উপমন্যু রায়
কেমন আছ অনসূয়া?
কতদিন পরে আজ তোমায় দেখলাম! যদিও কিছু সময়ের জন্য। পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে সিগনালে আটকে গিয়েছিল তোমার হন্ডা সিটি। আমি দাঁড়িয়েছিলাম বাসস্টপে। বাসের অপেক্ষায় যখন অধৈর্য হয়ে উঠছিলাম, তখনই আমার চোখ চলে যায় তোমার গাড়ির দিকে।
না–না, চমকে উঠিনি। তবে বিভোর হয়ে গিয়েছিলাম সম্ভবত। কোনও কথা বা ভাবনা মাথায় আসেনি। শরীর ও মননে এক তীব্র অনুভূতি হয়তো চোখের দৃষ্টি গভীর করে দিয়েছিল আমার। নির্বাক চোখে তোমার দিকে তাকিয়েছিলাম।
কিন্তু কয়েক মুহূর্ত মাত্র। তার পরই সিগনাল গ্রিন। আর তোমাকে নিয়ে তোমার গাড়িও হারিয়ে যায় আমার দৃষ্টির আড়ালে। সম্বিত ফেরে আমার। হাজার এক স্মৃতি আর জিজ্ঞাসা দোলা দিয়ে যায় আমার মনে। বুকের ভেতরে একটা পুরনো যন্ত্রণা যেন নতুন করে রিনরিন করে বেজে উঠেছিল। যদিও জানি আজকের এই সময়ে আমার মনের এই আন্দোলন মূল্যহীন।
গাড়িতে তোমরা ছিলে তিনজন। সামনের সিটে ড্রাইভার। পিছনে তুমি। তোমার পাশে একটি বাচ্চা মেয়ে। সম্ভবত তোমারই। সে–ও জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছিল।
শরৎ–বিকেলের হলুদ রঙা নরম আলো তোমার মুখের ওপর এসে পড়েছিল। ঝকঝক করছিলে তুমি। আর অসম্ভব সুন্দরী দেখাচ্ছিল তোমাকে। বেশ ভরা–ভরা লাগছিল। সুখী নারীর এক উজ্জ্বল আমেজ যেন ছড়িয়ে পড়েছিল তোমার সর্বাঙ্গে। ব্যস, ওই পর্যন্ত। তার পরই তুমি হারিয়ে গেলে তোমার গাড়ির সঙ্গে।
তুমিও হয়তো আমাকে দেখেছ। হয়তো চিনতে পারোনি। অথবা, চিনেও চিনতে চাওনি। তোমার দৃষ্টি আমার ওপর দিয়ে গড়িয়ে গিয়েছিল আমার চারপাশের অন্য সব পথচারীর দিকে। আমি যেন অচেনা কোনও ব্যক্তি! প্রতিদিন রাস্তাঘাটে, হোটেলে–বাজারে যেমন অচেনা ব্যক্তিদের দেখতে পাই। আবার সঙ্গে সঙ্গে ভুলেও যাই। তাই হয়তো তুমি ছিলে একেবারে শান্ত ও স্বাভাবিক। বিন্দুমাত্র প্রতিক্রিয়া দেখতে পাইনি তোমার দৃষ্টিতে। অসম্ভব ধীর–স্থির ছিল তোমার চাহনি!
হয়তো তোমার চোখে তখন আমি ছিলাম আর পাঁচটা পথচারীর মতো। তাই আমার চোখের গভীরতা স্পর্শ করতে পারেনি তোমার দৃষ্টি। আর পাঁচজন পুরুষ যেমন বুভুক্ষুর মতো তাকিয়ে থাকে সুন্দরী নারীর দিকে, গোগ্রাসে গিলতে চায় তার যৌবন, তুমিও হয়তো তেমন পুরুষই ভেবে নিয়েছিলে আমাকে।
কিন্তু— সত্যিই কি ভেবেছিলে? হয়তো ভেবেছিলে। হয়তো ভাবোনি। ভাবনাহীন চোখেই তোমার দৃষ্টি ঘুরে গিয়েছে আমাকে অতিক্রম করে অন্যদের দিকে। হয়তো।
আমি তো এমনই অতিরিক্ত চিরকাল। তাই সে সব নিয়ে খুব বেশি কষ্ট পাইনি কোনও দিন। কী করে পাব? দুনিয়ার সর্বকালের সব চেয়ে জ্ঞানী মানুষ ছিলেন সক্রেটিস। আমি তা–ই বিশ্বাস করি। সেই সক্রেটিসই কি কম কষ্ট পেয়েছিলেন জীবনে? কিন্তু কোনও কষ্টকেই তিনি কখনও সে ভাবে গুরুত্ব দেননি।
সক্রেটিস বেঁচেছিলেন সত্তর বছর। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতক ছিল সেটা। সক্রেটিসের ভয়ঙ্কর সব যুক্তির ধারে তখন রাষ্ট্র বোবা হয়ে যেত। সত্যি কথা বলতে কী, এমন মানুষকে রাষ্ট্র সবসময় সন্দেহের চোখে দেখে। সক্রেটিসকেও তাই পছন্দ করত না রাষ্ট্রনেতারা।
এখন যেমন বহু মানুষ রাষ্ট্রের অনুগৃহীত হতে চায়, সুনিশ্চিত রাখতে চায় ভবিষ্যৎ জীবনকে, তখনও অবস্থাটা খুব বেশি অন্য রকম ছিল না। সকলে রাষ্ট্রের আশীর্বাদ পেয়ে লাভবান হতে চাইত। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন এই সক্রেটিস।
তখন জনজীবনে ধর্ম বা ঈশ্বরের প্রভাব ছিল প্রবল। মানুষ থেকে রাষ্ট্র, সকলেই ঈশ্বর বা ধর্মকে সমীহ করে চলত। কিন্তু সক্রেটিস ছিলেন ঠিক বিপরীত পথের পথিক। যুক্তি দিয়ে ধর্ম বা ঈশ্বরের প্রভাবকে দৃঢ় ভাবে খণ্ডন করে যেতেন। যেমন একবার এই ধর্ম বা ঈশ্বরের প্রভাব নিয়ে তাঁর তুমুল তর্ক বেঁধে গিয়েছিল ইউথ্রিফ্রোনের সঙ্গে। ইউথ্রিফ্রোনকে তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘‘পুণ্য কাজ বলতে কী বোঝায়? আমাকে বুঝিয়ে দিতে পারবে ইউথ্রিফ্রোন?’’
জবাবে ইউথ্রিফ্রোন বলেছিলেন, ‘‘যে সব কাজ দেবতাদের ভালো লাগে, দেবতারা যে সব কাজ পছন্দ করেন, সেইসব কাজকেই পুণ্য কাজ বলা যেতে পারে।’’
তখন সক্রেটিস প্রশ্ন করেছিলেন, ‘‘কিন্তু, দেবতাদের কোন কাজ ভালো লাগে, তা আমরা বুঝব কেমন করে? দেবতা তো সংখ্যায় একজন নন, অনেক। সব দেবতার ভালো লাগা বা পছন্দ এক নাও হতে পারে। একজন দেবতার যে কাজ ভালো লাগে, তা অন্য কোনও দেবতার ভালো নাও লাগতে পারে। তা হলে আমরা বলতে পারি, একই কাজ কখনও পুণ্য, আবার কখনও নয়!’’
সক্রেটিসের কথা শুনে রেগে গিয়েছিলেন ইউথ্রিফ্রোন। বলেছিলেন, ‘‘যে সব কাজ পুণ্য, সেইসব কাজই দেবতাদের ভালো লাগে।’’
ইউথ্রিফ্রোনকে রেগে যেতে দেখে হেসে ফেলেছিলেন সক্রেটিস। বলেছিলেন, ‘‘তা হলে আমরা পুণ্য কাজকেই একটা স্বতন্ত্র গুণ হিসেবে ধরে নিতে পারি! তাই কোনও কাজ পুণ্য বা সৎ হলে তা দেবতাদের ভালো লাগে। তার মানে কী দাঁড়াল? দেবতাদের ভালো লাগে বলেই তাকে আমরা পুণ্য কাজ বলতে পারি না। ইউথ্রিফ্রোন, এবার আমায় তুমি বলো, পুণ্যের স্বরূপটা তা হলে কী দাঁড়াল?’’
ইউথ্রিফ্রোন কম বুদ্ধিমান ছিলেন না। তিনি বুঝে গিয়েছিলেন সক্রেটিস যুক্তির কোন দিকে যাচ্ছেন! তাই আর কথা না বাড়িয়ে বলেছিলেন, ‘‘অন্য একদিন না হয় এ–সব নিয়ে আলোচনা করা যাবে। আজ থাক। আজ আমার কাজ আছে। আমি চলি।’’ বলে আর দাঁড়াননি ইউথ্রিফ্রোন। সোজা কথায়, পালিয়ে বেঁচেছিলেন।
এমনই ছিলেন গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস। আসলে এ ভাবে যুক্তির কঠিন মানদণ্ডে জীবনকে বিচার করে তিনি সত্যকে খুঁজতে চাইতেন। বলা বাহুল্য, রাষ্ট্রের তখন তা ভালো লাগেনি। লাগার কথাও নয়। কিন্তু— আজও লাগে কি?
যাক সে কথা। আবার ফিরে আসি তোমার কথায়। কত ঘটনার কথাই না এই মুহূর্তে আমার মনে পড়ছে। বিশেষ করে সেদিনের সেই ঘটনাটা। সেই প্রথম।
অনসূয়া, তোমার কি মনে পড়ছে?
ওহো, কী করে মনে পড়বে তোমার? তুমি তো আমাকে ভুলেই গিয়েছ! তা হলে আমার সঙ্গে যে ঘটনা ঘটেছিল, সেই ঘটনার কথাই বা কী করে তোমার স্মৃতির আগল খুলে দেবে?
সেই ঘটনা, বা তার পরে ঘটনার পর ঘটনা এবং আমি, এ সবের কীই বা মূল্য আছে তোমার কাছে? আমি তো খুবই সাধারণ একটি ছেলে। তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনাই তো তোমার কাছে সাধারণ কিছু মলিন অতীত ছাড়া আর কিছু নয়।
তবু, আমার সেইসব ঘটনা সবই মনে পড়ে যাচ্ছে এখন। বিশেষ করে প্রথম দিকের সেই ঘটনাটা। ইউনিভার্সিটিতে তখন আমরা ফিলজফিতে এমএ করছি। ছ’জনের একটা দল ছিল আমাদের। চারজন মেয়ে। তুমিই ছিলে সব থেকে সুন্দরী। এবং, মধ্যমণি।
আমি খুবই লাজুক ছিলাম। না, সম্ভবত ভুল বললাম। আমি ছিলাম ভীরু। কাপুরুষ। কারও চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারতাম না। মেয়েদের তো নয়ই। আর তোমার দিকে তাকাতে আমার ভয়ই করত। তোমার রূপের আগুন আমায় দগ্ধ করত। আমার মাথা নত করে দিত। আমি তাকিয়ে থাকতাম তোমার পায়ের দিকে।
আমার তখনকার অবস্থার কথা এখন মনে করলে তোমার হয়তো মনে পড়বে পাবলো নেরুদার কথা। ‘ইওর ফিট’ কবিতায় তিনি লিখেছিলেন, ‘হোয়েন আই ক্যাননট লুক অ্যাট ইওর ফেস / আই লুক অ্যাট ইওর ফিট।’
যদিও এ–সব মনে করে আজ কোনও লাভ নেই। তবু মনে পড়ছে। আমার সেই সঙ্কোচ বা ভীরুতা তোমার সামনে আমাকে কেমন যেন বোকা বানিয়ে দিত। অবশ্য সুযোগ পেলেই আমি লুকিয়ে তোমাকে দেখতাম। ক্লাসে সবাই যখন বইখাতা নিয়ে ব্যস্ত, ব্যস্ত অধ্যাপকের বক্তব্য শুনতে, আমি তখন গোপনে দেখে যেতাম তোমাকে। নীরবে। সন্ত্রাসবাদীর মতো। (ক্রমশ)