কিংকর্তব্যবিমূঢ় ট্রাভেল ডাইরী ফেস্টের বিজয়ী হয়েছেন তন্ময় সরকার। বলাবাহুল্য যে গ্রুপটি অনলাইনে হলেও তারা বিভিন্ন ধরনের ফেস্ট, কনটেস্ট র আয়োজন করে আসছে। এবং বিজয়ীদের উৎসাহিত করতে আর্কষনীয় পুরস্কার প্রদান করে আসছে। নিচে বিজয়ী তন্ময় সরকারের লেখা ট্রাভেল ডাইরী ……
প্রতিটি মানুষই অচেনাকে জানতে খুবই উদগ্রীব থাকে। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। আমার কাছে ভ্রমণ নিছক কোন ঘটনা না। ভ্রমণ বলতে আমি বুঝি নিজের আত্মাকে আরো নিজের করে চেনার মাধ্যম। এমনিতেই অনেক চিল্লাচিল্লি করি কিন্তু ভ্রমণে এমন কিছু করাটাকে অত্যন্ত ঘৃণা করি এবং ভ্রমণের সময় খেয়াল রাখি আমার কারণে পরিবেশ কিংবা আশেপাশের মানুষের যাতে ক্ষতি না হয়। সেজন্যই সর্বোচ্চ তিনজনের বেশি মানুষের সাথে ভ্রমণ করা থেকে বিরত থাকি। নতুন কোন পরিবেশে হারিয়ে যাওয়া, নতুন কিছু দুচোখ ভরে দেখা হয়তো সেকারণেই অনেক কিছুই ক্যামেরা বন্দি করা হয় না বা করতে পারি না। সবচেয়ে ভাল লাগে অবারিত প্রকৃতি। সেই সাথে খুঁজি আশেপাশে নদী আছে কিনা। থাকলে তো জমে ক্ষীর। এরপর আসে ঐতিহাসিক স্থাপনা বিশেষত যেখানে জ্ঞানের সাথে মিশে থাকে জানা-অজানা অনেক রহস্য। স্থানীয় লোকজনের জীবনাচরণ। ভালো লাগে স্থানীয় রেলওয়ে স্টেশন কারণ সেখানেই প্রায় সকল পর্যায়ের লোকজনের কার্যকলাপের দেখা মেলে। এরপর সেখানকার স্থানীয় বইয়ের দোকান বা লাইব্রেরি। খাবারটাও বাদ যায় না এরমাঝে। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলেরই খাবারে অনেকটা নিজস্বতা বিদ্যমান। সবটাই যদি এক ভ্রমণে পাওয়া যায় তবে তো এককাঠি উপরে সরেস পাওনা। এসব প্যাচাল অনেক হলো এবার ভ্রমনের স্থানের কথা বলি। গিয়েছিলাম খুলনা বিভাগের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এক জেলা কুষ্টিয়ায়। এই জেলাকে দেশের সংস্কৃতিক রাজধানী বলা হয়।
খুব ভোরে উঠে স্নান খাওয়া সেরে রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশন হতে চেপে বসি ট্রেনে। এরপর মুক্ত হাওয়া চোখেমুখে লাগাতে আর চারপাশের খোলা প্রকৃতি দেখতে দেখতে চলে আসি কুষ্টিয়া কোর্ট স্টেশনে। ওহ হ্যা মাঝে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের সৌন্দর্যে অনেকটা নির্বাক হয়ে ছিলাম। সেখান থেকে অটো ধরে সোজা ছেঁউড়িয়ায় বাউল সম্রাট লালন শাহের মাজারে। গিয়েই দেখি অনেক চমক চারিদিকে বাউল গানের আসর। আহা আত্মার শান্তির সাধনা বোধহয় এরাই করতে জানে। সময় কেটে যায়। এমনকি হালকা খাওয়া-দাওয়া ছাড়া সারা রাতই প্রায় সামনের খোলা মাঠটাই আধ শুয়ে বা বসেই কাটিয়েছিলাম আর হারিয়ে যাচ্ছিলাম নিজেকে নিয়ে ঈশ্বরের কোন অচেনা গলিতে। আত্ম শোধনের উদ্দেশ্যে সেখানে ধোঁয়া উড়ানোরও বেশ ব্যবস্থা আছে সেসব আর না বলি। ভোর চার’টায় দাদার বাসায় যেয়ে স্নান করে আবার ভরপেট খেয়ে টানা দুপুর দু’টো পর্যন্ত ঘুম। ঘুম ভাঙার পর গেলাম রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি আঁকড়ে থাকা শিলাইদহের কুঠিবাড়ী। ঘন্টাদুয়েক রবিঠাকুরের ওইখানেই কাটলো। এরপর সেখান থেকে গেলাম পাশের পদ্মা নদীতে। কি যে সুন্দর তা হয়তো নিজের চোখ দুটোই জানে। এরপর শ তিনেক টাকা দিয়ে ভাড়া করা এক নৌকায় সন্ধ্যার অনেক পরে পর্যন্ত হুটোপুটি, জনহীন এক চরে নামা। রাত নামলে আসলাম শহরের কোলাহলমূখর পরিবেশে। শহরের আনাচে কানাচে ঘুরলাম। লাইব্রেরি, বই পাড়া, কলেজ রোড আরো কতো কি। পরিমল থিয়েটারের সামনে আসতেই মনে পরলো এখানে একসময় শিশির ভাদুড়ী, দূর্গা দাশের মতো বিখ্যাত সব অভিনেতারা আসতেন অভিনয় করার জন্য। কি সুন্দরই না ছিলো সেই সোনালী সময় গুলো! এখন তো ঘরে ঘরে পিটপিট করে জ্বলে রাউটারের লাল-নীল আলো। ওসব এখন ফিকে। স্থানীয় এক হোটেলে রাতের খাওয়া সেরে গেলাম গড়াই ব্রীজে। পরদিন সকালে বোধহয় অনেক কিছুই অপেক্ষা করছিলো আমার জন্য। এলোপাতাড়ি ছুটলাম গোপীনাথ জিউর মন্দির সেখানে কিছুক্ষণ সময় কাটালাম। এরপর বাংলাদেশের সর্বপ্রথম রেলওয়ে স্টেশন ‘জগতি’ গেলাম। বাংলাদেশ সরকারের উচিত এখানে কিছুটা দৃষ্টি দেওয়া। দেশের প্রথম রেলওয়ে স্টেশন কতো সুন্দর পরিবেশ অথচ সংস্কারের কোন বালাই নেই। পুরোনো বিল্ডিংগুলোর ইট সুরকি খসে খসে পরছে, অবহেলা আর অনাদরে নষ্ট হচ্ছে জগতি রেলওয়ে স্টেশন তা ভাবলেই খারাপ লাগে। সেখান থেকে গেলাম বিষাদসিন্ধুর লেখক মীর মোশাররফ হোসেনের বসতভিটাতে। ভাবতেই অবাক লাগে প্রখ্যাত দুই লেখকের জীবনের অনেকটা সময় কেটেছে এই কুষ্টিয়ায়। তারপর কখন যে দুপুর পেরিয়েছে টেরই পাইনি ক্ষিদেয় পেটে ইঁদুর দৌড় শুরু হয়েছে ততক্ষণে। সে যাক আমি তো থামবার পাত্র নই এখনো আরেকটা দেখা বাকি তাই চলে গেলাম টেগোর এন্ড কোম্পানীর টেগোর লজে। রবীন্দ্রনাথ এখানে বসেই “ক্ষণিকার” অনেক কিছু এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন।
এরপর বাসায় ফিরে খাওয়াদাওয়া সেরে আর বের হতে মন চাচ্ছিলো না তাই সাময়িক বিরতি। অনেক দৌড়ছি দুদিন ধরে তাই কিছুটা থেমে গেলাম। মেস বা হোস্টেল লাইফে এক মজা আছে অনেকের সাথেই পরিচয় হয় তখন। কিছু থাকে কিছু থাকে না। সৌভাগ্যক্রমে আমার একজনের সাথে পরিচয় হয় যার বাসা কুষ্টিয়ায়। সকাল সকাল তাকে ডেকে বেরিয়ে পরি ঘুরতে। এরপর গেলাম বিআরবিতে সেখানে কিছুক্ষণ ঘোরার পর অটো ধরে দাদার সাথে গেলাম কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে। দাদা সেখানকার ছাত্র তাই আনন্দের কমতিও ছিলো না। সব ঘোরাঘুরির পর এক হলে গিয়ে দুপুরের খাবার খেলাম। পরিচিত হলাম দাদার বন্ধু তথা আমার অনেক সিনিয়রদের সাথে। সময় খুব খারাপ কাটেনি। হলের ছাদে গিটার নিয়ে বসেছিলাম অনেকক্ষণ। বিকেলে গেলাম রেনউইক বাঁধে। খুবই সুন্দর যেমন অনেক গাছ তেমনি অনেক পাখি চারিদকে। গড়াই তীরে তীর্থ বলা যায়। সেখানে ঘোরাঘুরির পর গড়াইয়ের বুকে ঘোরার জন্য উঠলাম নৌকায়। একেবারে মোহনায় গেলাম সেখান থেকে এসে দেখি শহরের সব রঙীন আলোর ছটা শান্ত গড়াইয়ের গায়ে যেনো চাদর জড়িয়েছে। আর কি চাই চোখ জোড়াকে স্বার্থক করার জন্য? রাতে খেলাম শহরের বিখ্যাত শিল্পী হোটেলে বেশ ভালো। মজমপুর গেটে যখন রাজশাহীগামী বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলাম তখন সত্যিই শহরটিকে চোখে হারাচ্ছিলাম বারবার। ততোক্ষণে মায়ায় পরে গিয়েছিলাম যে। এরপর বাস আসলে তাতে চেপে বসলাম। লালন সেতুর উপর থেকে যখন দেখলাম হার্ডিঞ্জ ব্রীজ একটু একটু করে পেছনে চলে যাচ্ছে তখন খারাপ লাগাটা আরো পুরোপুরি পেয়ে বসেছে। বাসে বসে বসে ভাবছিলাম মানবজাতি সারাজীবন জীবনের যাঁতাকলে পিষে কি পেলো? সমাজের বস্তপঁচা নিয়ম না মানা ছেলেটিকে যারা সামাজিকতার দোহাই দিয়ে আটকে রাখে তাদের পাপ ঠিক কতোটুকু?