বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা:
আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে পশ্চিমবাংলা সরকার যে ছাড়তে পারবে না, সে কথা পাঁচ পাতার দীর্ঘ চিঠি লিখে কেন্দ্রীয় সরকারকে জানিয়ে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর সেই চিঠিকে বিন্দুমাত্র আমল দেয়নি কেন্দ্রীয় সরকার। সেই সঙ্গে আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ও সোমবার দিল্লির নর্থ ব্লকে গিয়ে কর্মিবর্গ মন্ত্রকে যোগ দেননি। তাঁর যুক্তি ছিল, যেহেতু রাজ্য সরকার তাঁকে ছাড়েনি, তাই তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের তলবে সাড়া দিয়ে দিল্লি যেতে পারেননি। কিন্তু সোমবার ফের চিঠি দিয়ে আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে জানিয়ে দেওয়া হয়, তাঁকে দিল্লিতে গিয়ে কর্মিবর্গ মন্ত্রকে যোগ দিতে হবেই।
এর পরই ঘটনা নাটকীয় মোড় নেয়। নবান্নে গিয়ে মুখ্যসচিব পদে ইস্তফা দেন আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সঙ্গে আইএএস আধিকারিক হিসেবে স্বেচ্ছাবসর নেন। তার পরই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে মুখ্য উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ করেন। সে কথা মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলন করে জানিয়েও দেন। জানান, মুখ্য উপদেষ্টা হিসেবে আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেয়াদ তিন বছর। এই সময় তাঁকে বেতন হিসেবে রাজ্য সরকার প্রতি মাসে দেবে আড়াই লক্ষ টাকা করে। এ ছাড়া, সেই সঙ্গে যাবতীয় অ্যালাওয়েন্স বা সুযোগ–সুবিধাও তিনি পাবেন। এ ছাড়া, মুখ্যসচিব হিসেবে আলাপনের কাজের দরাজ প্রশংসাও করেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর ওই ঘোষণার পরই তা নিয়ে রীতিমতো জল্পনা শুরু হয়ে যায় কলকাতা থেকে দিল্লিতেও।
দিল্লির রাজনৈতিক মহলের অনুমান, এই ঘটনা আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিপক্ষেই যাবে। কারণ, তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ অমান্য করে অবসর নিয়েছেন। তার পরই তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী মুখ্য উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ করেন। এ থেকে স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে, রাজ্য সরকারের বিভিন্ন পদে আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় কাজ করার সময় নিরপেক্ষ ছিলেন না। বরং এই ঘটনায় রাজ্য সরকার তথা শাসক দলের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতাই প্রমাণিত হচ্ছে। উল্লেখ্য, বর্তমানে আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন মুখ্যমন্ত্রীর মুখ্য উপদেষ্টা, তেমনই আলাপনবাবুর স্ত্রী সোনালি চক্রবর্তী বন্দ্যোপাধ্যায়ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য।
তবে নর্থ ব্লক সূত্রে জানা গিয়েছে, আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবসরকে সহজ ভাবে নিচ্ছে না কেন্দ্র। কারণ, ৩১ মে–র পর তাঁর মেয়াদ ছ’মাস বৃদ্ধির জন্য আবেদন করেছিল রাজ্য সরকার। কেন্দ্রীয় সরকার তিন মাসের মেয়াদ বৃদ্ধির অনুমতি দেয়। তার মানে কেন্দ্র ধরে নিচ্ছে, তিনি ৩১ মে অবসর নেওয়ার কথা ভাবেননি। আরও বেশি দিন কাজ করার কথাই ভেবেছিলেন। তবে কেন্দ্রীয় সরকার ৩১ মে দিল্লিতে ডেকে পাঠানোর পর রাজ্য সরকার তাঁকে ছাড়পত্র দিচ্ছে না বলে যুক্তি দেখিয়ে তিনি দিল্লি যাননি। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার ফের তাঁকে চিঠি দিয়ে দিল্লি আসতে বললে তিনি নিজের পদ থেকে অবসর নিয়েছেন। তার পরই মুখ্যমন্ত্রী মুখ্য উপদেষ্টা নিযুক্ত হয়েছেন। সুতরাং, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবেই আলাপনবাবু কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ অমান্য করেছেন বলে নর্থ ব্লক ধরে নিচ্ছে।
যদিও রাজ্যের প্রাক্তন আমলারা এই বিষয়ে রাজ্য সরকার এবং আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষেই দাঁড়িয়েছেন। তাঁদের মন্তব্য, যেহেতু আলাপনবাবু অবসর নিয়ে ফেলেছেন, তাই কেন্দ্রীয় সরকার তাঁর বিরুদ্ধে কোনও রকম শাস্তিযোগ্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে না। বড় জোর পেনশন–সহ তাঁর অবসরকালীন সুযোগ–সুবিধা আটকে দিতে পারে। কিন্তু, সে ক্ষেত্রেও আলাপনবাবু আদালতের দ্বারস্থ হতে পারেন। তা হলে আদালতের রায়ও তাঁর পক্ষেই যাবে বলে তাঁদের ধারণা। তবে, নর্থ ব্লক সূত্রে জানা গিয়েছে, ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের নিয়ম অনুযায়ী, আইএএস, আইপিএস, আইএফএস রাজ্যের অধীনে কাজ করতে পারেন। তবে তাঁরা সকলেই কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মী। তাই কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ তাঁদের মানতেই হবে।
তাঁদের যদি কেন্দ্রীয় সরকার ডেকে পাঠায়, তা হলে রাজ্য সরকারের অনুমতি নিয়ে তাঁরা কেন্দ্রীয় সরকারের ডাকে সাড়া দেবেন। কিন্তু রাজ্য সরকার যদি অনুমতি দিতে না চায় এবং তা নিয়ে কেন্দ্র–রাজ্য সঙ্ঘাত তৈরি হয়, তা হলে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশই বলবৎ থাকবে। সেই নির্দেশই মানতে হবে তাঁদের। আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ অমান্য করেছেন। এখন দেখার এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তারা আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে কোনও রকম পদক্ষেপ করে কিনা! পাশাপাশি, সোমবারও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, প্রধানমন্ত্রীর ডাকা ইয়াস পর্যালোচনা বৈঠকে শুভেন্দু অধিকারী উপস্থিত থাকার জন্যই তিনি যোগ দেননি। কারণ হিসেবে তিনি জানান, তিনি ২ কোটি ৮৭ লক্ষ মানুষের মুখ্যমন্ত্রী। তাই তাঁর সিদ্ধান্ত সঠিক।
এই খবর প্রকাশ্যে আসতেই মুখ খোলেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীও। তিনি স্পষ্ট বলেন, ‘তিনি তো নন্দীগ্রামে আমার কাছে হেরে গিয়েও মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। তার মানে তিনি অনির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী। তাই এত বড় বড় কথা তাঁর মুখ মানায় না। আর, তিনি যদি ২ কোটি ৮৭ লক্ষ মানুষের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে থাকেন, তবে তাঁর মনে রাখা উচিত, আমিও সে ক্ষেত্রে ২ কোটি ২৮ লক্ষ মানুষের বিরোধী দলনেতা।’ যদিও তাঁর কথায় মমতা পাল্টা মুখ খোলেননি।
এদিকে, আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যসচিব পদে ইস্তফা দেওয়ায় ওই পদে নিয়োগ করা হয়েছে হরেকৃষ্ণ দ্বিবেদীকে। আগে হরেকৃষ্ণ দ্বিবেদী ছিলেন স্বরাষ্ট্র সচিব পদে। এখন নতুন স্বরাষ্ট্র সচিব হয়েছে বিপি গোপালিকা। এতদিন তিনি ছিলেন প্রাণী সম্পদ বিকাশ দফতরের সচিব। সূত্রের খবর, হরেকৃষ্ণ দ্বিবেদী এবং বিপি গোপালিকা, দু’জনেই মুখ্যমন্ত্রীর বিশেষ আস্থাভাজন বলে অনেকের মত। তাই আগামিদিনে তাঁদের কাজ নিয়ে বিরোধী দলগুলি ফের সোচ্চার হতে পারে বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।