স্যার যেন হঠাৎ করেই আমাকে চিনতে পারলেন,
তিনি দ্রুত তার জীর্ণ হাতে ময়লা নেকড়ার মতো প্রায় ছিঁড়ে যাওয়া মাস্কটি পড়ার চেস্টা করতে লাগলেন। আমি আগের মতোই নিঃশব্দ, নিস্পলক তাকিয়ে রইলাম স্যারের দিকে, স্যার কোনভাবেই মাস্ক লাগাতে পারছেন না, ডাট বাঁকা হয়ে যাওয়া চশমা টা বারবার খুলে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে আর তিনি একই সাথে চশমাটা ও, তার হাত কাঁপছে।
সেই হাত আজ কাঁপছে- যেই হাতে একসময় পড়া না পারলেও পরম আদরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন, সেই হাত যেই হাতে এক ই জিনিস আমরা না বুজলে বারবার করে কখনো বোর্ডে কখনো খাতায় লিখে বুঝিয়ে দিতেন, সেই হাত যেই হাত আমাকে প্রথম বুঝিয়েছিলো এই হাত কেবল খোদার শুকরিয়া আর ক্ষমা ভিক্ষার জন্য পাততে হয় আর অন্য সবার সাহায্যের জন্য বাড়িয়ে দিতে হয়।
আমি এক দৃস্টিতে তাকিয়ে আছি স্যারের দিকে, আমার যেন ঘোর লেগে গিয়েছে আমি চোখ ফেরাতে পারছিনা! সময় স্তব্ধ হয়ে যায় আমার পৃথিবীতে, এমন ঘটনা শুনেছি দেখেছি কেবল গল্প সিনেমায়! ঠিক কতক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম এভাবে? ১০ সেকেন্ড, ২০ সেকেন্ড, ৪০ সেকেন্ড নাকি ১ মিনিট, ২ মিনিট? অথচ মহাকালের হিসাবের এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সময়ের মাঝেই স্যারের সাথে আমার জানাশোনার পুরোটা সময় ঘুরে এলাম!
আমাদের স্কুল তথা থানা পর্যায়ের সেরা শিক্ষক ছিলেন, স্কুলের পাশাপাশি প্রচুর টিউশন করাতেন তার যতটা না টাকার জন্য তার চেয়ে বেশী ছিলো ছাত্রদের ঠিকভাবে গড়ে তোলার তাগিদ। কত ছাত্রছাত্রী যে উনি টাকা ছাড়াই পড়িয়েছেন আর কতজন যে উনার টাকা মেরে দিয়েছেন, সেই হিসাবের হিসাব ও করা সম্ভব না!
দারুণ স্বচ্ছলতার পরিবার জানতাম কিন্তু হঠাৎ একদিন জানলাম স্যারের বড় ছেলের কর্কট রোগ হয়েছে, প্রচুর টাকা প্রয়োজন! ততদিনে আমরা সবাই চাকুরী জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি, তাই আর সেভাবে খোঁজ নেয়া হয়নি!
আজ এত বছর পরে আবার দেখা, ক্ষিলখেত ওভার ব্রীজে থেকে একটু বাম পাশের এই জায়গাটায় ব্রীজের নীচের চেয়ে লোকজন অনেক কম। আমি বন্ধু শফিকুলের বাসায় আসলে এদিকটায় দাঁড়াই কিছুটা সময়, আজও দাঁড়িয়েছিলাম কিন্তু পাশের ভিক্ষুকের গলার আওয়াজ শুনে তাকাতেই চমকে উঠি। তারপরের ঘটণাতো শুনলেন ই!
আমি আসলে তখনো ধাতস্থ হতে পারিনি, তার আগেই, “আবিদের বাবা, আজ মাত্র ১৮ টাকা হলো, কারো হাতেই তো টাকা নেই এখন! তোমার ওষুধ টা কাল নিতে হবে, সব মিলয়ে ২২৮ টাকা হয়েছে। চলো আজ বাড়ি ফিরে যাই, ক্লান্ত লাগছে” বলতে বলতে এক বৃদ্ধা এগিয়ে আসলেন, দেখেই এত বছর পরেও চিনতে পারলাম, উনি স্যারের স্ত্রী!!
আজ চমৎকার পুর্নিমার রাত, সুন্দর আলোর বন্যায় ভেসে যাওয়া এই শহরে কেবল আমরা ৩ জন মানুষ ই যেন ডুবে গেলাম, ডুবে গেলাম অসহায় অন্ধকারে, প্রত্যেকেই লুকাতে চাইলাম নিজের ছায়ার ভিতরে।
তখনো যেন সেই অসহায়ত্বের নগ্নতা প্রকাশের আরো কিছু বাকী ছিলো, কেউ একজন একটা ধাতব মুদ্রা স্যারের সামনে রাখা বাটিতে ছুঁড়ে দিতেই আমি মাথাভর্তি সেই ঝনঝন শব্দ নিয়ে তলিয়ে যেতে থাকলাম অপমান, বঞ্চনা আর হতাশার অতল গহবরে। আমি নিয়ন আলোয় রংগীন এই শহরে নিজের অস্তিত্ব খুঁজে বেড়াই, নিজের ছায়া হাতড়াই, নিজের নিঃশ্বাসের আওয়াজ শুনতে চাই..