বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা:
২০২০ যেন দিকপালদের চলে যাওয়ার বছর। এবার চলে গেলেন ভারতীয় ফুটবলের নক্ষত্র চুনী গোস্বামী। কিছুদিন আগেই প্রয়াত হন পিকে ব্যানার্জি। গত শতকের ছয়ের দশকে ভারতীয় ফুটবলের তিন রত্নের মধ্যে এখন শুধুই সাধারণ মানুষের কাছে জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে রইলেন তুলসীদাস বলরাম। ১৯৬২ সালে জাকার্তা এশিয়াডে চুনী গোস্বামীর নেতৃত্বেই ভারত ফুটবলে সোনা জিতেছিল।
বেশ কিছুদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি অসুস্থ ছিলেন। কলকাতার যোধপুর পার্কের ফ্ল্যাটেই তাঁর চিকিৎসা চলছিল। কিন্তু বৃহস্পতিবার বিকেলে তিনি ফের অসুস্থ হয়ে পড়েন। একটি বেসরকারি হাসপাতালে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়। পাঁচটা নাগাদ সেখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বয়স হয়েছিল ৮২ বছর।
তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ। টুইটে পরিষ্কার বাংলায় তিনি লেখেন, ‘চুনী গোস্বামীর প্রয়াণে আমি মর্মাহত। তাঁর মৃত্যুতে ভারতের ফুটবল ভক্তরা এক কিংবদন্তিকে হারালেন। ক্রীড়াজগতের এক বহুমুখী প্রতিভা ছিলেন তিনি। তঁার পরিবার, বন্ধু এবং ভক্তদের প্রতি আমার সমবেদনা রইল।’ শোক প্রকাশ করেছেন পশ্চিমবাংলার রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজ্যের মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্র প্রমুখ।
শোকস্তব্ধ কলকাতা ময়দান। স্তব্ধ বাংলার ফুটবল জগৎও। মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, মহমেডান স্পোর্টিং–সহ কলকাতার সব ক্লাবই তাঁর প্রয়াণে শোক প্রকাশ করেছে। ফুটবলারদের মধ্যে শ্যাম থাপা, সুভাষ ভৌমিক, সুব্রত ভট্টাচার্য, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়, মানস ভট্টাচার্য, বিদেশ বসু, কম্পটন দত্ত, তরুণ দে, সত্যজিৎ চট্টোপাধ্যায়, বিকাশ পাঁজি, সুনীল ছেত্রী–সহ বহু প্রাক্তন ও বর্তমান ফুটবলার তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে জানিয়েছেন, বাংলা তথা ভারতীয় ফুটবলের স্বর্ণযুগের এক নক্ষত্র খসে পড়ল আজ। ভারতের ফুটবল ও ক্রিকেট সংস্থাও শোক প্রকাশ করেছে। এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশনও গভীর শোক প্রকাশ করেছে তাঁর মৃত্যুতে। চুনী প্রয়াণের খবর প্রচারিত হওয়ার পরই আইএসএল চ্যাম্পিয়ন এটিকে–ও শোক জানায়। এএফসি–ও টুইট করে শোক প্রকাশ করেছে। সেই টুইট রি–টুইট করে শোক জানায় ফিফাও।
তাঁর প্রকৃত নাম সুবিমল গোস্বামী। তবে ময়দানে তিনি পরিচিত ছিলেন চুনী নামেই। এই চুনী গোস্বামী নামটিই পরে বিখ্যাত হয়ে যায়। তাঁর জন্ম বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জে। মাত্র ৮ বছর বয়সে মোহনবাগানে জুনিয়র ফুটবলার হিসেবে যোগ দেন ১৯৪৬ সালে। ১৯৫৪ সালে সিনিয়র দলে খেলার সুযোগ পান। তার পর আর তাঁকে ফিরে তাকাতে হয়নি। আজীবন মোহনবাগান ক্লাবেই খেলেছেন। মোহনবাগানে খেলতেন বলে ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ক্লাব টটেনহ্যামে খেলার প্রস্তাবও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। ১৯৬৮ সালে মোহনবাগানে খেলেই তিনি অবসর নেন ফুটবল থেকে। ১৯৫৬ সালে প্রথম ভারতের হয়ে খেলেন। ভারতের হয়ে ৫০টি ম্যাচ খেলেছেন। ১৯৬২ সালে তাঁর নেতৃত্বে জার্কাতার এশিয়ান গেমসে ফুটবলে ভারত সোনা জেতে। ১৯৬৬ সালের এশিয়ান গেমসেও তাঁর নেতৃত্বে ভারত রুপো পায়। এ ছাড়া ভারতের হয়ে তিনি প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন অলিম্পিক, এশিয়া কাপ ও মারডেকা ফুটবলে।
ফুটবলের পাশাপাশি ক্রিকেট খেলেও যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছিলেন। ১৯৬২ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত বাংলার হয়ে খেলেন। দু’বার তাঁর নেতৃত্বে বাংলা রঞ্জি ট্রফির ফাইনালে উঠেছিল। একদিনের ক্রিকেটে তিনি ১,৫৯২ রান করেন। তার মধ্যে একটি শতরান এবং সাতটি অর্ধ–শতরান করেছিলেন। ভালো ব্যাটসম্যান যেমন ছিলেন, তেমনই বলও যথেষ্ট ভালো করতেন। বোলার হিসেবে তিনি ৪৭টি উইকেট নিয়েছেন। তাঁর নেতৃত্বে ভারতের সেন্ট্রাল ও ইস্টার্ন জোন সেই সময়ের অপ্রতিরোধ্য ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে দিয়েছিল। ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত তিনি টাটা ফুটবল অ্যাকাডেমির কোচ ছিলেন। ১৯৯১ সালে এক বছর ভারতীয় ফুটবল দলকেও কোচিং করান। ফুটবল, ক্রিকেট ছাড়াও তিনি লন টেনিস, ব্যাডমিন্টনও যথেষ্ট ভালো খেলতেন।
১৯৬২ সালে এশিয়ার সেরা স্ট্রাইকারের পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি। ১৯৬৩ সালে ভারতের অর্জুন পুরস্কার পান। ১৯৮৩ সালে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মান দেয়। সারা জীবন মোহনবাগানে খেলেছিলেন বলে ২০০৫ সালে ‘মোহনবাগান রত্ন’ পুরস্কার দেওয়া হয় ওই ক্লাবের তরফে। করোনা আবহের মধ্যেই এই অভিশপ্ত ২০২০ সালেই বাংলার ক্রীড়াজগৎ এক বর্ণময় চরিত্রকে হারাল বলা যায়।