বাংলাভাষায় পড়বেন ইঞ্জিনিয়ারিং, ডাক্তার, টেকনোলজি, কথা দিলেন মোদি
বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা: ‘আমি মিঠুন চক্রবর্তী। আমি গর্বিত আমি বাঙালি। মনে রাখবেন, আমি কোনও জায়গা থেকে কখনও পালিয়ে যাইনি। আমি যা বলি, তা–ই করে দেখাই।’ কলকাতার ব্রিগেডে লক্ষ লক্ষ মানুষের সামনে এ ভাবেই ফুঁসে উঠলেন মুম্বইয়ের হিন্দি সিনেমার একদা বাঙালি সুপারস্টার মিঠুন চক্রবর্তী। আর এদিনের সভামঞ্চেই তিনি যোগ দেন গেরুয়া শিবিরে। তাঁকে দলের তরফে উত্তরীয় পরিয়ে দেন রাজ্য সম্পাদক দিলীপ ঘোষ ও কেন্দ্রীয় নেতা কৈলাস বিজয়বর্গীয়। পরে বিজেপিতে যোগ দেওয়ার জন্য ওই মঞ্চেই মিঠুনকে অভিনন্দন জানান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
উল্লেখ্য, মিঠুনের সঙ্গে বিজেপির যোগাযোগ নিয়ে কয়েকদিন ধরে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা অপপ্রচার চলছে। কিছু বাম মনোভাবাপন্ন মানুষ ওই অপপ্রচার শুরু করে দিয়েছেন। সেই সঙ্গে তৃণমূলের তরফেও কেউ কেউ বাঁকা কথা বলছিলেন। সে–সব কিছুই তাঁর চোখ এড়ায়নি। বিশেষ করে তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায় এদিন তাঁকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলে উল্লেখ করেছেন। এদিন ব্রিগেডের সভায় তিনি যেন সে কথারই উত্তর দিলেন সোজা সাপ্টা। বললেন, ‘আমি জলঢোড়াও নই, বেলোবোড়াও নই। আমি একটা কোবরা।’ তাঁর স্পষ্ট কথাই ছিল, ‘আমি জাত গোখরো। এক ছোবলে ছবি। এবার কিন্তু সেটাই হবে।’ এখানেই থেমে যাননি তিনি। বলে দেন, ‘এখনও অনেক কিছু বাকি আছে। অপেক্ষা করুন। আমার প্রতি বিশ্বাস রাখবেন। ভরসা রাখবেন। আজকের দিনটা স্বপ্নের মতো।’ উপস্থিত জনতা করতালি দিয়ে তাঁকে স্বাগত জানায়। এদিনের সভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী মঞ্চে এলে তাঁকে উত্তরীয় দিয়ে স্বাগত জানাতে দিলীপ ঘোষের পাশাপাশি মিঠুন চক্রবর্তীকেও অনুরোধ করা হয়। মিঠুন প্রধানমন্ত্রীকে উত্তরীয় পরিয়ে দেন। সভা শেষ হলে মিনিট পনেরো তাঁর সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী। দু’জনের মধ্যে কী কথা হয়েছে, তা অবশ্য জানা যায়নি।
তবে প্রধানমন্ত্রী ও মিঠুনের বৈঠকের পরই রাজনৈতিক মহলে জল্পনা শুরু হয়, তা হলে কি তাঁকেই বিজেপি বাংলায় মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী করে নির্বাচনে যাচ্ছে? উত্তরটা এখনও পাওয়া যায়নি। তবে মিঠুন এদিন অনেকটাই খোলামেলা ছিলেন। তবে কোনও ব্যক্তির বিরুদ্ধে আঙুল তোলেননি তিনি। সন্ধ্যায় রিপাবলিক টিভিতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারেও তিনি বলেন, ‘কোনও ব্যক্তিকে আক্রমণ করা আমার লক্ষ্য নয়। আমার কাছে রাজ্য আগে। তার পর দল। শেষে আমি।’ তাঁর নামে দুর্নীতির অভিযোগ যে টিকবে না, সে কথাই যেন মনে করিয়ে দেন ওই সাক্ষাৎকারে। বলেন, ‘পশ্চিমবাংলায় আমার এক ইঞ্চিও জমি নেই। আমি এখানে এলে আমার আত্মীয়ের বাড়িতে থাকি, না হলে হোটেলে থাকি।’ স্পষ্ট বলেন, ‘আমাকে যদি কেউ সুবিধাবাদী প্রমাণ করে দিতে পারেন, আমি কারও থেকে এক টাকা সুবিধা নিয়েছি, তা যদি কেউ প্রমাণ করে দিতে পারেন, তা হলে আমি তখনই এখান থেকে চলে যাব।’
উল্লেখ্য, পশ্চিমবাংলায় বারবার তিনি ছুটে এসেছেন সাহায্যের হাত বাড়িয়েই। তা থ্যালাসেমিয়াই হোক, বা দুর্গত মানুষের সাহায্যের জন্য, তিনি বারবার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন বিনাদ্বিধায়। পাশাপাশি গোটা ভারতে সর্বোচ্চ করদাতা হিসেবে তিনি বেশ কয়েকবার কেন্দ্রীয় সরকারের সম্মানও পেয়েছেন। এক সময় তৃণমূলের তরফে রাজ্যসভার সাংসদ করা হয় তাঁকে। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর অপর সাংসদ কুণাল ঘোষের উদ্যোগে একটি বেসরকারি চ্যানেলের অনুষ্ঠানে অংশ নেন। তার পরই তাঁর সঙ্গে চিটফান্ডের যোগ নিয়ে ইডি তলব করে। ঘটনাটি তাঁর আত্মসম্মানে আঘাত করে। তিনি জানান, তিনি সম্পূর্ণ দক্ষিণাও পাননি ওই চ্যানেলের কাছ থেকে। তবু যে–টুকু পেয়েছিলেন, তাও ফিরিয়ে দেন সরকারকে। এর পরই তিনি তৃণমূলের সঙ্গে দূরত্ব বাড়াতে শুরু করেন। সেই সময় পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বেশ কয়েকবার বলেছিলেন, তিনি ফোন করলেও নাকি মিঠুন আর তাঁর ফোন ধরেন না। জবাবও দেন না।
সেখানেই শেষ নয়, মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার অনেক আগেই রাজ্যসভার সাংসদ পদও তখন তিনি ছেড়ে দেন। তাই তাঁর বিরুদ্ধে কোনও দলের কাছ থেকে সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ টেকে না বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল। সেই ইঙ্গিত দিয়েই তিনি বলেন, ‘আমি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কখনও বলিনি, আমাকে রাজ্যসভার সাংসদ করুন। তিনিই করেছেন। এর আগেও তিনি আরও একবার আমাকে রাজ্যসভায় পাঠাতে চেষ্টা করেছেন। আমি রাজি হইনি।’ তবু তিনি সাংসদ হয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘ওটা আমার একটা বাজে সিদ্ধান্ত ছিল। ব্যস, এখানেই সব কথা শেষ।’ শুধু তাই নয়, নিজের রাজনীতি যোগ নিয়ে স্বীকার করে নিয়ে জানান, এক সময় তাঁর সঙ্গে নকশাল ঘনিষ্ঠতা ছিল। পরে বাংলায় বাম জমানায়ও তাঁর সঙ্গে রাজ্য সরকারের ঘনিষ্ঠতা ছিল। সেই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন জ্যোতি বসু। তাঁকে আমি শ্রদ্ধা করতাম। সুভাষ চক্রবর্তীও মানুষের জন্য কাজ করতাম। তাই আমার সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ ছিল। তবে আমি কখনও সিপিএমে যোগ দিইনি।’
এদিন ব্রিগেডের সভায় প্রধান বক্তা ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তাঁর কথায় বারবার উঠে আসে বাংলায় উন্নয়নের প্রসঙ্গ। দশ বছর ধরে রাজ্যে কোনও উন্নয়ন হয়নি বলে অভিযোগ করেন তিনি। বলেন, ‘এখানে প্রচার চলছে ‘বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়’। আসলে তা নয়, বাংলা চায় সোনার বাংলা।’ তিনি পরিষ্কার বলেন, ‘তৃণমূলের খেলা শেষ, উন্নয়ন শুরু।’ তার পরই বলেন, ‘দিদি আমাকে কখনও বলছেন দৈত্য, কখনও গুণ্ডা বলছেন। আমার ওপর এত রাগ কেন দিদি? তৃণমূল দুর্নীতি করেছে বলেই রাজ্যে পদ্মফুল ফুটেছে। আর আপনি তো একজনের পিসি হয়েই থেকে গেলেন। অথচ বাংলা আপনাকে দিদি বলে সম্মান দিয়েছিল।’ রাজ্যে ক্ষমতায় এলে নতুন রাষ্ট্রীয় শিক্ষানীতি লাগু করা হবে বলেও এদিন ঘোষণা করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘ইঞ্জিনিয়ারিং, ডাক্তার, টেকনোলজি নিয়ে পড়াশোনা বাংলায় হবে। ইংরেজি না জানলেও ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন অধরা থাকবে না।’
শেষে বাম–কংগ্রেস জোটকে কটাক্ষ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এক সময় বামেরা বলতেন, কংগ্রেস আধা ফ্যাসিস্ত দল। কংগ্রেসের কালো হাত ভেঙে দাও, গুড়িয়ে দাও। আজ সেই হাত কী করে ফর্সা হয়ে গেল?’ অন্যদিকে, কংগ্রেসকে কটাক্ষ করে বলে, ‘সাঁইবাড়ির নরখাদক সিপিএম বাংলা থেকে দূর হটো। আজ কী করে সেই সিপিএম মহান হয়ে গেল?’ এদিনের সভায় ছিলেন বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারিও। তিনি বলেন, ‘নন্দীগ্রামে আমি তৃণমূল নেত্রীকে হারাবই। আজ আপনারা লিখে নিন।’ বিজেপি নেতা শমীক ভট্টাচার্য বলেন, ‘রাজ্য তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর থেকে কোনও উন্নয়নই হয়নি। লগ্নি কমেছে। শুধু ধার বেড়েছে। এক লক্ষ কোটি থেকে পাঁচ লক্ষ কোটিতে পৌঁছে গিয়েছে ধারের পরিমাণ।’ রাজ্য সম্পাদক দিলীপ ঘোষ বলেন, ‘আমি বলেছিলাম, কুড়িতে হাফ, একুশে সাফ। মিলিয়ে নেবেন, একুশেই শেষ হবে তৃণমূল।’ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় বলেন, ‘দিদি হারবেন বুঝতে পেরেই এখন যা খুশি, তাই করতে চাইছেন। বলে চলেছেন। লাভ কিছু হবে না।’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন বিজেপি সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায়ও।