বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা : যে চিটফান্ড বিতর্ক পশ্চিমবাংলার ক্ষমতায় আসার সূচনা থেকেই সূচের মতো বিঁধে রয়েছে তৃণমূল সরকারের, বৃহস্পতিবার সেই বিতর্কই উস্কে দিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, চিটফান্ড কাণ্ডে যাঁরা জড়িত, তাঁরা কেউই রেহাই পাবেন না। সকলের বিরুদ্ধেই আইন মাফিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রাজনৈতিক মহলের ধারণা, অমিত শাহ ইঙ্গিতে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকেই এদিন নিশানা করেছেন।
পশ্চিমবাংলা সফরে এসে এদিন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কপিলমুণির আশ্রমে পুজো দেন। পুজো দেন কাকদ্বীপের শ্মশানকালীর মন্দিরেও। মধ্যাহ্ন ভোজ সারেন এক গরিব মাছ বিক্রেতার বাড়িতে। তার পর জনসভা করেন নামখানায়। মাঝে রোড শো করেন কাকদ্বীপে। সেই মিছিলে অসংখ্য বিজেপি কর্মী–সমর্থক যোগ দেন। নামখানার সভায় এদিন তিনি রীতিমতো হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘চিটফান্ড কেলেঙ্কারির উচ্চস্তরীয় তদন্ত হবে। দোষীরা কেউই ছাড় পাবেন না। অবশ্যই শাস্তি পাবেন। তাঁদের জেলে পাঠানো হবে।’ তিনি স্পষ্টই বলেন, ‘যাঁরা দুর্নীতি করেছেন, তাঁদের পাতাল থেকে বের করে আনব।’ উল্লেখ্য, তৃণমূলের একেবারে শীর্ষস্তরের নেতা–নেত্রী শুরু করে বহু নেতার বিরুদ্ধেই এই কাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। তৃণমূলের বর্তমান মুখপাত্র কুণাল ঘোষ যখন বিক্ষুব্ধ তৃণমূল সাংসদ ছিলেন এবং সারদা চিটফান্ড–কাণ্ডে গ্রেফতার হয়েছিলেন, তখন তিনি নাম করে সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী হিসেবে অভিযোগের আঙুল তুলেছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকে।
বিভিন্ন সভায় এখন সেই প্রসঙ্গই তুলছেন বিজেপি নেতারা। অবশ্য পরিষ্কার জবাব দিতে পারছেন না কুণাল ঘোষ। বরং বিরক্তি এবং ক্ষোভ প্রকাশ করে চলেছেন তিনি। সেই বিতর্কই যেন এদিন উস্কে দিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। পাশাপাশি এদিন তিনি এই সতর্কবার্তাও দেন, ‘রাজ্যে ক্ষমতায় এলে আমফান দুর্নীতি নিয়েও উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত হবে। সাধারণ মানুষের টাকা ফিরিয়ে দেওয়া হবে। অপরাধীদের ধরে জেলে পাঠানো হবে।’ প্রসঙ্গত, বুধবারই বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারি সাফ জানিয়ে দেন, তৃণমূল যে আর জিতবে না, তা বুঝতে পেরে এখন বহু তৃণমূল নেতা বিজেপিতে আসতে চাইছেন। কিন্তু যাঁরা আমফান কেলেঙ্কারিতে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের কাউকে বিজেপিতে ঠাঁই দেওয়া হবে না। এদিন অমিত শাহ এ কথাও বলেন, ‘বিজেপি চায় রাজ্য থেকে তোষণের রাজনীতি পরিবর্তন করতে। মানুষ বাঁচবে মানুষের সম্মান নিয়ে। বিজেপি চায় রাজ্য থেকে কাটমানি সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটাতে। তাই ২৯৪ আসন থেকেই তৃণমূলকে উৎখাত করবে বিজেপি। বিজেপিই সোনার বাংলা গড়বে। বিজেপির ১৩০ জন সক্রিয় কর্মীকে মমতাদিদির গুণ্ডারা খুন করেছে। এই ১৩০ জন কর্মীর আত্মত্যাগ ব্যর্থ হতে দেব না।’
এদিকে, এদিন অমিত শাহর পাল্টা সমালোচনা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তবে সমালোচনা করতে গিয়ে তিনি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে ‘তুই–তুকারি’ করেন। দক্ষিণ ২৪ পরগনার পৈলানে এক জনসভায় তিনি বলেন, ‘আরে, দিদির সঙ্গে পরে লড়বি। আগে ভাতিজার সঙ্গে লড়।’ যদিও অমিত শাহের আক্রমণের বিষয়বস্তু সম্পর্কে পাল্টা কোনও বক্তব্যে যাননি তিনি। তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি থেকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ–সহ বিজেপির প্রত্যেক কেন্দ্রীয় নেতাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘মমতাদিদি’ বলে উল্লেখ করে থাকেন। সে ক্ষেত্রে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে ভাবে সভামঞ্চ থেকে ‘তুই–তুকারি’ করেন, তা সারা ভারতেই বাঙালির সম্মান অনেকখানি নামিয়ে দিচ্ছে। এ ছাড়াও অমিত শাহকে এদিন তিনি ব্যক্তিগত আক্রমণও করেন। বলেন ‘ফানুস–ফানুস চেহারা, ফাটুস–ফুটুস চেহারা।’
আবার, এদিন মমতা ফের ধর্মীয় প্রসঙ্গে টেনে আনেন। বলেন, ‘ওরা সরস্বতী পুজোর মন্ত্র জানে? আমি বলছি। কান খুলে শুনে নিক।’ কিন্তু মন্ত্র বলতে গিয়ে বারবার হোঁচট খান। মন্ত্রের মাঝে অনেক শব্দই লুপ্ত হয়ে যায়, এমনকী লাইনও বাদ দিয়ে যান তিনি। যদিও সে–সব তোয়াক্কা না করে তিনি জোর গলায় মন্ত্র বলতে থাকেন। শুধু সেখানেই থেমে যাননি তিনি। এক সময় ‘ভগবান বিষ্ণু’কে ‘বিষ্ণুমাতা’ বলেও উল্লেখ করেন। এর আগেও অনেকবার তিনি ‘বিষ্ণুদেব’কে ‘বিষ্ণুমাতা’ বলেছেন। কিন্তু, কেন তিনি ‘বিষ্ণুদেব’কে ‘বিষ্ণুমাতা’ বলেন, তার ব্যাখ্যা কোনও দিন তাঁর কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। এ ছাড়াও তিনি এ দিন মহাভারতের তথ্যও ভুল দেন। বলেন, কৃষ্ণ নাকি অর্জুনের রথ চালাতেন। কিন্তু প্রকৃত তথ্য হল, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন অর্জুনের সারথি।