বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা : সাংসদ তথা অভিনেত্রী শতাব্দী রায়কে নিয়ে দিনভর নাটকে সরগরম রইল বাংলার রাজনীতি। শেষে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠক করে পরে জানালেন, তিনি দলেই আছেন। শনিবার দিল্লি যাচ্ছেন না। কিন্তু রাজনৈতিক মহলে একটি প্রশ্নও ঘোরাফেরা করছে এখন। সুর বদলালেও আদৌ মন বদলেছেন কি তিনি? যদিও এই প্রশ্নের উত্তর পেতে এখনও অপেক্ষা করতে হবে কিছুদিন।
বৃহস্পতিবার নিজের ফ্যান ক্লাব পেজে তিনি দলের বিরুদ্ধে একরাশ অভিমান উগরে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘এলাকার মানুষের সঙ্গে আমার নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করেছেন, দলের বহু কর্মসূচিতে আমাকে দেখা যায় না কেন? আমি তাঁদের সকলকে বলেছি, আমি সর্বত্র যেতে চাই। কিন্তু ব্যাপারটা হয়তো সবার পছন্দ নয়। তাঁরা চান না আমি আপনাদের কাছে যাই। সেইজন্য আমাকে দলের বহু কর্মসূচির খবরও দেওয়া হয় না।’ পাশাপাশি ইঙ্গিতবহ ভাবে লিখেছিলেন, ‘যদি নতুন কোনও সিদ্ধান্ত নিই, তা হলে ১৬ জানুয়ারি দুপুর দুটোয় আপনাদের সে কথা জানাব।’ যদিও রাজ্যের শাসক দল প্রভাবিত মিডিয়াগুলি প্রচার করতে শুরু করে, ওটা শতাব্দী রায়ের নামে ফ্যান ক্লাবের পেজ। শতাব্দী সে–সব কথা আদৌ বলেছেন কিনা, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। নিজের পেজে যদি তিনি এ–সব লিখতেন, তা হলে একটা কথা ছিল।
কিন্তু একটা অস্বস্তি দলে থেকেই গিয়েছিল। তা পরিষ্কার হয়ে যায় শুক্রবার সকালেই। খোঁজ নিয়ে তৃণমূলের শীর্ষসারির নেতারা জানতে পারেন, বাস্তবিকই শনিবার সকালে দিল্লি যাচ্ছেন শতাব্দী। তার পরই তৃণমূলের অভ্যন্তরে তৎপরতা শুরু হয়ে যায়। তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে শতাব্দীর। শতাব্দীকে দিল্লি যাওয়া থেকে বিরত করতে সেই কুণাল ঘোষকেই দায়িত্ব দেয় তৃণমূল। শতাব্দীর বাড়ি গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে একবার কথা বলার জন্য তিনি অনুরোধ করেন। তার পর সন্ধে ছটা নাগাদ ক্যামাক স্ট্রিটে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অফিসে শতাব্দী রায়কে নিয়ে যান কুণাল। সেখানে দু’ঘণ্টা বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন শতাব্দী। বলেন, ‘আমার কিছু অভিমান, অভিযোগ ছিল। সবই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে জানিয়েছি। তিনি ব্যবস্থা নেবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘কাল আমি দিল্লি যাচ্ছি না। ফেসবুক লাইভও করছি না।’
কিন্তু এর পর তিনি একটি অসম্পূর্ণ কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘আর তো ক’মাস। এই ক’মাস থেকে, শুনে তার পর না হয় আমরা—!’ ঠিক সেই সময় তাঁকে থামিয়ে দিয়ে কুণাল ঘোষ বলেন, ‘শতাব্দী দলের সাংসদ, দলের নেত্রী। তিনি দলেই আছেন, দলেই থাকবেন।’ তবে শতাব্দী রায়ের এই অসম্পূর্ণ বক্তব্য নিয়ে জল্পনা কিছুটা হলেও জিইয়ে থাকবে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। কিন্তু রাজনীতি বিশেষজ্ঞদের মতে, তৃণমূলের অভ্যন্তরে এখন সন্দেহের চোরাবালি রয়েছে। কে প্রকৃত পক্ষে দলের মধ্যে রয়েছে, আর কে নেই, তা বুঝতে সমস্যায় পড়ছেন দলের শীর্ষনেতারাই। তার ওপর শতাব্দীর অসম্পূর্ণ কথাটি নিয়েও দলের অনেকে সন্দিহান। তাই শতাব্দী রায় শেষ পর্যন্ত দলের মধ্যে সন্দেহের ঊর্ধ্বে থাকবেন না। তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও দলে সন্দেহ থেকে যেতে পারে। সেই কারণে দল যদি শেষ পর্যন্ত বিধানসভা নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসে, তা হলে তখন তাঁর প্রতি দলের পদক্ষেপ ইতিবাচক নাও হতে পারে।
এই বিষয়টি যে শতাব্দীও বুঝতে পারছেন না, তা নয়। তাই আগামী একমাস তাঁর কাছেও গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে। কেন না, এই সময়ের মধ্যে নির্বাচন কমিশন ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণা করে দিলে নির্বাচনী আচরণ বিধি লাগু হয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে পুলিশ ও প্রশাসন অনেকটাই নিরপেক্ষ হয়ে যেতে বাধ্য হবে। তখন বিরোধী দলগুলি, বিশেষ করে বিজেপির সক্রিয়তা আরও বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। তখন তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ অবস্থা কী হবে, তা নিয়ে বেশ কিছুটা সংশয়ে রয়েছেন শীর্ষ স্তরের নেতারা। এদিকে, শুক্রবার বেসুরো মন্তব্য করে তৃণমূলের মাথাব্যথা আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন মন্ত্রী গৌতম দেব এবং বিধায়ক প্রবীর ঘোষাল। এদিন উত্তরবাংলার ডাবগ্রাম ও ফুলবাড়ির রাস্তা নিয়ে প্রকাশ্যেই নিজের অসন্তোষ জানিয়ে পর্যটনমন্ত্রী গৌতম দেব বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে রাস্তা খারাপ হয়ে পড়ে রয়েছে। বারবার সহযোগিতা করার জন্য উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রককে জানানো হয়েছে। কিন্তু কোনও সহযোগিতাই পাওয়া যায়নি।’ এর জবাবে উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ঘোষ অবশ্য কোনও প্রতিক্রিয়া জানাননি।
উত্তরপাড়ার বিধায়ক প্রবীর ঘোষাল বলেন, ‘লোকসভায় আমাদের ফল খারাপ হয়েছিল। তার পর সংগঠনে পরিবর্তন আনা হয়। কিন্তু, তা কতটা লাভজনক হয়েছে, তা নিয়ে সংশয় রয়ে গিয়েছে। আমি বিনাদ্বিধায় বলতে পারি, সংগঠন এবং সরকারের কাজ নিয়ে বেশ কিছু ত্রুটি রয়ে গিয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চেষ্টা করছেন, কিন্তু উন্নয়নে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। বিষয়টা মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে।’ জবাবে মুখ খুলেছেন জেলা সভাপতি দিলীপ যাদব। তিনি বলেছেন, ‘দলের মধ্যে যে ফোরাম আছে, সেখান থেকে তাঁর কথার জবাব দেওয়া হবে।’ স্বভাবতই রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন উঠেছে, যে ভাবে দিনদিন তৃণমূলের সাংসদ, বিধায়ক, মন্ত্রীরা বিস্ফোরক মন্তব্য করছেন, তাতে শেষ পর্যন্ত সবাইকে ধরে রাখতে পারা যাবে কি?