনীত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, জাতীয় সংসদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির মনোনীত একজন সরকারদলীয় ও একজন বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্য। এই কমিটিতে আরও থাকবেন স্বরাষ্ট্রসচিব ও সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান।
পূর্বের খসড়ায় বাছাই কমিটিতে দায়িত্বপ্রাপ্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সংসদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি, বিচারক হিসেবে ১০ বছরের বেশি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারপতি, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিব এবং রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনোনীত পুলিশি কার্যক্রম, মানবাধিকার সংরক্ষণ বা সুশাসন প্রতিষ্ঠার বিষয়ে কমপক্ষে ১০ বছরের অভিজ্ঞ একজন নাগরিক প্রতিনিধি থাকার কথা থাকলেও সেটি পরিবর্তন করা হচ্ছে।
যেভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করবে কমিশন
সূত্র জানিয়েছে, কমিশনের কার্যক্রম সভার মাধ্যমে পরিচালিত হবে। এ সভায় চেয়ারপারসন সভাপতিত্ব করবেন। চেয়ারপারসন অনুপস্থিত থাকলে সদস্যদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ সদস্য সভায় সভাপতিত্ব করবেন। উপস্থিত সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে কমিশনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। তবে কোনো বিষয়ে সদস্যদের ভোট সমান দুই ভাগে বিভক্ত হলে চেয়ারপারসন নির্ধারণী (কাস্টিং) ভোট প্রদান করতে পারবেন— এমন বিধান প্রস্তাব করা হচ্ছে।
জানা গেছে, কমিশন মূলত পুলিশি কার্যক্রমে দক্ষতা ও উৎকর্ষ আনয়ন, শৃঙ্খলা এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় নির্দেশনা বা সুপারিশ প্রদান করবে। নিয়মিত পরিবীক্ষণের মাধ্যমে পুলিশ সদস্যদের সততা, শৃঙ্খলা, দক্ষতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয় সুপারিশ করবে। নাগরিকের মৌলিক অধিকার এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ড অনুসারে পুলিশি কার্যক্রম পরিবীক্ষণ ও প্রয়োজনীয় সুপারিশ করবে। সমাজে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় অপরাধ তদন্ত ও প্রসিকিউশন কার্যক্রম চিহ্নিত করে সুপারিশ করবে। আটক, জিজ্ঞাসাবাদ, বলপ্রয়োগ সংক্রান্ত কাজে মানবাধিকার রক্ষায় প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তির ব্যবহারে দিকনির্দেশনা প্রদান ও এ সংক্রান্ত বিষয়ে পুলিশি কার্যক্রমের নিয়মিত তদারকি ও যথাযথ সুপারিশ করবে। পুলিশের আইনানুগ কার্যক্রমে কোনো ব্যক্তি বা সত্তা বিধিবহির্ভূত প্রভাব বিস্তার করলে তদন্তপূর্বক সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করবে। পুলিশ বাহিনীর দুর্নীতি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করবে এবং অবৈধ সম্পত্তির তথ্য উদ্ঘাটিত হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করবে।
নাগরিকের অভিযোগ ও পুলিশের সংক্ষোভ নিরসনে হবে কমিটি
কমিশনের তিনজন সদস্যের সমন্বয়ে নির্ধারিত মেয়াদ উল্লেখপূর্বক একটি ‘পুলিশ সংক্ষোভ নিরসন কমিটি’ গঠন করা হবে। প্রাথমিকভাবে এই বোর্ড পুলিশ সদস্যদের সংক্ষোভ নিরসনে প্রয়োজনীয় পদ্ধতি নির্ধারণ ও সংক্ষোভ নিরসনের কার্যক্রম পরিচালনা করবে। এছাড়া বিধিবহির্ভূত প্রভাব, বৈষম্য, অনিয়ম, অবৈধ নির্দেশনা বাস্তবায়নে বাধ্যকরণ, হয়রানি, বঞ্চনা ও অন্যায্য আচরণ ইত্যাদি সংক্রান্ত কার্যক্রম বিষয়ে সুপারিশ প্রদান করবে। পুলিশ সদস্যদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় চিকিৎসাব্যবস্থা উন্নয়ন, দক্ষ চিকিৎসক ও মনোবিদদের সমন্বয়ে চিকিৎসক পুল গঠনসংক্রান্ত সুপারিশ করবে। কোনো পুলিশ সদস্য ধারা ১৪-এর অধীনে পুলিশের নিজস্ব অভিযোগ নিষ্পত্তি ব্যবস্থার সিদ্ধান্ত দ্বারা সন্তোষজনক প্রতিকার না পেলে তিনি বা তার পক্ষে অন্য কেউ এই কমিটির কাছে অভিযোগ দাখিল করতে পারবেন। এছাড়া নাগরিক অভিযোগ ও অভ্যন্তরীণ সংক্ষোভ নিষ্পত্তির জন্য পুলিশের একটি নিজস্ব ব্যবস্থা থাকবে, যা এই অধ্যাদেশের ভিত্তিতে প্রথম কমিশন গঠনের তিন মাসের মধ্যে কমিশনের নির্দেশনার আলোকে পুলিশ কর্তৃপক্ষ কার্যকর করবে; এমন প্রস্তাবও রয়েছে।
পাশাপাশি কমিশনের তিনজন সদস্যের সমন্বয়ে নির্ধারিত মেয়াদ উল্লেখপূর্বক একটি ‘নাগরিক অভিযোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি’ গঠনের প্রস্তাবও রয়েছে। এই কমিটি নাগরিকের অভিযোগ অনুসন্ধান ও নিষ্পত্তি করার লক্ষ্যে অভিযোগের প্রকৃতি ও গুরুত্ব বিবেচনা করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সুপারিশ করবে। নাগরিকের অভিযোগ অনুসন্ধান কার্যক্রম ন্যায়সংগত ও সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের জন্য পর্যায়ক্রমে দেশের প্রতিটি বিভাগে শাখা বা কার্যালয় স্থাপন করে পরিচালনা করবে। এছাড়া নাগরিকের অধিকার লঙ্ঘনে পুলিশকে অপব্যবহারের কোনো ঘটনা বা উদ্যোগ পরিলক্ষিত হলে সেটা নিরসনের জন্য প্রয়োজনীয় সুপারিশ করবে। এছাড়া এই বোর্ড জাতীয় নিরাপত্তা নীতির আলোকে জননিরাপত্তা প্রণয়নে সরকারকে সুপারিশ ও সহায়তা প্রদান করবে। কোনো পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে বা অন্য কোনো মাধ্যমে কোনো অভিযোগ দৃষ্টিগোচর হলে নাগরিক ব্যবস্থাপনা কমিটি ওই অভিযোগ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে পরামর্শ দিতে পারবে।
কমিশনের নির্দেশ প্রতিপালনে ব্যর্থ হলে নিতে পারবে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা
সূত্র জানিয়েছে, এই অধ্যাদেশের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে কমিশন কোনো ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষকে কোনো নির্দেশ প্রদান করলে ওই ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষ কমিশনের নির্দেশ বা সুপারিশ প্রাপ্তির তারিখ থেকে দুই মাসের মধ্যে বাস্তবায়ন করে কমিশনকে অবহিত করবে। কোনো ব্যক্তি কমিশনের নির্দেশ বা সুপারিশ প্রতিপালনে ব্যর্থ হলে বা গাফিলতি করলে তা দায়ী ব্যক্তির অদক্ষতা ও অসদাচরণ বলে বিবেচিত হবে; এই অদক্ষতা ও অসদাচরণ প্রযোজ্য ক্ষেত্রে প্রচলিত বিধি অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থাসহ উপযুক্ত শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার ক্ষমতা থাকবে কমিশনের।
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কমিশন যদি কর্মকর্তাদের শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতাও রাখে, তাহলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নখদন্তহীন বাঘে পরিণত হবে।
ন্যায়পালের অনুমোদনক্রমে তদন্ত করতে পারবে কমিশন
সূত্র জানিয়েছে, শুধু আদালতে বিচারাধীন বা ন্যায়পাল কর্তৃক বিবেচ্য কোনো বিষয়ে এই কমিশন তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করার ক্ষমতা রাখবে না। তবে আদালত বা ক্ষেত্রমতো ন্যায়পালের অনুমোদনক্রমে কমিশন বিষয়টির ওপর তদন্ত পরিচালনা করতে পারবে এবং তদন্ত শেষে তদন্ত প্রতিবেদন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার জন্য আদালত বা ন্যায়পালের কাছে পরবর্তী ব্যবস্থার জন্য দাখিল করবে। এছাড়া কমিশনের তদন্তাধীন কোনো বিষয় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কর্তৃক বিবেচনাধীন থাকলে কমিশন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সঙ্গে সমন্বয়পূর্বক বিষয়টির সুরাহা করবে— এমন প্রস্তাব করা হচ্ছে।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা মনে করেন, শুধু কমিশন করলেই পুলিশকে সংস্কার করা যাবে না। জনগণকে মূল্যায়ন করতে এবং দেশের জন্য কাজ করতে অবশ্যই সরকারকে যোগ্য, মেধাবী এবং তাদের সততাকে গুরুত্ব দিতে হবে। একজন কর্মকর্তার কর্মজীবনে জেনারেল রেপুটেশন কেমন ছিল, সেটা বিবেচনায় নিতে হবে। আইজিপি কমিশন থেকে নিয়োগ হোক আর সরাসরি সরকার নিয়োগ দিক, এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তাদের দক্ষতা এবং সততা। আইজিপি নিয়োগে প্রয়োজনে দুর্নীতি দমন কমিশনের মতামত নেওয়া যেতে পারে। তাদের একটা ক্লিয়ারেন্স পেলে এরপর নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।
তিনি বলেন, এই কমিশন নিয়ে অনেক হইচই হচ্ছে। এত হইচইয়ের দরকার নেই। শুধু কমিশন করলেই হবে না বরং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এর আগে আমরা দেখেছি পুলিশের অনেক কর্মকর্তা ডমেস্টিক সার্ভেন্টের মতো কাজ করেছেন। পাবলিক সার্ভেন্ট হতে পারেননি অনেকেই। অনেকেই স্বপ্রণোদিত হয়ে রাজনৈতিক কর্মীর মতো আচরণ করেছেন, মাঠে থেকেছেন। এগুলোর সুরাহা করতে অবশ্যই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।
জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক কর্নেল (অব.) কাজী শরীফ উদ্দিন বলেন, পুলিশ কমিশন করা কিংবা নতুন কাঠামো তৈরি— এগুলো কাগজে-কলমে সুন্দর দেখালেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। বিগত দুই দশকে আমরা দেখেছি, পুলিশের একটি বড় অংশ রাজনৈতিক আনুগত্য, দুর্নীতি ও অকার্যকারিতার কারণে জনআস্থা হারিয়েছে। কমিশন গঠন করলেই এই প্রবণতা কমে যাবে— এমনটা নিশ্চিত নয়। কারণ, পুলিশের অভ্যন্তরে যে দণ্ডমুক্তির সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, তা ভাঙার মতো শক্তিশালী কোনো পদ্ধতি এখনো দেখা যাচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, যে বাহিনী নিজস্ব জবাবদিহি প্রক্রিয়া কার্যকর করতে ব্যর্থ, যেখানে অভিযোগের নিষ্পত্তি হয় নথিতে, কিন্তু মাঠে কোনো পরিবর্তন আসে না— সেই বাহিনীকে শুধু কমিশনের সুপারিশে বদলে ফেলা অসম্ভব। বাস্তবতা হলো, পুলিশের ভেতরে দুর্নীতি, অপব্যবহার ও ক্ষমতার অতিরিক্ত প্রয়োগ নিয়ন্ত্রণ করার মতো আন্তরিকতা এখনো নেই। বরং কমিশনের মতো নতুন কাঠামো তৈরি করে দায় চাপানো হবে আরেকটি প্রতিষ্ঠানের ওপর, অথচ মূল সমস্যাগুলো অমীমাংসিতই থেকে যাবে।
তিনি সতর্ক করে বলেন, যদি কমিশনকে পর্যাপ্ত শক্তি দেওয়া হয় কিন্তু মাঠপর্যায়ে পুলিশ সেটি বাস্তবায়ন না করে, তাহলে দ্বৈত ক্ষমতার সংঘাত তৈরি হবে। আর যদি কমিশন দুর্বল হয়, তাহলে পুলিশ আগের মতোই রাজনৈতিক আশ্রয়ে থেকে কার্যক্রম চালাবে। দুই অবস্থাই দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্য ক্ষতিকর।
প্রশাসনিক আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার জাহিদ রহমান বলেন, পুলিশ এখন কার্যত জবাবদিহির বাইরে পরিচালিত হচ্ছে। আইন বলছে, যেকোনো সরকারি ক্ষমতার প্রয়োগ অবশ্যই ‘ন্যায্য, স্বচ্ছ ও যুক্তিসংগত’ হতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, মাঠপর্যায়ে পুলিশি সিদ্ধান্তগুলো অনেক সময়ই আইনের ন্যূনতম মানদণ্ডও অনুসরণ করে না। বিশেষ করে গ্রেপ্তার, তল্লাশি, কিংবা গণসমাবেশ নিয়ন্ত্রণ— এসব ক্ষেত্রে পুলিশ প্রায়ই ক্ষমতার অপব্যবহার করছে। এভাবে আইনকে পাশ কাটিয়ে পুলিশের ইচ্ছামতো আচরণ চলতে থাকলে নাগরিক অধিকারই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রশাসনিক আইনের দৃষ্টিতে এটি একটি স্পষ্ট ‘অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রয়োগ’, যা রোধে শক্তিশালী স্বাধীন নজরদারি ছাড়া কোনো সমাধান সম্ভব নয়। সুতরাং পুলিশ কমিশন করতে হলে অবশ্যই পুলিশের বেপরোয়া শক্তি প্রয়োগের ক্ষমতা কমাতে হবে। তা না হলে জনবান্ধব পুলিশিং সম্ভব নয়। জনবান্ধব পুলিশ কমিশন করতে অবশ্যই তাদের জবাবদিহিতা বাড়াতে হবে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আমাদের দেশে পুলিশের কার্যক্রমে যে মাত্রার বিচক্ষণতা, গবেষণানির্ভর পরিকল্পনা ও পেশাদার নীতিনিষ্ঠা থাকা উচিত, বাস্তবে তা দেখা যায় না। অনেক ক্ষেত্রেই পুলিশ যে সিদ্ধান্ত নেয়, তা আইনি কাঠামো বা প্রমাণভিত্তিক ক্রিমিনোলজি না মেনে প্রশাসনিক বা রাজনৈতিক চাপের প্রতিফলন হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে পুলিশ শুধু আস্থাহীনতার সংকটেই ভোগে না, আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাও ঝুঁকির মুখে পড়ে।
ক্রিমিনোলজির দৃষ্টিকোণ থেকে বললে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ, অযৌক্তিক গ্রেপ্তার, পক্ষপাতমূলক নজরদারি— এসব আচরণ অপরাধ প্রতিরোধের বদলে দীর্ঘমেয়াদে অপরাধপ্রবণতা বাড়িয়ে দেয়। পুলিশ যদি জবাবদিহিমূলক কাঠামোয় না ফেরে এবং কমিউনিটি-ভিত্তিক ন্যায়সংগত কৌশল গ্রহণ না করে, তাহলে শুধু কমিশন করে সামাজিক নিরাপত্তা সবল করা সম্ভব হবে না।