জনসংখ্যা বৃদ্ধির নিম্নগতির কারণে যেসব দেশ কর্মী সংকটে ভুগছে তাদের মধ্যে অন্যতম ফিনল্যান্ড৷ বর্তমানে প্রতি ১০০ জনের মধ্যে সেখানে ৩৯ দশমিক দুই জনই ৬৫ বছরের উপরে৷ বয়স্ক মানুষের হারে জাপানের পরই দেশটির অবস্থান৷
জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০৩০ সাল নাগাদ ফিনল্যান্ডে বয়স্ক মানুষের হার সাড়ে ৪৭ ভাগে ঠেকবে৷ মাত্র ৫৫ লাখ জনসংখ্যার দেশটিতে অভিবাসীর সংখ্যা দ্বিগুণ বাড়িয়ে বছরে ২০ হাজার থেকে ৩০ হাজারে উন্নীত না করলে প্রশাসনিক সেবা চালু রাখাই কঠিন হয়ে পড়বে৷ ফিনল্যান্ডের সরকারের এক পরিসংখ্যানই এমন তথ্য দিচ্ছে৷
ইউরোপের এই দেশটির প্রয়োজনীয় কর্মীর চাহিদা পূরণে অভিবাসীদের কোন বিকল্প দেখছে না চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোও৷ ট্যালেন্টেড সল্যুশন্স নামের তেমনই একটি প্রতিষ্ঠানের নিয়োগকর্তা সাকু তিহভারাইনেন৷ তিনি বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, ‘‘উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিদেশিদের ফিনল্যান্ডে সুযোগ দেয়া দরকার আমাদের৷ বিষয়টি সবার কাছেই এখন স্বীকৃত৷’’
উন্নত জীবনযাত্রা, স্বাধীনতা ও নারী-পুরুষ সমতার দিক থেকে ফিনল্যান্ডের অবস্থান বিশ্বের যেকোন দেশের চেয়ে় উপরে৷ দুর্নীতি, অপরাধের মাত্রাও যথেষ্ট কম হওয়ায় ফিনল্যান্ডের আলাদা পরিচিতি আছে৷ তাই বিশ্বের যেকোন দেশের বাসিন্দার জন্যই ফিনল্যান্ডে বসবাস আকর্ষণীয়৷ কিন্তু এর বিপরীতে অভিবাসী বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গী, উগ্র ডানপন্থি দলগুলোর রাজনৈতিক অবস্থান এবং বিদেশিদের চাকরি দেয়ার ক্ষেত্রে নিয়োগকারীদের অনীহা দেশটিতে অভিবাসী সংখ্যা বৃদ্ধির পথে প্রধান বাধা হিসেবে কাজ করছিল এতদিন৷ তবে ক্রমাগত কর্মক্ষম জনসংখ্যা কমতে থাকায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ও সরকারের ভাবনায় পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে, এমনটাই মনে করেন অ্যাকাডেমি অব ফিনল্যান্ডের গবেষণা ফেলো চার্লস ম্যাথিস৷ তিনি ‘ট্যালেন্ট বুস্ট’ নামের একটি সরকারি প্রকল্পের পরামর্শক৷ চার বছর ধরে চলমান এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য বিদেশি কর্মীদের জন্য ফিনল্যান্ডকে আরো আকর্ষণীয় করা৷
স্পেনের স্বাস্থ্যকর্মী, স্লোভাকিয়ার ইস্পাত শিল্পের কর্মী আর রাশিয়া ও ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তথ্য প্রযুক্তি ও সমুদ্র বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা প্রকল্পটির মূল লক্ষ্য৷ তবে এর আগেও এমন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছিল, সেগুলোর ফলাফল খুব একটা আশাব্যাঞ্জক নয়৷ যেমন, ২০১৩ সালে পশ্চিমাঞ্চলের শহর ভাসাতে নিয়োগ পাওয়া স্পেনের নার্সদের আটজনের পাঁচজনই কয়েক মাসের মধ্যে চাকরি ছেড়ে দেন৷ এর অন্যতম কারণ ফিনল্যান্ডের জীবন যাত্রার অত্যধিক ব্যয়, ঠান্ডা আবহাওয়া ও ভাষাগত জটিলতা৷
গত এক যুগ ধরেই ফিনল্যান্ডের অভিবাসী বৃদ্ধির হার যথেষ্ট কম৷ ২০১৯ সালে অভিবাসীর সংখ্যা সর্বসাকুল্যে বেড়েছে মাত্র ১৫ হাজার৷ পরিসংখ্যান বলছে যেসব অভিবাসী দেশটি ছেড়ে গেছেন তাদের বড় অংশই উচ্চ শিক্ষিত৷ অথচ, ওইসিডিভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে দক্ষ কর্মী সংকট সবচেয়ে বেশি ফিনল্যান্ডে৷ এর ভুক্তভোগী এখন প্রযুক্তি নির্ভর স্টার্টআপ কোম্পানিগুলো৷ তারা বাইরে থেকে কর্মী আকর্ষণে বিভিন্ন যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে৷ যেমন, খাবার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ভোল্টের সাউন রুডেন এএফপিকে বলেন, ‘‘(দক্ষ বিদেশি কর্মীদের) স্থানান্তর প্রক্রিয়া যতটা সহজ করা যায় সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি আমরা৷’’
তবে অভিবাসীদের একটি বড় অভিযোগ হল, বিদেশে অর্জিত শিক্ষাগত যোগ্যতা বা অভিজ্ঞতার স্বীকৃতি দেয়ার ক্ষেত্রে ফিনল্যান্ডের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অনীহা কাজ করে৷ যেমন, ৪২ বছর বয়সি ব্রিটেনের নাগরিক আহমেদ (নাম পরিবর্তিত) বিভিন্ন কোম্পানির জন্য ডিজিটাল মাধ্যমে কয়েক বছরের কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে৷ ৷ কিন্তু ছয় মাসের নেটওয়ার্কিং শেষে হেলসিংকিতে একটি চাকরির আবেদনে তার এই যোগ্যতা মোটেই বিবেচনায় নেয়া হয়নি৷ এমনকি চাকরিদাতা তার সঙ্গে হাত মেলাতেও রাজি হননি এমন অভিযোগও করেন তিনি৷ পারিবারিক কারণে হেলসিংকিতে পাড়ি জমানো আহমেদ বলেন, ‘‘এখানে চাকরির অভাব নেই, কিন্তু ইতিবাচক মানসিকতার অভাব৷’’
এমন পরিস্থিতি দেশটির অনেক নীতিনির্ধারকদের জন্যেও হতাশার৷ হেলসিংকির মেয়র ইয়ান ভাপাভুরির মতে চার বছর জাতিসংঘের ব়্যাকিং-এ বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশ নির্বাচিত হওয়ার পরেও দেশটির এই চিত্রে আশাব্যঞ্জক পরিবর্তন আসেনি৷ তিনি বলেন, ‘‘প্যারিস, লন্ডন রোম বা নিউ ইয়র্কের রাস্তায় মানুষকে যদি জিজ্ঞাসা করেন আমার ধারণা অনেকেই আমাদের সম্পর্কে বলতে পারবে না৷’’
তবে তার আশা ভবিষ্যতে এশিয়া থেকে মেধাবীদের আকর্ষণে সমর্থ্য হবে ফিনল্যান্ড৷ করোনা ভাইরাস পরবর্তী পৃথিবীতে দেশটির অবস্থান আগের চেয়ে আরো সংহত হবে এবং বিশ্বের মানুষের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে৷
সুত্র :ইনফোমাইগ্রেন্টস