বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা : অবশেষে মুখ খুললেন শিশির অধিকারী। অধিকারী পরিবারকে যাঁরা প্রতিনিয়ত চোখা চোখা বাক্যবাণে আক্রমণ করে চলেছেন, তাঁদের উদ্দেশ্যে স্পষ্ট বলে দিলেন, ‘মেদিনীপুরের মানুষ ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে জবাব দেবে।’ ছেলে শুভেন্দু অধিকারী ১৯ ডিসেম্বর বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পরই তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক প্রশ্নবাণ ধেয়ে আসছে তৃণমূল শিবির থেকে। গোটা অধিকারী পরিবারকে আক্রমণ করে কখনও বলা হচ্ছে ‘বেইমান’, আবার কখনও বলা হচ্ছে ‘মিরজাফর’। অধিকারী পরিবারের কর্তা হিসেবে স্বভাবতই সেই আক্রমণগুলি গিয়ে সরাসরি আঘাত করেছে শিশিরবাবুকে। নতুন ইংরেজি বছরের প্রথম দিনেই তিনি তার জবাব দিলেন একেবারে সরাসরি।
উল্লেখ্য, শুভেন্দু অধিকারীর বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর সমস্ত বিতর্ক এক কথায় এড়িয়েই যাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু তৃণমূলের শীর্ষনেতারা যে ভাবে তাঁর পরিবারকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন, তাতে রাজনৈতিক মহলের অনুমান, তাঁরা মনে করছেন, পুরো অধিকারী পরিবারই বিজেপিতে যোগ দেবে। এর মধ্যে বুধবার শিশিরবাবুর সঙ্গে ‘সৌজন্য সাক্ষাৎ’ করে আসেন বিজেপি সাংসদ জ্যোতির্ময় মাহাতো। তার পরই নতুন করে জল্পনা শুরু হয়ে যায় তৃণমূলের অন্দর মহলে। শুক্রবার শিশিরবাবুর আর এক ছেলে সৌমেন্দু অধিকারী বিজেপিতে যোগ দেন। বুধবার কাঁথির পুরপ্রশাসকের পদ থেকে সৌমেন্দু অধিকারীকে সরিয়ে দেয় তৃণমূল। দলের এই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে যান সৌমেন্দু। হাইকোর্ট বিষয়টি হস্তক্ষেপ করবে না বললেও জানিয়ে দেয়, পুরপ্রশাসকের পদ থেকে সৌমেন্দু অধিকারীর অপসারণ অবৈধ। পাশাপাশি শিশিরবাবুর অপর পুত্র দিব্যেন্দু অধিকারী তৃণমূলের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলেন, কোন অপরাধে সৌমেন্দুকে পদ থেকে সরানো হল? সূত্রের খবর, ওই ঘটনার পরই সৌমেন্দু দলবদলের সিদ্ধান্ত নেন।
আর, সৌমেন্দুর বিজেপিতে যোগ দেওয়ার দিনই মুখ খোলেন শিশিরবাবু। শুভেন্দু তখনও বিজেপিতে যোগ দেননি। তখন থেকেই মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম তাঁকে ‘মিরজাফর’ বলা শুরু করে দেন। আর বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর গোটা অধিকারী পরিবারকেই তিনি ‘মিরজাফর’ বলে অভিযুক্ত করেন। এই আক্রমণ যে শিশিরবাবু স্বাভাবিক ভাবে নেননি, তা বোঝা গেল এদিন। সেই প্রসঙ্গটি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি যতটুকু ইতিহাস জানি, তাতে মিরজাফর তো মুসলমান ছিলেন। তা–ই তো জানতাম। অবশ্য ববি (ফিরহাদ হাকিম) খুব ভালো ছেলে। আমি সেটাই জানি। ববি ভালো থাকুক। তবে আমার পরিবারকে যদি ববি গালাগালি করে খুশি হয়, হবে। তাতে আমার বিশেষ কিছু যায় আসে না। আমার পরিবারের কথা সবাই জানে।’
এখানেই তিনি থেমে যাননি। এর পরই তাঁর কথা উঠে আসে নিজের পরিবারের কথা। বলেন, ‘আমি যখন তৃণমূলে যোগ দিই, তখন মেদিনীপুরে তৃণমূল কোথায়? তখন মেদিনীপুর ছিল অবিভক্ত। এখানে তৃণমূলের একটাও নির্বাচিত পদ ছিল না। আমি তৃণমূলে আসার পরই গোটা মেদিনীপুরে দলে দলে সবাই এসে যোগ দিতে থাকে আমাদের দলে। এখন মেদিনীপুরে তৃণমূলই সবচেয়ে বড় দল। তৃণমূলকে আজকের এই অবস্থায় আনার পর আমাকে শুনতে হচ্ছে, আমি নাকি ‘মিরজাফর’! আমি নাকি বেইমান!’ এর পরই প্রশ্ন তোলেন, ‘কিন্তু কারা তুলছে এই প্রশ্ন? দলকে আজকের অবস্থায় নিয়ে আসার পেছনে তাদের অবদান কী? মেদিনীপুরের মানুষ কিন্তু এ–সব মেনে নেবে না। ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে সবাই জবাব পাবে। জবাব দেবে মেদিনীপুরের মানুষই।’
যদি তাই হয়, তা হলে এই জেলায় মুখ্যমন্ত্রীর সভা হলেও তিনি যাননি কেন? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি সরাসরি বলেই দিলেন, ‘ওরা চাইছিল আমাকে দিয়ে ছেলের বিরুদ্ধে বলাতে।’ কারণ, হিসেবে বললেন, ‘তৃণমূলের শত্রু কে? কোনও রাজনৈতিক দল? নাকি নির্দিষ্ট কোনও নেতা?’ তা ছাড়া শুভেন্দু যে তাঁর ছেলে, সে কথাও তিনি ভুলতে পারবেন না বলে এদিন জানান। বলেন, ‘আমার ছেলের বিরুদ্ধে মঞ্চে দাঁড়িয়ে আক্রমণ করব, সেটা কি কখনও সম্ভব? কেন আমি ছেলের বিরুদ্ধে বলতে যাব? ছেলে তো আমার পরিবারের বাইরে নয়। আমার পরিবারের বড় সম্পদ!’
এর পরই চলে আসেন মূল কথায়। স্পষ্ট বলেন, ‘আমাদের পরিবারের বিরুদ্ধে আমার দল তৃণমূল যে সব কথা বলছে, তা ঠিক নয়। মমতা এখনও আমার নেত্রী। আমি তাঁর বিরুদ্ধে কোথাও একটিও কথা বলিনি। তা হলে আমার ছেলে অন্য দলে গিয়েছে বলে আমার পরিবারকে অপরাধী করে দেওয়া হবে? ব্যাপারটা ঠিক হচ্ছে না। আমাদের পরিবারের অপমানের জবাব ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে দেবেন মেদিনীপুরের মানুষ।’