বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা: চমকে ওঠার মতোই ঘটনার কথা শোনা গেল মঙ্গলবার সরস্বতী পুজোর দিন। পশ্চিমবাংলার বাঙালি যখন ব্যস্ত বসন্ত পঞ্চমী নিয়ে, ঠিক তার আগের দিন গভীর রাতে মুম্বইয়ে এমন একটি ঘটনা ঘটল যে, তার অভিঘাত এসে সোজাসুজি পড়ল রাজ্যের রাজনীতিতে। এদিন মুম্বইয়ে এক সময়ের সুপারস্টার মিঠুন চক্রবর্তীর বাংলোয় গিয়ে হাজির হলেন স্বয়ং আরএসএস (রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ) প্রধান মোহন ভাগবত। আর সেই সংবাদ বাংলায় এসে পৌঁছনোর পর মুহূর্তেই বিষয়টি নিয়ে তীব্র জল্পনা শুরু হয়ে যায়, তা হলে মিঠুনকে কি এবার গেরুয়া চৌহদ্দিতেই দেখা যাচ্ছে?
বাংলার রাজনৈতিক মহল অবশ্য বিষয়টি যথেষ্ট সিরিয়াস ভাবেই নিচ্ছে। আর এক থেকে দেড় মাস পরেই রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। শাসক দল তৃণমূলকে এবার কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার সামনে ফেলতে চলেছে বিজেপি। কিন্তু তাদের সমস্যা হল, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিকল্প হিসেবে তারা এখনও কাউকে তুলে ধরতে পারেনি। যদিও ইতিমধ্যে শুভেন্দু অধিকারী এবং রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় যোগ দেওয়ায় দলের শক্তি অনেকটাই বেড়েছে। তবে দলের তরফে শুভেন্দুকে এখনও মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে ওঠা যায়নি। পাশাপাশি এর আগে বেশ কয়েক বছর ধরে গেরুয়া বলয়ে ভারতীয় ক্রিকেট দলের প্রাক্তন অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম ঘোরাফেরা করলেও এখনও বিষয়টি নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়নি। সৌরভের দু’বার অসুস্থ হয়ে পড়াটা এর কারণ। তবে সৌরভকে নিয়ে বিজেপির ভাবনাচিন্তা এখনও থেমে যায়নি। অবশ্য এ ব্যাপারে ভিন্ন একটি রাস্তাও খোলা রাখতে চাইছে গেরুয়া শিবির।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, তাই মিঠুন চক্রবর্তীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ। যদিও বিষয়টি নিয়ে সমস্ত রকম রাজনৈতিক জল্পনা উড়িয়ে দিয়েছেন স্বয়ং মিঠুন। তিনি স্পষ্টই বলেছেন, ‘সোমবার গভীর রাতে আরএসএস প্রধান আমার মুম্বইয়ের বাংলোয় এসেছিলেন। কিন্তু এর মধ্যে কোনও রাজনৈতিক অভিসন্ধি নেই। আমাদের মধ্যে কোনও রাজনৈতিক আলাপ বা আলোচনাও হয়নি।’ তাঁর কথায়, ‘আরএসএস–এর সঙ্ঘ চালক মোহন ভাগবতের সঙ্গে আমার আধ্যাত্মিক যোগ রয়েছে। বেশ কিছুদিন আগে লখনউয়ে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়। তখন অধ্যাত্মবাদ নিয়ে আমাদের অনেক কথা হয়। তখনই তাঁকে আমি জানিয়েছিলাম, মুম্বইয়ে আসলে তিনি যেন আমার বাড়িতে আসেন। সেইজন্যেই তিনি আমার বাড়িতে এসেছিলেন।’ এ ব্যাপারে অবশ্য সঙ্ঘ চালকের কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তিনি কোনও সাংবাদিকের সঙ্গে কথাও বলেননি। তবে সূত্রের খবর, নাগপুরে আরএসএস–এর সদর দফতরের সঙ্গে মিঠুনের যোগাযোগ রয়েছে। সেখানে মিঠুন একবার গিয়েওছিলেন।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাওয়া হলে আরএসএসের সাধারণ সম্পাদক মনমোহন বৈদ্য স্পষ্ট বলেন, ‘আরএসএস কোনও রাজনৈতিক সংগঠন নয়। মিঠুন চক্রবর্তী আরএসএসের কাজের ব্যাপারে জানতে চেয়েছিলেন। তাই আরএসএস–ও তাঁকে সে ব্যাপারে অবহিত করেছে। এর বাইরে কিছু নয়। আরএসএসের সঙ্গে কোনও সম্পর্কও তৈরি হয়নি মিঠুনের।’ আরএসএসের এই দাবি অবশ্য এক কথায় উড়িয়েও দেওয়া যাচ্ছে না। কারণ হিসেবে তথ্যাভিজ্ঞ মহল মনে করছে, বাংলার রাজনীতি নিয়ে এখন মিঠুনের কোনও আগ্রহ নেই। এক সময় তাঁর তৃণমূলের সঙ্গে সখ্যতা তৈরি হয়েছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে তৃণমূলের অনেক নেতার সঙ্গে ভালোই সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বলা যায়, তাঁদের চাপেই মিঠুন তৃণমূলে যোগ দেন। রাজ্যসভার সাংসদও হন।
কিন্তু তৃণমূলে মিঠুনের অভিজ্ঞতা মোটেও ভালো নয়। অথচ করদাতা হিসেবে মিঠুনের যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। আয়কর দেওয়ার ক্ষেত্রে বেশ কয়েক বছর তিনি গোটা ভারতে শীর্ষস্থান অধিকার করে রেখেছিলেন। এ ব্যাপারে তাঁর সততা বিভিন্ন মহলে প্রশংসিত হয়েছে। যথেষ্ট সম্মানও তিনি পেয়েছেন। কিন্তু তখন তাঁর দল তৃণমূলের অধিকাংশ নেতা ও নেত্রীর বিরুদ্ধে সারদা, রোজভ্যালি, আইকোর থেকে শুরু করে বহু চিটফান্ডের যোগাযোগের অভিযোগ নিয়ে রীতিমতো সরগরম হয়ে উঠেছিল বাংলার রাজনীতি। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করতে গিয়ে সিবিআই বেশ কয়েকজন তৃণমূল নেতাকে গ্রেফতারও করে। সেই সময় মিঠুন চক্রবর্তীকেও ইডি ডেকে পাঠায়। ওই ঘটনায় নিদারুণ বিব্রত হন মিঠুন। মানসিক দিক থেকে আঘাতও পান। তিনি বলেছিলেন, সারদার প্রযোজনায় একটি টিভি চ্যানেলের কয়েকটি অনুষ্ঠানে তিনি যোগ দিয়েছিলেন তৃণমূল সাংসদ কুণাল ঘোষের অনুরোধে। কিন্তু সেই অনুষ্ঠানগুলির বেশির ভাগেরই টাকা তিনি পাননি। অথচ চিটফান্ড মামলায় কিনা ইডি ডেকে পাঠাল সেই তাঁকেই!
এর পরই কলকাতায় আসা বন্ধ করে দেন মিঠুন। তৃণমূলের সঙ্গেও যোগাযোগ পুরোপুরি ছিন্ন করে দেন। এমনকী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও তখন আক্ষেপ করে বেশ কয়েকবার বলেছিলেন, তিনি ফোন করলেও মিঠুন নাকি তাঁর ফোন ধরেন না। সেখানেই থেমে যাননি মিঠুন। তার পর তিনি রাজ্যসভার সাংসদ পদও ছেড়ে দেন। তাই এত ঘটনার পর তিনি ফের রাজনীতিতে সহজে আসতে রাজি হবেন বলে মনে হয় না। উল্লেখ্য, তৃণমূল ক্ষমতায় আসার আগে মিঠুন চক্রবর্তীর সঙ্গে সিপিএমের ঘনিষ্ঠতার কথা সকলেরই জানা। বিশেষ করে সুভাষ চক্রবর্তীর সঙ্গে তাঁর গভীর যোগাযোগ ছিল। তবু তিনি কখনও সিপিএমে যোগ দেননি। রাজনীতিতে তিনি আসবেন না বলেই তখন তিনি জানিয়েছিলেন। পরে অবশ্য তৃণমূল দলনেত্রীর কথায় ওই দলে যোগ দেন।
কিন্তু বাংলার রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, মিঠুন চক্রবর্তী বা সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্য বিজেপি লাল কার্পেট পেতে রেখে দিয়েছে। কিন্তু মিঠুন বা সৌরভের মনের তল তারা এখনও খুঁজে পায়নি। এই দু’জনের একজনকে যদি তারা পেয়ে যায়, তা হলে সেটাই হবে তাদের তুরুপের তাস। তাই তাঁকেই তারা মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী করে নির্বাচনে যাবে। তবে বিষয়টি এখনও পরিষ্কার নয়। নির্বাচন কমিশন যতদিন না ভোটের দিন ঘোষণা করছে, তার আগে এই জল্পনা চলতেই থাকবে। এই বিষয়ে এখনই চূড়ান্ত সংবাদ পাওয়া যাবে না।