খেয়া ঘাটের ইজারার টাকা আত্মসাতের ঘটনায় দুর্নীতির এক মামলায় সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের তিন কর্মকর্তাকে আসামি না করায় তলবে দুদকের খুলনা অঞ্চলের উপ-পরিচালক মো. নাজমুল হাসানসহ চারজন রোববার (১৪ ফেব্রুয়ারি) হাইকোর্টে উপস্থিত হয়েছিলেন।
অন্য যে তিনজনকে তলব করা হয়েছিল তারা হলেন- সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও সচিব।
তাদের তিনজনকে আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারি আদালতে আবারও হাজির হতে বলা হয়েছে। আর উপ-পরিচালক মো. নাজমুল হাসানকে ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন আদালত।
এছাড়া শুনানিতে আজ জেলা পরিষদের দুর্নীতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট। এ সময় আদালত বলেছেন, দেশ ও জাতির প্রতি আমাদের সবার দায়িত্ববোধ ও ভালোবাসা থাকা উচিত। আদালত বলেন, ঘুষ খেলেন, দুর্নীতি করলেন, কিন্তু এই অবৈধ কর্মকাণ্ডের চূড়ান্ত পরিণতি কী?
হাইকোর্ট বলেছেন, একজন মানুষ সর্বোচ্চ ৮০/৯০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে। এরপর চূড়ান্ত পরিণতি মৃত্যু। ঘুষ খেয়ে ও দুর্নীতি করে সৃষ্টিকর্তার কাছে কী জবাব দেবেন?
সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের দুর্নীতি নিয়ে করা মামলার শুনানিতে রোববার হাইকোর্টের বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি মহিউদ্দিন শামীমের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল বেঞ্চ দুর্নীতিবাজদের উদ্দেশে এমন কথা বলেন।
আদালতে আজ প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মাইনুল হাসান। অপর আসামিদের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট মো. ওজি উল্লাহ। আর দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুর্টি অ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিনউদ্দিন মানিক, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মাহজাবিন রাব্বানী দীপা ও আন্না খানম কলি।
হাইকোর্ট বলেন, জেলা পরিষদে কিভাবে দুর্নীতি হচ্ছে তা দেখে অবাক হচ্ছি। খেয়াঘাটের ১০ বছরের ইজারার টাকা সরকারি কোষাগারে জমা হয়নি। এই যে অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা হয়নি তখন এই পরিষদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কী করেছেন? দায়িত্ববোধ না থাকলে দেশের উন্নয়ন হবে কিভাবে? দেশ ও জাতির প্রতি আমাদের সবার দায়িত্ববোধ ও ভালোবাসা থাকা উচিত।
আদালত বলেন, নানা দুর্নীতি খবর দেখে মাঝে মাঝে হতভম্ব হয়ে যাই। যেখানে দুর্নীতি হয় সেখানে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দুর্নীতি বন্ধে কি কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন?
হাইকোর্ট বলেন, দুর্নীতি বন্ধের বিষয়ে সরকার ও আদালতকে জানাতে হবে। আরও অবাক হই যে, বড়দের আঙ্গুলি হেলান ছাড়া পিয়ন চাপরাশিদের দুর্নীতি করা সম্ভব কিনা।
আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক হাইকোর্টে হাজির হন মামলার বাদী দুদকের খুলনা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. নাজমুল হাসান ও জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আহসান হাবিব।
শুনানি শেষে হাইকোর্ট হাজিরা থেকে অব্যাহতি দিয়ে সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের অনিয়মের নথি আদালতে দাখিল করতে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন।
শুনানিতে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, অনুসন্ধান কর্মকর্তার প্রতিবেদন অনুমোদনের পর এজাহার দাখিল করা হয়েছে। এখানে আসামি করার ক্ষেত্রে কোনো পিক অ্যান্ড চুজ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়নি। আদালত বলেন, গত ১০ বছরে এই জেলা পরিষদে কোনো অডিট হয়েছে? দুদক কৌঁসুলি বলেন, নথিপত্রে দেখা যাচ্ছে একবার অডিট হয়েছে। আদালত বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে ইজারার টাকা যে আদায় হয়নি সেজন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কি ঘুমিয়ে ছিল?
যাদেরকে আসামি করা হয়েছে এরা নিম্নমান সহকারী। এদের দায় কি? দুদক কৌসুলি বলেন, এই সময়ের মধ্যে ১৩ জন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়েছে। নিম্নমান ক্লার্ক হলেও বড় অফিসারদেরকে এরা ভাঙিয়ে খায়। এরপরই তিনি এজাহার থেকে আসামিদের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ আদালতকে পড়ে শোনান।
তিনি বলেন, আমাদের তদন্ত কর্মকর্তার কোনো ভুল হলে তাকে আদালত জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবেন। এমনকি ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিতে পারবেন। এ পর্যায়ে দুদকের আইনজীবীকে হাইকোর্ট বলেন, আপনি কোনো যুক্তিতেই বোঝাতে পারবেন না যে ঊর্ধ্বতন অফিসারদের সম্মতি ছাড়া এ ধরনের দুর্নীতি করা সম্ভব নয়। এ ধরনের মামলা আমরা সরাসরি বাতিল করে দেব। এখানে যদি কোনো অনিয়ম পাই তাহলে মামলার বাদীকেও আসামি করার নির্দেশ দেয়া হবে। আইনজীবী বলেন, ঊর্ধ্বতন অফিসারদের সম্মতি ছাড়া এ ধরনের দুর্নীতি সম্ভব নয় আদালতের এই মনোভাব সঠিক। আমরা তদন্ত করছি। তদন্ত শেষেই প্রকৃত দোষীরা বেরিয়ে আসবে। এখানে কাউকে পিক অ্যান্ড চুজ করা হয়নি।
আসামি পক্ষের আইনজীবী মো. ওজি উল্লাহ বলেন, উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাতেই এই মামলা করা হয়েছে। ব্যক্তি বিশেষের দুর্নীতি অধস্তনদের ওপর চাপিয়ে কারও অব্যাহতি পাওয়ার সুযোগ নেই।
প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আহসান হাবিব বলেন, গত ২৭ জানুয়ারি এখানে যোগ দিয়েছি। জেলা পরিষদের অনেক অনিয়ম আছে। ইতোমধ্যে কিছু টাকা আদায় করা সম্ভব হয়েছে।
এ পর্যায়ে আদালত বলেন, বাকি টাকা উদ্ধারেও পদক্ষেপ নিন। যারা জড়িত তাদেরকে আইনের আওতায় আনুন। দেশ ও জাতির জন্য কাজ করুন।
এর আগে মামলার আসামি জেলা পরিষদের প্রধান সহকারী খলিলুর রহমান ও নিম্নমান সহকারী এসএম নাজমুল হোসেনের জামিন আবেদনের ওপর শুনানিতে ভার্চুয়াল বেঞ্চ গত ৯ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতির এক মামলায় সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের তিন কর্মকর্তাকে আসামি না করায় দুদকের খুলনা অঞ্চলের উপ-পরিচালক মো. নাজমুল হাসানসহ চারজনকে তলব করেছিলেন। তাদের রোববার আদালতে হাজির হয়ে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছিল।
এছাড়া জামিন আবেদনকারী দুজনকেও এদিন আদালতে হাজির থাকার নির্দেশ দেয়া হয়।
ওই দিন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান। তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের ২১টি খেয়াঘাট ইজারাবাবদ আদায় করা প্রায় ১৪ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগের মামলায় সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের তিন কর্মকর্তাকে আসামি না করায় আদালত এ আদেশ দেন।’
২০০৮ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে সাতক্ষীরা জেলার ২১টি খেয়াঘাট ইজারার ১৩ লাখ ৭৪ হাজার ৮২০ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে আত্মসাতের অভিযোগে সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের প্রধান সহকারী খলিলুর রহমান ও নিম্নমান সহকারী এসএম নাজমুল হোসেন, আশাশুনি উপজেলার শ্রীউলা ইউপি চেয়ারম্যান আবু হেনা শাকিলসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে গত ২৭ জানুয়ারি মামলা করে দুদক।