বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা:দিল্লিতে ইজরায়েল দূতাবাসের সামনে বিস্ফোরণের জেরে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের পশ্চিমবাংলা সফর বাতিল হয়ে গিয়েছে। শুক্রবার রাতেই তাঁর কলকাতায় পৌঁছে যাওয়ার কথা ছিল। শনিবার ও রবিবার সারা দিন ঠাসা কর্মসূচি ছিল তাঁর। রবিবার রাতেই দিল্লিতে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। তাঁর সফর বাতিল হয়ে যাওয়ায় রাজ্য বিজেপি কিছুটা বিড়ম্বনায় পড়ে। এমনকী, দিশেহারাও হয়ে পড়েন রাজ্য নেতারা। তবে শনিবার দিল্লি সূত্রে পাওয়া খবরে জানা গিয়েছে, আগামী সপ্তাহেই রাজ্যে আসছেন অমিত শাহ।
আগামী সপ্তাহে তাঁর কলকাতা আসার পিছনে প্রধান কারণই হল, ঠাকুরনগরে গিয়ে মতুয়াদের নাগরিকত্ব বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের ভাবনাচিন্তার কথা পরিষ্কার জানিয়ে দেওয়া। শনিবার দিল্লি থেকে ফোনে বিজেপির রাজ্য নেতাদের এমন খবরই জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। শনিবার ঠাকুরনগরে যাওয়ার কথা ছিল তাঁর। কিন্তু তাঁর বঙ্গ সফর বাতিল হওয়ায় ঠাকুরনগরে মতুয়াদের মধ্যে একটা হতাশা দেখা দেয়। তাঁদের আশ্বাস দিতে শনিবার সেখানে যান বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা কৈলাস বিজয়বর্গীয় এবং সর্বভারতীয় সহসভাপতি মুকুল রায়। সেখানকার বিজেপি সাংসদ শান্তনু ঠাকুরের সঙ্গে তাঁরা বৈঠক করেন। সেই সময়ই তাঁদের ফোন করে আগামী সপ্তাহে কলকাতা আসার কথা জানিয়ে দেন অমিত। শুধু তাই নয়, ঠাকুরনগরের মঞ্চ যাতে না খোলা হয়, সেই নির্দেশও বিজেপি নেতাদের দেন তিনি। তার পর মোবাইলের লাউড স্পিকারে অমিত শাহ আগামী সপ্তাহে কলকাতা আসার কথা মতুয়াদের উদ্দেশ্যে জানিয়ে দেন।
এদিকে, রবিবার হাওড়ার ডুমুরজলা ময়দানে বিজেপির জনসভায় উপস্থিত থাকার কথা ছিল অমিত শাহের। সেই সভায় তৃণমূল ছেড়ে আসা শীর্ষস্তরের নেতাদের বিজেপিতে যোগ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শাহের বঙ্গ সফর বাতিল হওয়ায় তাঁদের বিজেপি যোগ দেওয়ার প্রক্রিয়া কী হবে, তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়। সেই সমস্যারও মীমাংসা করেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা। বাংলার রাজনৈতিক মহলকে চমকে দিয়ে শনিবার বিশেষ চাটার্ড বিমানে দিল্লি উড়ে যান তৃণমূল ছেড়ে আসা বিক্ষুব্ধ ৬ নেতা–নেত্রী। তাঁদের মধ্যে ৫ নেতা ও নেত্রী হলেন রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, বৈশালী ডালমিয়া, প্রবীর ঘোষাল, রথীন চক্রবর্তী এবং পার্থসারথী চট্টোপাধ্যায়। ছিলেন একদা তৃণমূল ঘনিষ্ঠ অভিনেতা রুদ্রনীল ঘোষও। নিজের বাসভবনে তাঁদের সঙ্গে বৈঠক করেন অমিত শাহ। সেখানেই আনুষ্ঠানিকভাবে গেরুয়া শিবিরে যোগ দেন এই ৬ জন। তবে রবিবার ডুমুরজলায় বিজেপির জনসভা হচ্ছেই। সেই সভায় উপস্থিত থাকতে পারেন বিজেপির জাতীয় সভাপতি জে পি নাড্ডা, অথবা কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং কিংবা কেন্দ্রীয় মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি।
ওই সভায় উপস্থিত থাকবেন তৃণমূল ছেড়ে আসা এই পাঁচজন এবং রুদ্রনীল ঘোষও। থাকবেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ এবং শুভেন্দু অধিকারী। ওই সভায় রাজ্যের বিভিন্ন দল থেকে বহু নেতা–নেত্রী বিজেপিতে যোগ দিতে পারেন বলে জানা গিয়েছে। শনিবার বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মধ্যে সমন্বয় রেখে কাজের জন্যই এই পদক্ষেপ করেছি। দুই জায়গায় এক সরকার থাকলে অনেক কাজ হবে। তাই বিজেপির হয়ে আমার পাখির চোখ এখন বাংলা দখল।’ মানুষের উন্নয়নের স্বার্থে বাংলার জন্য তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে স্পেশ্যাল প্যাকেজের দাবি জানিয়েছেন তিনি। বৈশালী ডালমিয়া বলেছেন, ‘অনেক কাজ করা বাকি রয়েছে। বালি থেকেই ফের ভোটে দাঁড়াতে চাই।’ অভিনেতা রুদ্রনীল ঘোষ বলেছেন, ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মাঠে নেমে পড়ব। মানুষের জন্য কাজ করতে হবে।’
এই ৬ জনের বিজেপিতে যোগদানের পরই মুখ খুলেছেন তৃণমূলের নেতারা। দলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেছেন, ‘যাঁরা নারদা–সহ বিভিন্ন মামলায় ফেঁসে রয়েছেন, তা থেকে রেহাই পেতেই সবাই বিজেপিতে গিয়েছেন। তবে তাতে তাঁদের যেমন কোনও লাভ হবে না, তেমনই তৃণমূলেরও কোনও ক্ষতি হবে না।’ দলত্যাগীদের ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন। দলের সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘ক্ষমতা থাকলে দলত্যাগীরা আগামী বিধানসভা নির্বাচনে নিজেদের কেন্দ্রে প্রার্থী হয়ে দেখান। মানুষ তাঁদের ঠিক উত্তরই দেবেন।’ এরই পাশাপাশি তৃণমূল সূত্রে পাওয়া আরও একটি খবরে জানা গিয়েছে, অভিনেতা হিরণ চট্টোপাধ্যায়ও নাকি বিজেপিতে যোগ দিতে চলেছেন। রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস এবং সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ হিসেবেই রাজ্য রাজনীতি এবং সংস্কৃতি মহলে হিরণ পরিচিত। আবার যুব তৃণমূলের সহ–সভাপতিও ছিলেন তিনি।
অন্যদিকে, আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি রবিবার সরকারি সফরে ফের পশ্চিমবাংলায় আসছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ওই দিন হলদিয়ায় তিনি একগুচ্ছ প্রকল্পের সূচনা করবেন। এর পরই কেন্দ্রীয় পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান চিঠি লেখেন তমলুকের সাংসদ দিব্যেন্দু অধিকারীকে। চিঠিতে প্রধানমন্ত্রীর কর্মসূচির বিস্তারিত জানান। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য তাঁকে আমন্ত্রণও জানান। উল্লেখ্য, শিল্পনগরী হলদিয়া দিব্যেন্দু অধিকারীর লোকসভা কেন্দ্র তমলুকের মধ্যেই পড়েছে। দিল্লি সূত্রে বলা হয়েছে, স্থানীয় সাংসদ হিসেবেই দিব্যেন্দু অধিকারীকে সৌজন্যতা দেখিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তবে কেন্দ্রের সৌজন্য প্রকাশকে রাজনৈতিক মহল ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ বলে মনে করছে।
এই ঘটনার প্রভাব পড়েছে তৃণমূলের অভ্যন্তরেও। প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণের পরই তিনটি কলেজের পরিচালন সমিতির সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে সাংসদ দিব্যেন্দুকে। যদিও পাল্টা দিব্যেন্দু অধিকারী বলেছেন, ‘আমি আগেই ওই তিনটি কলেজের পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে দিয়েছি। তাই আমাকে সরানোর কোনও প্রশ্নই ওঠে না।’ তবে প্রশাসনের তরফে বলা হয়েছে, সাংসদকে সরিয়ে দিয়ে প্রশাসক নিয়োগ করেছে রাজ্য শিক্ষা দফতর।