ক্লাস নয়, আমি যেন স্পষ্ট দেখতে পাই গ্রিসের একটি বিচারালয়। সেখানে সক্রেটিসের বিরুদ্ধে মারাত্মক অভিযোগ এনেছিল মেলেতস। সক্রেটিস নাকি দেবতার অস্তিত্বে বিশ্বাসী নন! তিনি নাকি যুব সমাজকে বিপথে চালিত করছেন!
উপমন্যু রায়
ফুচকাওয়ালাকে দাম দিয়ে শম্পা বলে, ‘‘জানিস, সঞ্জয় থাকলে আমাকে এ সব খাওয়ার কথা আগে থেকে বলতে হয় না। ও ঠিক বুঝে যায় আমি কী খেতে চাই!’’ ফের হেসে উঠল সে।
ইউনিভার্সিটির দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলি, ‘‘সঞ্জয় তোর মনের কথা সব বুঝতে পারে নাকি?’’
শম্পা বলে, ‘‘ঠিকঠাক ছেলেরাই মেয়েদের মন বুঝতে পারে।’’
আমার মন কেমন যেন উদাস হয়ে যায়। আপন মনে বলি, ‘‘হবে হয়তো।’’
হাঁটতে হাঁটতে শম্পা আমার দিকে জিজ্ঞাসার চোখে তাকায়। জোর দিয়ে বলে, ‘‘হয়তো নয়, সত্যি।’’
আমি কোনও কথা বলি না।
শম্পা বলে, ‘‘আমি সঞ্জয়কে খুব ভালবাসি।’’
এবারে বলি, ‘‘তোর কথা শুনে সেটা বুঝতে পারছি।’’ একটু থেমে বলি, ‘‘কোথায় থাকে ও? কী করে?’’
শম্পা বলে, ‘‘থাকে গোলপার্কে। আইটি সেক্টরে কাজ করে।’’
জানতে চাই, ‘‘কী করে আলাপ হল?’’
শম্পা বলে, ‘‘সঞ্জয় আমার দাদার বন্ধু। আমাদের বাড়ি হামেশাই আসত। সেই সূত্রেই আলাপ।’’
জিজ্ঞাসা করি, ‘‘বাড়ির সবাই জানে?’’
শম্পা বলে, ‘‘প্রথমে জানত না। পরে জেনেছে।’’ থেমে একরাশ হাসি মুখে ভাসিয়ে দিয়ে ফের সে বলে, ‘‘মেনেও নিয়েছে।’’
আমরা ইউনিভার্সিটির সামনে দাঁড়িয়ে পড়ি। হাসিমুখে বলি, ‘‘এটা খুব ভালো খবর শুনলাম আজ। তবে আরও আগে বলতে পারতিস!’’
শম্পা বলে, ‘‘এখন বলেই বা কী অন্যায় করলাম?’’
বলি, ‘‘আগে বললেও কোনও ক্ষতি হত না।’’
শম্পা বলে, ‘‘হয়তো হত না। তবে বলার মতো তেমন কোনও স্কোপ আসেনি।’’ একটু হেসে ফের বলে, ‘‘আজ তুই এ ভাবে আমার সঙ্গে ফুচকা না খেলে হয়তো কখনও বলতামও না! ব্যাপারটা তোরা টেরও পেতিস না।’’
আমিও হাসি। বলি, ‘‘তা হলে লুকিয়ে বিয়ে করে ফেলতিস নাকি?’’
শম্পা বেশ জোরে হেসে ওঠে। বলে, ‘‘তা কেন? বিয়ের সময় নিশ্চয়ই বলতাম। তোদের তো নিমন্ত্রণ করতেই হত। তাই একেবারে বিয়ের আসরেই সব জানতে পারতিস!’’
আমি কৃত্রিম রাগ করে বলি, ‘‘সেটা ভালো হত না।’’
শম্পা হাসতে হাসতে বলে, ‘‘তাতে আমার বয়েই যেত!’’
আর কথা বাড়াই না। বলি, ‘‘চল, এবার ঢুকি। না হলে ক্লাসটাই হয়তো এবার মিস হয়ে যাবে।’’
শম্পা হাসে। বলে, ‘‘এখনও পাঁচ মিনিট দেরি আছে।’’
বলি, ‘‘তিনতলায় উঠতে আর ক্লাস ঢুকতে পাঁচ মিনিট কেটে যাবে।’’
আমরা ইউনিভার্সিটিতে ঢুকে যাই।
ক্লাসে গিয়ে বসি। পুরো ঘর ভর্তি। আমাদের গ্রুপের সবাই এসেছে। তবে স্যর এখনও ঢোকেননি। তাই নানা জনের নানা কথায় গোটা ঘর গমগম করছে।
…কিন্তু ক্লাস নয়, আমি যেন স্পষ্ট দেখতে পাই গ্রিসের একটি বিচারালয়। সেখানে সক্রেটিসের বিরুদ্ধে মারাত্মক অভিযোগ এনেছিল মেলেতস। সক্রেটিস নাকি দেবতার অস্তিত্বে বিশ্বাসী নন! তিনি নাকি যুব সমাজকে বিপথে চালিত করছেন!
কিন্তু মেলেতসের অভিযোগ মানতে রাজি ছিলেন না সক্রেটিস। সমস্ত অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছিলেন। মেলেতসের দিকে তাকিয়ে পরিষ্কার বুঝতে পারছিলেন তাঁর ওপর তার এত রাগ কেন! তাই নিজের যুক্তিকেই আশ্রয় করেছিলেন মেলেতসের ভুল ভাঙাতে। হাসিমুখে তিনি বলেছিলেন, ‘‘বুঝলে মেলেতস, সবাই বলে আমি নাকি জ্ঞানী। আমি অবশ্য তা মনে করি না। কেন না আমি বিশ্বাস করি, ঈশ্বরই একমাত্র জ্ঞানী পুরুষ।’’
তবে মেলেতস আর সক্রেটিস তো এক ব্যক্তি নন। তাই সক্রেটিস ঠিক কী বলতে চাইছেন, বুঝতে পারল না মেলেতস। ভুরু কুঁচকে সে তাকিয়ে রইল তাঁর দিকে।
সক্রেটিস বললেন, ‘‘আমার সম্পর্কে ঈশ্বর মোটেই দৈববাণী করেননি যে, আমিই জ্ঞানী। তিনি হয়তো বলতে চেয়েছিলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সে–ই সব থেকে জ্ঞানী, যে সক্রেটিসের মতো জানে।’ বুঝলে?’’
সক্রেটিসের কথার জালে জড়িয়ে যায় বিচারালয়ের সকলেই। সক্রেটিস যে যুক্তির কোন দিকে যেতে চাইছেন, কেউই বুঝতে পারে না। তাই কিছু বলতেও পারে না।
কিন্তু সক্রেটিস বলে চলেন, ‘‘বলো তো মেলেতস, সক্রেটিস কী জানে? শোনো, সক্রেটিস জানে, সত্য সত্য–ই। তার জ্ঞানের মূল্য আদৌ কিছু নয়। তাই ঈশ্বরেরই নির্দেশে আমি জ্ঞানী মানুষ খুঁজে চলেছি। যারা নিজেদের খুব জ্ঞানী বা পণ্ডিত মনে করে, তাদের একটু পরীক্ষা করে দেখি। কিন্তু সেই পরীক্ষাতেই প্রমাণ হয়ে যায়, তারা মোটেও জ্ঞানী নয়।’’
সক্রেটিসের কথায় উপস্থিত সকলের মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। তিনি যে যুক্তির কোন জাল ছড়িয়ে দিতে চাইছেন, তা কেউই বুঝতে পারে না।
সক্রেটিস তখন জানতে চেয়েছিলেন, ‘‘আমার বিরুদ্ধে তোমার প্রধান অভিযোগ কী মেলেতস?’’
মেলেতস তখন জোর দিয়ে বলেছিল, ‘‘তুমি নাস্তিক।’’
সক্রেটিস প্রশ্ন করেছিলেন, ‘‘আমার সম্পর্কে তোমার এমন মনে হওয়ার কারণ কী?’’
মেলেতস বলেছিল, ‘‘কারণ আছে সক্রেটিস। কারণ, রাষ্ট্র যে সব দেবতার অস্তিত্বে বিশ্বাস করে, সেইসব অস্তিত্বে অবিশ্বাস করতে তুমি যুব সমাজকে শিক্ষা দাও।’’
সক্রেটিস নির্বিকার ভাবে বলেছিলেন, ‘‘তার পর?’’
মেলেতস বলেছিল, ‘‘তার পর নতুন নতুন দৈব শক্তির আমদানি করো তুমি। আর সেই শক্তিগুলিকে বিশ্বাস করতে পরামর্শ দাও সবাইকে। এ ভাবেই সমাজকে তুমি খারাপ পথে চালিত করছ। ক্রমাগত নীতিভ্রষ্ট করে চলেছ।’’
সক্রেটিস তখন পাল্টা বলেছিলেন, ‘‘তুমি ঠিক কী বলছ, আমি বুঝতে পারছি না মেলেতস। আমি যদি যুব সমাজকে নতুন নতুন দৈবিক শক্তিতে বিশ্বাস করতে শেখাই, তা হলে আমাকে নাস্তিক বলছ কী করে? সেই অভিযোগেই বা আমাকে অভিযুক্ত করছ কোন যুক্তিতে?’’
মেলেতস ছাড়ার পাত্র নয়। ফের বলেছিল, ‘‘আসলে তুমি কোনও দেবতার অস্তিত্বেই বিশ্বাস করো না।’’
সক্রেটিস হেসে উঠেছিলেন। বলেছিলেন, ‘‘বড় অদ্ভুত অভিযোগ করছ মেলেতস!’’
একটু চেঁচিয়েই বলে উঠেছিল মেলেতস, ‘‘কী বলতে চাইছ তুমি? আমাকে তুমি কি মূর্খ মনে করো?’’
সক্রেটিস মুচকি হেসেছিলেন। এক মুহূর্ত চুপ থেকে ফের বলেছিলেন, ‘‘হ্যাঁ, যে কথা বলছিলাম—।’’
মেলেতস প্রশ্ন করেছিল, ‘‘আগে বলো, আমাকে কি তুমি মূর্খ মনে করো?’’
সক্রেটিস বলেছিলেন, ‘‘আমি কিছুই মনে করি না। কারণ, আমি সে কথা একবারও বলিনি! আমার কথা কি শুনবে?’’
মেলেতস তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলেছিল, ‘‘বলো।’’
সক্রেটিস বলেছিলেন, ‘‘তুমি একবার বলছ, আমি দেবতার অস্তিত্বে বিশ্বাস করি না। আবার পরক্ষণেই বলছ, করিও। মানে, দৈব শক্তি সংক্রান্ত বিষয়ের অস্তিত্বে আমার বিশ্বাস আছে। কিন্তু মেলেতস, পৃথিবীতে এমন কোনও মানুষ কি আছে, যে মানুষ সম্পর্কিত বিষয়ের অস্তিত্ব বিশ্বাস করে, অথচ মানুষের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না?’’
মেলেতস কোনও কথা বলেনি। চুপ করে দেখছিল সক্রেটিসকে। হয়তো বোঝার চেষ্টা করছিল।
সক্রেটিস বলেছিলেন, ‘‘এটা যেন অনেকটা ঘোড়সওয়ারির অস্তিত্বে বিশ্বাস করে, কিন্তু ঘোড়ার অস্তিত্বে বিশ্বাস না করার মতো। এবার বলো মেলেতস, এখানে কে এমন আছে, যে দৈবিক শক্তির অস্তিত্বে বিশ্বাস করে, অথচ দেবতার অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না?’’
ঘাড় নেড়ে মেলেতস বলেছিল, ‘‘কেউ নেই।’’
সক্রেটিস বলেছিলেন, ‘‘অথচ তুমি বলছ, আমি নাকি যুব সমাজকে নতুন নতুন দৈব শক্তিতে বিশ্বাস করতে বলি। তার মানে আমি দৈব জীবে বিশ্বাস করি। আর এই দৈব জীবরা হয় নিজেরাই দেবতা, নতুবা দেবতাদের সন্তান–সন্ততি। এ কথা তুমি বিশ্বাস করো তো?’’
মেলেতসের জবাব ছিল, ‘‘করি।’’
সক্রেটিস তখন প্রশ্ন করেছিলেন, ‘‘তা হলে তুমি কী করে বলছ যে, আমি দেবতাদের অস্তিত্বে বিশ্বাস করি না? এখানে যাঁরা আছেন, তাঁরা আশা করি সকলেই স্বীকার করবেন, যারা দেবতার অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না, তারা দেবতাদের সন্তান–সন্ততিদের অস্তিত্বেও বিশ্বাস করতে পারে না!’’
এ ভাবেই যুক্তিতে তিনি মেলেতসকে ধরাশায়ী করেছিলেন। যদিও বিচারে তিনি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারেননি। আরও নিখুঁত ভাবে বললে বলতে হবে, রাষ্ট্রের কাছে তাঁকে নির্দোষ প্রমাণ করতে দেওয়া হয়নি। (ক্রমশ)