বিশেষ সংবাদদাতা:
প্রত্যাশা মতোই কলকাতা পুরসভার প্রশাসক বোর্ডের মাথায় বসলেন মেয়র ফিরহাদ হাকিম। বুধবারই প্রশাসক হিসেবে ফিরহাদের নাম চূড়ান্ত করে ফেলেছিল রাজ্য সরকার। বৃহস্পতিবার আনুষ্ঠানিক ভাবে তাঁর নাম ঘোষণা করা হয়। শুক্রবার তিনি প্রশাসক হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন। প্রশাসক বোর্ডে রয়েছেন ডেপুটি মেয়র অতীন ঘোষও। কলকাতা হাইকোর্ট পুরসভার এই প্রশাসক বোর্ডকে ‘কেয়ার টেকার বোর্ড’ হিসেবে চিহ্নিত করে একমাসের জন্য কাজ করার অনুমতি দিয়েছে।
কিন্তু রাজ্য সরকার প্রশাসক নিয়োগের নির্দেশ দেওয়ার পরই বিতর্ক তৈরি হয় রাজ্যের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মহলে। মুখ খোলেন স্বয়ং রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়। এদিন টুইট করে তিনি জানান, রাজ্য সরকারের এই নির্দেশ নিয়ে তিনি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে পূর্ণাঙ্গ তথ্য জানতে চেয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী মুখ্যমন্ত্রীর কর্তব্য রাজ্যপাল হিসেবে আমাকে এ বিষয়ে সমস্ত তথ্য দেওয়া।’ রাজ্যপাল জানান, প্রথমে তিনি মুখ্যসচিবের কাছে তথ্য জানতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি কোনও জবাব দেননি। তাই তিনি মুখ্যমন্ত্রীর কাছেই বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চেয়েছেন।
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, পুরসভার প্রশাসক নিয়োগ নিয়ে কেন তথ্য জানতে চাইলেন রাজ্যপাল? জানা গিয়েছে, মুখ্যসচিবের কাছে তিনি জানতে চেয়েছিলেন, ৬ মে কলকাতা পুরসভা নিয়ে কোনও নোটিশই তিনি পাননি। অথচ তাঁর নামে নোটিশ পাঠানো হয়েছে। সংবাদ মাধ্যমের কাছ থেকে তাঁকে সমস্ত তথ্য পেতে হচ্ছে, রাজ্য সরকার কিছুই জানাচ্ছে না। রাজভবনে রাজ্য সরকারের তরফে যেন এই বিষয়ে সমস্ত তথ্য পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে রাজ্য সরকারকে তিনি আইন মেনে চলার পরামর্শও দিয়েছেন।
এদিকে, প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগেই বৃহস্পতিবার ফিরহাদ হাকিম পরিষ্কার জানিয়ে দেন, কাউন্সিলরদেরও প্রশাসনিক বোর্ডে রাখা হচ্ছে। এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে কাউন্সিলরদের প্রয়োজন রয়েছে। একজন কাউন্সিলর একটি ওয়ার্ডে যে পরিষেবা দিয়ে থাকেন, তা কোনও আধিকারিককে দিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। করোনা মোকাবিলায় কাউন্সিলররা পুরসভাকে সাহায্য করবেন।’ পাশাপাশি তিনি এ কথাও জানান, প্রশাসনিক বোর্ডে মেয়র পারিষদরাও থাকবেন। কিন্তু ফিরহাদ হাকিমের এই মন্তব্য মানতে পারেনি বিরোধী দলগুলি। তার পরই রাজনৈতিক বিতর্ক শুরু হয়ে যায় কলকাতায়।
উল্লেখ্য, বুধবার রাতে প্রশাসক হিসেবে ফিরহাদ হাকিমের নাম রাজ্য সরকার চূড়ান্ত করে ফেলার খবর সূত্র মারফত প্রকাশ্যে আসতেই সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছিল সিপিএম। প্রথম মুখ খোলেন প্রাক্তন মেয়র তথা সিপিএম নেতা বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য। রাজ্য সরকারের এই সিদ্ধান্তকে পুরোপুরি অসাংবিধানিক বলে উল্লেখ করেন তিনি। বিকাশবাবু বলেন, ‘এই ঘটনা সংবিধানের মূল ভিত্তির বিরোধী। প্রশাসক নিয়োগের বিষয়ে রাজ্য সরকার দলবাজি করেছে।’
বৃহস্পতিবার সারাদিনই এই ঘটনা ঘিরে সরগরম হয়ে ওঠে রাজ্যের রাজনীতি। বামফ্রন্টও প্রশাসক হিসেবে ফিরহাদ হাকিমের নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তোলে। বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু বলেন, ‘সরকারের এই সিদ্ধান্তে গণতন্ত্র বিপদের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্টের কথা উল্লেখ করে যে ভাবে প্রশাসনিক বোর্ডের কথা সরকার ঘোষণা করছে বাম দলগুলি তার বিরোধিতা করছে।’
এই পুর–প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার তীব্র সমালোচনা করে বিজেপিও। দলের নেতা সায়ন্তন বসু বলেন, ‘অনৈতিক ভাবে পুর বোর্ডকেই কার্যত সম্প্রসারিত করা হয়েছে। রাজ্য সরকারের এই পদক্ষেপকে সমর্থন করা যায় না।’ এর পর মুখ খোলেন স্বয়ং বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। তিনি বলেন, ‘রাজ্য সরকার কলকাতা পুরসভার আইন লঙ্ঘন করেছে। সরকারি নির্দেশনামার ভিত্তিতে এই প্রশাসক বসানো হয়েছে। আমরা আইনের পথেই এই অন্যায়ের মোকাবিলা করব।’
অন্যদিকে, এই বিতর্ক গড়ায় হাইকোর্টেও। কলকাতা পুরসভার এই প্রশাসনিক বোর্ডকে ‘কেয়ার টেকার বোর্ড’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে কলকাতা হাইকোর্ট। সেই সঙ্গে এই বোর্ডকে একমাসের জন্য কাজ করার সুযোগ দিয়েছে বিচারপতি সুব্রত তালুকদারের বেঞ্চ। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এই মামলার শুনানি হয়। তবে সেই শুনানিতে রাজ্য সরকারের তরফে কেউ উপস্থিত ছিলেন না। কিন্তু বর্তমান করোনা পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে কলকাতা পুরসভা যাতে কাজ চালিয়ে যেতে পারে, সেইজন্য এই অন্তর্বর্তী নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট।