একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে করা মামলায় জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য (ময়মনসিংহ-৭) ত্রিশালের এম এ হান্নানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের অষ্টম সাক্ষী হিসেবে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছেন ময়মনসিংহ- ৫ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বাবু।
সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী ট্রাইব্যুনালে বলেন, ‘১৯৭১ সালের ৭ আগস্ট মামলার আসামির বাড়ির সামনে থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও কয়েকজন আলবদর-রাজাকার আমাকে আটক করে মারতে মারতে তার বাড়ির দোতলায় নিয়ে যায়। পরে সেখান থেকে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে নিয়ে যায়। সেখানেও আমাকে এবং আটক অন্যান্যদের নির্যাতন করে তারা। ১৯৭১ সালের সেই নির্যাতনের অনেক চিহ্ন এখনো আমার শরীরে রয়েছে।’
মন্ত্রীর জবানবন্দি পেশ করা শেষ হলে তাকে জেরা করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী। জেরা শেষে মামলার কার্যক্রম মূলতবী করা হয়।
মঙ্গলবার (৯ ফেব্রুয়ারি) ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দি পেশ করেন প্রতিমন্ত্রী। ট্রাইব্যুনালের অপর সদস্যরা হলেন বিচারপতি মো. আমীর হোসেন ও আবু আহমেদ জমাদার।
আদালতে আজ রাষ্ট্রপক্ষে ট্রাইব্যুনালকে সহযোগিতা করেন প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সিমন। তার সঙ্গে ছিলেন প্রসিকিউটর তাপস কান্তি বল ও রেজিয়া সুলতানা চমন। আসামিপক্ষে ছিলেন আইনজীবী আব্দুস সোবহান তরফদার।
প্রায় এক ঘণ্টাব্যাপী পেশ করা জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালে ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজে দশম শ্রেণিতে পড়তাম। ৭ আগস্ট জোহরের নামাজের পর বাড়ি থেকে সাইকেল যোগে স্বদেশি বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা করি। আমি শহরের নতুনবাজার অতিক্রম করে এম এ হান্নানের বাড়ির সামনে পৌঁছালে ওই বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়ানো পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কয়েকজন ও আলবদর-রাজাকার মিলে আমাকে আটক করে এবং পিছমোড়া দিয়ে বেঁধে মারতে মারতে এম এ হান্নানের বাড়ির দোতলায় নিয়ে যায়।’
সেখানে এম এ হান্নান আমাকে দেখে ও আমার পরিচয় জেনে বলে, ‘তোমার ভাইয়েরা মুক্তিবাহিনীতে গিয়েছে। তোমার বাবাকে ডেকে এনে অনেকবার সাবধান করার পরও সে কথা শুনেনি।’
তিনি বলেন, এই কথা বলার পর আমাকে নিয়ে যেতে রাজাকারদের নির্দেশ দেন এম এ হান্নান। নির্দেশমতো তারা আমাকে ময়মনসিংহের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে পাকিস্তান আর্মিদের নির্যাতন কেন্দ্রে নিয়ে যায়।
‘সেখানে আমাকে ওই হলের দোতলার ২১০ নম্বর রুমে আটকে রাখে। আমি ওই রুমে ঢুকে আরও ৪-৫ জনকে সেখানে দেখি। তারা সকলেই আহত অবস্থায় ছিল। ওইদিন সন্ধ্যার দিকে ময়মনসিংহ জেলা শান্তি (পিস) কমিটির সভাপতি মওলানা ফয়জুর রহমার রহমানের (বর্তমানে মৃত) ছেলে তৈয়ব (বর্তমানে মৃত) ও তার কয়েকজন সঙ্গী দুজন লোককে আটক করে আমার কক্ষে নিয়ে আসে। তাদের নির্যাতিত অবস্থায় দেখি। পরে তাদের সাথে কথা বলে জানতে পারি, তাদের এক জনের মধ্যে নাম উমেদ আলী মাস্টার, আরেক জনের নাম আব্দুর রহমান। আব্দুর রহমান মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।’
১৯৭১ সালের ৯ আগস্টের বর্ণনায় প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘সন্ধ্যার দিকে ময়মনসিংহ জেলার শান্তি কমিটির চেয়াম্যান মওলানা ফয়জুর রহমান (বর্তমানে মৃত) এবং সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান কয়েকজন সহযোগী নিয়ে আমাদের কক্ষে আসে।’
তিনি বলেন, ‘ওই রুমে তখন আমরা ৮-১০ জন আটক ছিলাম। রুমে ঢুকেই তারা বলে ‘এরা এখনো এখানে!’। এ কথা শুনে আমি মাওলানা ফয়জুর রহমানকে সালাম দেই। তিনি আমাকে দেখে ‘তুমি এখানে?’ বলে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। পরের দিন সকালে মওলানা ফয়জুর রহমানের ছেলে তৈয়ব ও তার কয়েকজন সহযোগী আমাদের রুমে গিয়ে আমাকে বের করে নিয়ে আসে এবং আমাকে ছেড়ে দিলে পরে আমি বাড়ি ফিরে যাই।’
এর আগে ময়মনসিংহের ত্রিশালের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রহমানের স্ত্রী রহিমা খাতুন ২০১৫ সালের ১৯ মে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মামলা করেন এম এ হান্নানের বিরুদ্ধে।
এ মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল হান্নান ও তার ছেলেসহ মোট ৮ আসামির বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করলে হান্নান ও তার ছেলে রফিক সাজ্জাদসহ পাঁচ আসামিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে আরেক আসামি আবদুস সাত্তার ট্রাইব্যুনালে আত্মসমর্পণ করেন।
এখন পর্যন্ত এ মামলায় ছয় আসামি এখন কারাগারে আছেন। জামায়াত নেতা ফখরুজ্জামান ও গোলাম রব্বানী নামের দুই আসামি পলাতক।
পরে আসামিদের বিরুদ্ধে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, আটক, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, অপহরণ ও লাশ গুমের ছয় ধরনের অভিযোগ এনে ২০১৬ সালের ৩১ অক্টোবর আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন। ওই বছরের ১১ ডিসেম্বর অভিযোগ আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল। পরে ২০১৯ সালের ২৭ মে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করে ট্রাইব্যুনাল। এর পরে আসামীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়।