…একটু দেরি করে বিষ খেলে আমার কোনও লাভ হবে না। কেন না, বিষ তো শেষ পর্যন্ত আমাকে খেতেই হবে, তাই না? হাসলেন সক্রেটিস। ফের বললেন, যে জীবনের মৃত্যু হতে বেশি দেরি নেই এবং যা অবধারিত ও নির্দিষ্ট, তাকে একটু বেশি সময় বাঁচিয়ে রাখার কোনও অর্থ হয় না। তাতে নিজেকেই বিদ্রুপ করা হবে।
উপমন্যু রায়
তখন আমি মাঝে মাঝেই যেন সক্রেটিসকে দেখতে পেতাম। আমার চোখের সামনে যেন ভেসে উঠত সেই বিষণ্ণ কারাকক্ষ, যেখানে সক্রেটিস বন্দি ছিলেন। কান পেতে শুনছিলেন মৃত্যুর পদধ্বনি। তিনি তো কাপুরুষ ছিলেন না! ছিলেন সত্তর বছরের এক সাহসী ‘তরুণ’!
সেটা ছিল সক্রেটিসের জীবনের শেষ দিন। জীবনের শেষ স্নান করার জন্য তিনি নিজের ঘর থেকে কারারক্ষী এবং ক্রিটোর সঙ্গে স্নানাগারে গেলেন। স্নান করার পর নতুন কাপড় পরে ফিরে এলেন আর একটি ঘরে। সেখানে সক্রেটিসের সঙ্গে দেখা করার জন্য নিয়ে আসা হল তাঁর স্ত্রী ও তিন ছেলেকে। তিন ছেলের মধ্যে একজন রীতিমতো তরুণ বয়সের। আর, অপর দু’জন কিন্তু বেশ ছোট।
ক্রিটোর সামনেই তাঁর সঙ্গে তাঁরা দেখা করলেন। সক্রেটিস কিন্তু এতটুকু ভীত ছিলেন না। আসন্ন মৃত্যুর কথা ভেবে উত্তেজিতও হননি। অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে তিনি তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। তার পর তাঁদের বিদায়ও দিলেন। শেষে ক্রিটোর সঙ্গে ফিরে এলেন নিজের ঘরে। কিছুক্ষণ পরেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে হবে। তাই চলে এলো জল্লাদও।
সেই ঘরে তখন সক্রেটিসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন ফাইদো। তখন বিকেল গড়িয়ে গিয়েছে। সূর্যাস্তের সময় হয়ে এসেছে। ঘরে সক্রেটিসের বসার জন্য একটি জায়গা ছিল। সেখানে অত্যন্ত শান্ত ভাবে সক্রেটিস বসলেন। কিন্তু কোনও কথা বললেন না। চুপ করে রইলেন ফাইদোও।
শেষ মুখ খুলল জল্লাদ। বলল, ‘‘আমি জানি সক্রেটিস, তুমি অন্যান্য মানুষের মতো নও। তুমি পুরোপুরি অন্য রকম। তোমার কথায় যুক্তি আছে। অন্যদের মতো তুমি কোনও অযৌক্তিক কথা বলো না।’’
সক্রেটিস কোনও কথা বললেন না। নীরবে তাকিয়ে রইলেন তার দিকে।
জল্লাদ বলল, ‘‘আমায় ক্ষমা করো সক্রেটিস। আমি এখানে চাকরি করি। যাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, আমি তাদের বিষপান করাই। আমার এটাই কাজ। কারণ, আমি জল্লাদ।’’
এবারও সক্রেটিস কোনও কথা বললেন না।
জল্লাদ বলল, ‘‘তারা কেউই মরতে চায় না। অথচ তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আর আমাকেই তা কার্যকর করতে হয়। জানো সক্রেটিস, তারা বাঁচার জন্য কত রকম ভাবেই না তখন চেষ্টা করে। তাই আমাকে অধিকাংশ সময়েই জোর করতে হয়। সেই সময় তারা আমার ওপর ভয়ানক ক্রুদ্ধ হয়। কিন্তু আমার বিরুদ্ধে কিছু করার ক্ষমতা তাদের থাকে না। তাই তখন তারা আমাকে অভিশাপ দেয়।’’ একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার মুখ থেকে।
সক্রেটিস চুপ করে জল্লাদের কথা শুনছিলেন।
জল্লাদ বলল, ‘‘কিন্তু আমি কী করতে পারি বলো সক্রেটিস? আমার কাজ তো এটাই। আর— এই কাজ করতে গিয়ে আমাকে যে কত অভিশাপ কুড়োতে হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। মাঝে মাঝে আমার খারাপও লাগে। কিন্তু কিছু করার নেই আমার।’’
সক্রেটিস স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন জল্লাদের দিকে। তার কথা মন দিয়ে শুনে যাচ্ছিলেন তিনি।
সক্রেটিসকে জল্লাদ নিজের কথাগুলি বলতে পেরে যেন অনেক হালকা বোধ করছিল। সে বলল, ‘‘কিন্তু আমি জানি তুমি অনেক জ্ঞানী মানুষ। তুমি এমন অনেক কিছুই বুঝতে পারো, যা আমরা পারি না। এখানে এখনও পর্যন্ত যারা দণ্ডিত হয়ে এসেছে, তুমি তাদের মধ্যে সর্বোত্তম পুরুষ।’’ একটু থেমে ফের বলল জল্লাদ, ‘‘আমি নিশ্চিত, এখন আমি যে কাজ করতে যাচ্ছি, সেজন্য তুমি আমাকে দোষী করবে না। আমার ওপর তাই রাগও করবে না। কারণ, যারা প্রকৃত দোষী, তাদের ওপরই তুমি রাগ করে থাকো।’’
থেমে গেল জল্লাদ। সক্রেটিস কিন্তু তাকিয়েই রইলেন তার দিকে। তার মুখের প্রতি মুহূর্তের অভিব্যক্তি যেন তিনি মন দিয়ে দেখে যেতে লাগলেন।
জল্লাদ ফের বলল, ‘‘অতএব সক্রেটিস, এবার মনকে তৈরি করো। তোমাকে বিদায় নিতে হবে এবার।’’
সক্রেটিস এবারও কোনও কথা বললেন না। একই রকম মৌন রইলেন।
জল্লাদ বলল, ‘‘তুমি নিশ্চয়ই জানো সক্রেটিস আমি কেন এসেছি!’’
অবশেষে নীরবতা ভঙ্গ করলেন সক্রেটিস। ধীরে ধীরে বললেন, ‘‘ভয় নেই, তুমি যা করতে বলবে, আমি তা–ই করব।’’
জল্লাদ কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে গেল। কয়েক মুহূর্তের জন্য কী যেন ভাবল। তার পর বলল, ‘‘তবে আমি তোমায় কথা দিচ্ছি সক্রেটিস, এখন যা হবে, তাতে তোমার কষ্ট যাতে কম হয়, তার পুরো চেষ্টাই আমি করব। তবে, এর পরও যে–টুকু কষ্ট তোমার হবে, তা তোমায় সহ্য করতে হবে।’’
সক্রেটিস বললেন, ‘‘তোমার চিন্তার কিছু নেই। তুমি বলো আমায় কী করতে হবে?’’
কিন্তু জল্লাদ যেন কেমন হয়ে গেল। সেখানে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। দ্রুত সেই ঘর থেকে চলে গেল। তার চোখ জলে ভরে এসেছিল।
সক্রেটিস তখন ফাইদোকে বললেন, ‘‘জল্লাদ হলেও মানুষটা খুবই ভদ্র। আমি এখানে যতদিন আছি, সে আমাকে বারবার দেখতে এসেছে। আমার সঙ্গে গল্পগুজবও করেছে। এখন দ্যাখো আবার কাঁদছে। চমৎকার মানুষ। ওকে আমার খুব ভালো লাগে।’’
ফাইদো এবং ক্রিটো তাঁর কথা শুনছিল।
সেই সময় জল্লাদ ফিরে আবার। সক্রেটিস বললেন, ‘‘এসো ক্রিটো, আমরা তার কথা শুনি। …বিষ নিয়ে এসো জল্লাদ। আর এখনও যদি তা তৈরি হয়ে না থাকে, তা হলে দ্রুত প্রস্তুত করো।’’
জল্লাদ নয়, ক্রিটো জবাব দেয়, ‘‘না সক্রেটিস, এখনও সময় হয়নি। আমি জানি সূর্য এখনও অস্ত যায়নি। এখনও পাহাড়গুলির আড়ালে রয়ে গিয়েছে সূর্য। আর, তুমি নিশ্চয়ই জানো, সূর্য অস্ত না গেলে কোনও দোষীকে হেমলক দেওয়ার নিয়ম নেই! তা ছাড়া আমি অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা সহজে বিষ খেতে চায় না। অনেক টালবাহানা করে। একটু দেরি করেই বিষ খায়।’’
সক্রেটিস তাকালেন ক্রিটোর দিকে। কোনও জবাব দিলেন না।
ক্রিটো বলল, ‘‘মৃত্যুর আগে যতখানি বেশি সময় পাওয়া যায়, ততখানি সময়ই তাদের কাছে উপরি পাওনা। ততক্ষণ তারা জীবনের স্বাদ একটু বেশি করেই যেন অনুভব করে নেয়। কেউ খাওয়াদাওয়া করে, পান করে। কেউ বা বন্ধুদের সঙ্গে মনের কথা বলে, নিজের অপূর্ণ ইচ্ছের কথা আলোচনা করে। তাই বলছি সক্রেটিস, তাড়া দিও না। এখনও সময় আছে সক্রেটিস। এখনও সময় ফুরিয়ে যায়নি।’’
অনাবিল হাসি ছড়িয়ে পড়ল সক্রেটিসের মুখে। বললেন, ‘‘যারা ওই রকম ভাবে কথাবার্তা বলে থাকে বলে তুমি বলছ ক্রিটো, তুমি কি জানো তারা কেন তেমন করে থাকে?’’
ক্রিটো কী জবাব দেবে ভেবে পায় না। জিজ্ঞাসার চোখে তাকিয়ে থাকে সক্রেটিসের দিকে।
সক্রেটিস হাসিমুখে বললেন, ‘‘আসলে তারা ভাবে, ও–ভাবে করলে হয়তো তারা লাভবান হবে। কারণ, তারা একটু বেশি সময় বেঁচে থাকতে পারবে। কিন্তু ক্রিটো, আমি তা মনে করি না। তাই আমি সেই রকম করতে চাই না।’’
ক্রিটো চুপ করে থাকে।
সক্রেটিস বললেন, ‘‘কারণ আমি জানি, একটু দেরি করে বিষ খেলে আমার কোনও লাভ হবে না। কেন না, বিষ তো শেষ পর্যন্ত আমাকে খেতেই হবে, তাই না?’’ হাসলেন তিনি। ফের বললেন, ‘‘যে জীবনের মৃত্যু হতে বেশি দেরি নেই এবং যা অবধারিত ও নির্দিষ্ট, তাকে একটু বেশি সময় বাঁচিয়ে রাখার কোনও অর্থ হয় না। তাতে নিজেকেই বিদ্রুপ করা হবে। তাই আমি যা বলছি, তা–ই করো। আমার কথা অমান্য কোরো না ক্রিটো।’’
ক্রিটো তখন একটু চেঁচিয়ে পাশের ঘরে থাকা ভৃত্যকে ডাকলেন। ভৃত্য সে ঘরে এলে ইঙ্গিতে তাকে হেমলকের পাত্র নিয়ে আসতে বললেন। নির্দেশ পালন করতে ভৃত্য বাইরে চলে যায়। তার সঙ্গে যায় জল্লাদও। কিছুক্ষণ পরে তারা দু’জন ফিরে আসে। তার হাতে একটি পাত্র। তাতে হেমলক। বিষ।
সক্রেটিস তা দেখে হাসিমুখে জল্লাদকে বললেন, ‘‘প্রিয় বন্ধু আমার, এবার বলো আমায় কী করতে হবে? কারণ, এর আগে তো আমি কখনও মরিনি! অন্তত এ ভাবে মরিনি। তাই আমি জানি না এই সময় কী করতে হয়!’’
জল্লাদ বলল, ‘‘আমাকে ক্ষমা করো সক্রেটিস। আমার একমাত্র পরিচয়, আমি জল্লাদ। তোমাকে আমার হাত থেকে এই পাত্র নিতে হবে। তার পর ধীরে ধীরে এই পাত্র থেকে হেমলক পান করতে হবে। পান করা হয়ে গেলে একটু হাঁটাহাঁটি করতে হবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তুমি অনুভব করবে, তোমার পা দুটো ক্রমশ ভারী হয়ে আসছে। আর তখনই তুমি শুয়ে পড়বে। সেই সময় বিষ নিজেই নিজের কাজ শুরু করে দেবে। তোমাকে কিছুই করতে হবে না।’’
জল্লাদ এগিয়ে আসে সক্রেটিসের কাছে। অনেক কষ্টে তাঁর হাতে তুলে দেয় হেমলকের পাত্র। আর তা করতে গিয়ে জল্লাদের হাতটা একটু যেন কেঁপে ওঠে। তার দুই চোখে জল।
সক্রেটিস কিন্তু ভাবলেশহীন। বরং হালকা একটা হাসির রেখা ফুটে ওঠে তাঁর চোখে–মুখে।
ঝাপসা চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে জল্লাদ।
সক্রেটিস পাত্রটি থেকে ধীরে ধীরে হেমলক পান করতে থাকেন। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ক্রিটো, ফাইদো, জল্লাদ, ভৃত্য, সকলের চোখে জল। সকলেই কাঁদছে। একমাত্র সক্রেটিস ছাড়া। তাঁর মুখে আশ্চর্য এক রকম প্রশান্তি ছড়িয়ে রয়েছে। তিনি স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে পান করছেন!
হেমলক পান সম্পূর্ণ হওয়ার পর জল্লাদের নির্দেশ মেনে কিছুক্ষণ হেঁটে বেড়ালেন তিনি। তার পর অনুভব করলেন, পা দুটো তাঁর যেন ক্রমশ ভারী হয়ে আসছে। তবু চলতে লাগলেন তিনি। এ ভাবে চলতে চলতে যখন বুঝতে পারলেন, তাঁর পা দুটো বেশ ভারী হয়ে গিয়েছে, আর কিছু না ভেবে ধীরে ধীরে চিত হয়ে শুয়ে পড়লেন মাটিতে।
জল্লাদ তাঁর পা এবং পায়ের পাতা পরীক্ষা করতে শুরু করল। পায়ের পাতায় একটু জোরে চাপ দিয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, ‘‘কোনও অনুভূতি হচ্ছে সক্রেটিস?’’
সক্রেটিসের সংক্ষিপ্ত জবাব, ‘‘না।’’
তার পর তাঁর কোমরের কাছাকাছি জল্লাদ জোরে চাপ দেয়। এবং, একই রকম প্রশ্ন করে। একই জবাব দেন সক্রেটিসও। তখন জল্লাদ সেখানে উপস্থিত সকলকে দেখায় সক্রেটিসের হাত, পা, কোমর ক্রমশ ঠান্ডা ও শক্ত হয়ে আসছে।
সক্রেটিস খুবই আস্তে আস্তে বললেন, ‘‘শোনো ক্রিটো, হেমলক যখন আমার হৃৎপিণ্ডে উঠে আসবে, তখন আমি অনেক দূরে চলে যাব।’’
সকলের চোখ তখন সক্রেটিসের দিকে।
সক্রেটিস কিছু বলতে চাইছেন। তাঁর গলা ক্রমশ ভারী হয়ে আসছে। সেই অবস্থাতেই তিনি বললেন, ‘‘ক্রিটো, আমি অ্যাসক্লেপিয়াসের কাছে ঋণী। তাঁর কাছ থেকে একটা মোরগ ধার নিয়েছিলাম। ওটা শোধ করে দিও।’’
ক্রিটো কান্নাভেজা গলায় বলল, ‘‘অবশ্যই শোধ করে দেওয়া হবে।’’
সক্রেটিস আর কোনও কথা বললেন না। তাঁর চোখ বুজে এলো। কয়েক মুহূর্ত পরে শেষবারের মতো তাঁর শরীর একটু নড়েচড়ে উঠল। তার পর চিরকালের মতো নিথর হয়ে গেল সেই দেহ।
জল্লাদ একটি সাদা কাপড় দিয়ে সক্রেটিসের শরীর ঢেকে দেয়। আর তাঁর হাঁ–মুখ বন্ধ করে দেয় ক্রিটো। দুই চোখের খোলা পাতাও বুজিয়ে দেয়।
সত্যেরও যেন সেদিনই মৃত্যু হয়। পৃথিবীর দুর্ভাগ্য। (ক্রমশ)