বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা:
মুখ্যমন্ত্রী পদ কি হারাতে চলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? এই প্রশ্ন উঠে গেল খোদ এক প্রবীণ তৃণমূল নেতার টুইটে। আর তার জেরে চরম অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছে পশ্চিমবাংলার শাসক দলই। যদিও এখনও দলের তরফে বিষয়টি নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি। তবে তৃণমূল নেতাদের অনেকেই ঘনিষ্ঠ মহলে বলতে শুরু করেছেন, এমন মন্তব্য ওই নেতা না করলেই পারতেন!
শনিবার কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনকে আক্রমণ করে একটি টুইট করেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা অধুনা তৃণমূল নেতা যশবন্ত সিনহা। টুইটে তিনি লেখেন, ‘একটি ছোট পাখির কাছ থেকে আমি জানতে পেরেছি, পশ্চিমবাংলায় আগামী কয়েক মাসে ভোট করানোর কোনও পরিকল্পনাই নেই নির্বাচন কমিশনের। আসলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যাতে আগামী ছ’মাসে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে না পারেন, সেই প্রচেষ্টাই চলছে কমিশনের তরফে।’ কিন্তু এই টুইট করতে গিয়ে তাঁর বক্তব্যে নির্বাচন কমিশনকে যতটা না বিব্রত করা গিয়েছে, ততটাই অস্বস্তিতে তিনি ফেলে দিয়েছেন নিজের দল তৃণমূলকেই। প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে কি পশ্চিমবাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর মুখ্যমন্ত্রী থাকতে পারবেন না? কেন না, যদি ৬ মাসের মধ্যে রাজ্য বিধানসভার কোনও উপনির্বাচন না হয়, তা হলে মুখ্যমন্ত্রী পদ হারাবেন মমতা।
উল্লেখ্য, ২ মে পশ্চিমবাংলায় বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হয়। তার পর এক মাস ইতিমধ্যে কেটে গিয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে মুখ্যমন্ত্রী পদে থাকতে হলে আগামী পাঁচ মাসের মধ্যে বিধানসভার কোনও আসনের উপনির্বাচনে জিতে আসতে হবে। কারণ, সদ্য সমাপ্ত বিধানসভা নির্বাচনে নন্দীগ্রাম আসনে বিজেপি প্রার্থী শুভেন্দু অধিকারীর কাছে পরাজিত হয়েছেন স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবু তিনি মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। যেহেতু তাঁর দলে তিনিই সর্বেসর্বা এবং শেষ কথা, তাই দলে তাঁর মুখ্যমন্ত্রী হওয়া নিয়ে কোনও নেতা প্রশ্ন তোলার সাহস পাননি। তাই মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু মমতা জয়ী বিধায়ক নন। কিন্তু দেশের সংবিধানের নিয়ম মমতাকে মানতেই হবে। নিয়ম অনুযায়ী, নির্বাচনের ফল ঘোষিত হওয়ার পর ৬ মাসের মধ্যে মমতাকে ফের কোনও আসনের উপনির্বাচনে প্রার্থী হয়ে জিতে আসতে হবে। তা হলেই তিনি মুখ্যমন্ত্রী থাকতে পারবেন। না হলে ওই পদ তাঁকে হারাতে হবে।
স্বভাবতই রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন উঠেছে, এমন টুইট করলেন কেন যশবন্ত? ওয়াকিবহাল মহলের মতে, যশবন্ত সিনহা দলের পক্ষেই টুইট করেছেন। তাই নিশানা করতে গিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনকে। কারণ, পশ্চিমবাংলার বিধানসভা নির্বাচনের পর এক মাস কেটে গেলেও উপনির্বাচনগুলি নিয়ে কমিশনের মধ্যে কোনও রকম হেলদোল দেখা যাচ্ছে না। শুধু মমতা নন, রাজ্যে আরও পাঁচটি আসনে উপনির্বাচন করাতে হবে কমিশনকে। এর মধ্যে দুটি আসন মুর্শিদাবাদে। সামশেরগঞ্জ আর জঙ্গিপুর। ওই দুটি আসনে দুই অন্যতম প্রধান প্রার্থীর মৃত্যুর কারণে ভোট হয়নি। তাই ওই দুটি আসনে ভোট করাতে হবে কমিশনকে। এ ছাড়া খড়দা আসনে তৃণমূল প্রার্থী বিজয়ী হলেও তিনি করোনা সংক্রমিত হয়ে প্রয়াত হন।
এ ছাড়া আরও দু্টি আসনে বিজেপি প্রার্থী বিজয়ী হলেও তাঁরা বিধায়ক পদ ত্যাগ করেছেন। আসন দুটি হল শান্তিপুর এবং দিনহাটা। এই দুটি আসনের বিজেপি বিধায়কদের সাংসদ পদ রয়েছে। তাঁরা যদি বিধায়ক পদ রেখে দিতেন, তা হলে তাঁদের সাংসদ পদ ছাড়তে হত। সে ক্ষেত্রে ওই দুটি আসনে লোকসভার জন্য উপনির্বাচন করাতে হত। কিন্তু দুই বিজেপি নেতা তাঁদের সাংসদ পদ রেখে দিয়েছেন। তবে ওই পাঁচটি আসনে উপনির্বাচন করানোর নির্দিষ্ট কোনও সময়সীমা নেই। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে মুখ্যমন্ত্রী পদ ধরে রাখতে হলে অবশ্যই নিয়ম অনুযায়ী ৬ মাসের মধ্যে উপনির্বাচনে জিতে আসার কথা। মমতাকে প্রার্থী করার জন্য ভবানীপুর আসনে বিজয়ী তৃণমূল প্রার্থী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় ইতিমধ্যেই বিধায়ক পদ ছেড়ে দিয়েছেন। ওই আসনেই মমতা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে এখনও পর্যন্ত ঠিক হয়েছে।
কিন্তু বর্তমানে ভারত জুড়ে করোনা পরিস্থিতিতে কোনও রকম নির্বাচন করানোর পরিকল্পনা নেই কমিশনের। এর আগে এপ্রিল ও মে মাসে পশ্চিমবাংলা–সহ কয়েকটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন করাতে হয় কমিশনকে। প্রথম দিকে করোনার প্রকোপ তেমন না থাকলেও শেষের দিকে তা অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। সেই সময় নির্বাচন বন্ধ করানোর চাপও এসেছিল কমিশনের ওপর। বিভিন্ন মহলে কমিশনকে সমালোচিতও কম হতে হয়নি। তবু প্রচার ও ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়ায় নানা বিধিনিষেধ আরোপ করেও কমিশন নির্বাচন প্রক্রিয়া সমাপ্ত করে। তাই এই মুহূর্তে নির্বাচন করানোর কোনও ঝুঁকি কমিশন নিতে চায় না। তবে ভারত এবং এমনকী, পশ্চিমবাংলার করোনা গ্রাফে সংক্রমণ হার যথেষ্ট নিম্নমুখী। মনে করা হচ্ছে, আগামী এক মাসের মধ্যেই করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।
তার পর যে কোনও সময় উপনির্বাচন করাতে পারে কমিশন। কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন সূত্রে এই খবরই পাওয়া গিয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, তাই যশবন্ত সিনহার অভিযোগ সে ভাবে ধোপে টিকছে না। তা ছাড়া, উপনির্বাচনগুলি কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের সবুজ সংকেত নিয়ে সম্পূর্ণ ভাবে পরিচালনা করে রাজ্য নির্বাচন কমিশন। তাই রাজ্যের শাসক দলগুলির প্রভাবই উপনির্বাচনগুলিতে দেখা যায়। পশ্চিমবাংলার অতীতের তথ্যগুলি সেই প্রমাণই দিয়ে থাকে। স্বভাবতই রাজ্যের উপনির্বাচনে বড় ধরনের কোনও অঘটন না ঘটলে তৃণমূল কংগ্রেসই যে এগিয়ে থাকবে, তা নিয়ে কোনও সংশয়ই নেই রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের।
তাই তৃণমূলের তরফ থেকে রাজ্যে উপনির্বাচন করানো নিয়ে ইতিমধ্যেই তোড়জোড় শুরু হয়ে গিয়েছে। অন্য দলগুলি সে ভাবে এখনও উদ্যোগ নেয়নি। তবে শোনা যাচ্ছে, ভবানীপুর আসনে মমতার বিরুদ্ধে মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়কে প্রার্থী করতে পারে সিপিএম। উল্লেখ্য, নন্দীগ্রামেও মমতা এবং শুভেন্দুর বিরুদ্ধে সিপিএমের প্রার্থী হয়েছিলেন মীনাক্ষী। এদিকে, এই আসনে কোনও প্রার্থী দেবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরি। অন্যদিকে, এই আসনে কাকে প্রার্থী করবে, সে বিষয়ে বিজেপি কোনও সিদ্ধান্তই এখনও পর্যন্ত নিয়ে উঠতে পারেনি।