কক্সবাজারের বরেণ্য শিক্ষাবিদ, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, লেখক, গবেষক, রামু কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ মোশতাক আহমদ ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি…রাজিউন)।
মঙ্গলবার (১ ডিসেম্বর) রাত সাড়ে ১১টার দিকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। তিনি দীর্ঘদিন বার্ধ্যক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন।
সোমবার তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শারীরিক অবস্থা অবনতি হওয়ায় নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসারত অবস্থায় তিনি মারা যান।
১৯৪০ সালের ৮ জানুয়ারি রামু উপজেলার মন্ডলপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করা প্রফেসর মোশতাক আহমদের রয়েছে বর্ণাঢ্য জীবনী। তার বাবা রশিদ আহমদ সমবায় কর্মকর্তা এবং মা মুনিরা বেগম গৃহিণী ছিলেন।
তিনি ১৯৫৫ সালে রামু খিজারী হাইস্কুল থেকে মেট্রিক পাস করেন। এরপর ১৯৫৭ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬১ সালে বিএ অনার্স, ১৯৬৩ সালে ভাষা ও সাহিত্যে এমএ পাস করেন।
এরপরই সাতকানিয়া কলেজে প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবনের সূচনা করেন তিনি। পরে ১৯৬২ সালে কক্সবাজার সরকারি কলেজ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা রেখে প্রতিষ্ঠাতা প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৫ সালে পিসিএস (শিক্ষা) ক্যাডারে নির্বাচিত হয়ে ঢাকা সরকারি কলেজে প্রভাষক হিসেবে নিযুক্ত হন।
পরবর্তীতে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ, চট্টগ্রাম কলেজ, সিলেট এমসি কলেজ, চট্টগ্রাম কমার্স কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপনা করেন। ১৯৬৭ সালে কমিশন অফিসার (শিক্ষা) হিসেবে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে যোগদান দেন তিনি। মতদ্বৈততার কারণে চাকরি ত্যাগ করে ১৯৬৯ সালে সিলেট সরকারি কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন এবং ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য সরকারি চাকরি ত্যাগ করেন।
১৯৭৪ সালে চট্টগ্রামের হুলাইন সালেহ নুর কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করার পর ১৯৮৯ সাল থেকে ২০০৫ সালের ১০ এপ্রিল পর্যন্ত রামু কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। রামু খিজারী উচ্চ বিদ্যালয় ও রামু বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় শিক্ষানুরাগী সদস্য ছিলেন তিনি। এক যুগেরও বেশি খিজারী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করা মোশতাক আহমেদ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্ব দেন।
কক্সবাজারের পতন হলে বার্মায় (মিয়ানমার) আশ্রয় নেন। সেখান থেকেও শত্রুসেনাদের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেন। স্বাধীনতার পর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে (ন্যাপ-মোজাফ্ফর) যোগদান করে ওই সময় কক্সবাজার জেলা সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ন্যাপের প্রার্থী হিসেবে রামু-উখিয়া-টেকনাফ এলাকা থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার পর ১৯৭৫ সালে পার্টির পক্ষ থেকে মস্কো ভ্রমণ করেন এবং সেখানে মার্কস-লেলিনের রাজনৈতিক দর্শনের ওপর ৬ মাস গবেষণা করেন।
১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে মস্কো থেকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর সে বছর দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন, হত্যা, ক্যু ও পাল্টা ক্যু এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে রাজনীতি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন।
প্রফেসর মোশতাক আহমদ শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানের জন্য ১৯৯৮ সালে কক্সবাজার জেলা শ্রেষ্ঠ অধ্যক্ষ, ২০০৩ সালে চট্টগ্রাম বিভাগের শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান প্রধান, ২০০৩ সালে জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহে কৃতি শিক্ষাবিদ পুরস্কার এবং সাহিত্য ক্ষেত্রে অবদানের জন্য কক্সবাজার সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার অর্জন করেন।
তিনি অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন। শিক্ষা ও সাহিত্যে বিরল প্রতিভাধর এ ব্যক্তিত্বের প্রয়ানে সৃষ্টি হয়েছে বিশাল শূন্যতা। মঙ্গলবার রাতে তার মৃত্যুর খবর পেয়ে কক্সবাজার সদর হাসপাতাল এবং রামুস্থ বাড়িতে ছুটে যান শোকার্ত জনতা।
এদিকে প্রফেসর মোশতাক আহমদের জামাতা আওয়ামী লীগ নেতা জহির উদ্দিন কাজল মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, জানাজার সময় নির্ধারণ করা হয়নি। নির্ধারণ হলে জানিয়ে দেয়া হবে।