বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা :বিধানসভা নির্বাচনের আগে শোরগোল পড়ে গেল পশ্চিমবাংলার রাজনীতিতে। তৃণমূলকে অস্বস্তিতে ফেলে এবার রাজ্যসভার সাংসদ পদে ইস্তফা দিলেন দীনেশ ত্রিবেদী। ঘটনাটি এতটাই আকস্মিক যে, এই ধাক্কার পর তৃণমূলের শীর্ষনেতারা প্রতিক্রিয়ায় প্রথমে কোনও মন্তব্য করতেই পারছিলেন না। তবে পরে স্বভাবসিদ্ধ ভাষায় তাঁরা তাঁর সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছেন। তবে দীনেশ যদি বিজেপি আসেন, তা হলে তাঁকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত বলে জানিয়ে দিয়েছেন ওই দলের নেতারা।
দীনেশ যে এমন সিদ্ধান্ত নিতে চলেছেন, তা শুক্রবার দিল্লিতে রাজ্যসভার অধিবেশন চলাকালীন তৃণমূল সাংসদরা ঘূণাক্ষরেও টের পাননি। রাজ্যসভায় নিজের বক্তব্য পেশ করার পর কিছুক্ষণের জন্য দলের কয়েকজন সাংসদের সঙ্গে বাইরে গিয়েছিলেন সাংসদ সুখেন্দুশেখর রায়। তখন বক্তব্য পেশ করছিলেন দীনেশ ত্রিবেদী। তাঁর বক্তব্য সুখেন্দুশেখর এবং অন্য তৃণমূল সাংসদদের কাছে ইতিবাচক বলেই মনে হয়েছিল। কিন্তু বক্তব্য শেষ করার মুহূর্তেই বোমা ফাটান দীনেশ। বলেন, ‘বাংলায় রাজনৈতিক হিংসা চলছে। এ–সব মেনে নিতে পারছি না। আবার, আমরা কিছুই করতে পারছি না। এর চেয়ে ইস্তফা দিয়ে বাংলায় গিয়ে কাজ করাই ভালো। তাই রাজ্যসভার সাংসদপদ আজ আমি ত্যাগ করছি। দলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমি কিছুই করতে পারছি না। তাই আমি আমার মনের কথাই শুনেছি।’
এই ঘটনা শুনে ছুটে আসেন তৃণমূল সাংসদরা। পরিস্থিতি বুঝতে না পারায় তাঁরা হতবাক হয়ে যান। সুখেন্দুশেখর রায় বলেন, ‘তিনি কেন এমন করলেন, তা আমি বলতে পারব না।’ অন্যদিকে, তৃণমূলের লোকসভার সাংসদ সৌগত রায় বলেন, ‘চারদিন আগেই দীনেশ ত্রিবেদীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। কিন্তু তাঁর অভিমান বা অসন্তোষের কথা আমায় বলেননি। তাই এমন ঘটনা যে ঘটতে পারে, বুঝতে পারিনি।’
সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হল, তাঁকে বিজেপিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন গেরুয়া সাংসদ অর্জুন সিং। উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে ব্যারাকপুর আসনে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন অর্জুন। তিনি এবং দীনেশ ত্রিবেদী, দু’জনেই তখন তৃণমূলে ছিলেন। কিন্তু মমতা তাঁর বদলে প্রার্থী করেন দীনেশকেই। প্রতিবাদে দল ছাড়েন অর্জুন। যোগ দেন বিজেপিতে। শুধু তাই নয়, ওই আসনে বিজেপি তাঁকে প্রার্থীও করে দেয়। সেই নির্বাচনে দীনেশ ত্রিবেদীকে হারিয়ে দেন অর্জুন।
কিন্তু হেরে যাওয়া দীনেশ ত্রিবেদীর প্রতি আস্থা ছিল মমতার। তিনি তাঁকে রাজ্যসভার সাংসদ করে দিল্লি পাঠিয়ে দেন। কিন্তু সেই দীনেশ ত্রিবেদী যে শুক্রবার বিজেপিতে যোগ দেবেন, তা অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরও অনুমানের বাইরে ছিল। আর এদিন রীতিমতো বোমা ফাটিয়ে লোকসভা নির্বাচনে দীনেশের প্রতিদ্বন্দ্বী অর্জুন সিং বলেন, ‘তিনি একজন দক্ষ রাজনীতিক। অভিজ্ঞ নেতাও। আমি তাঁকে বিজেপিতে আগাম শুভেচ্ছা জানিয়ে রাখলাম।’
অর্জুনের এই মন্তব্যের পরই মধ্যাহ্নকালীন–ধাক্কা কাটিয়ে উঠে তৃণমূল নেতারা মুখ খুলতে শুরু করেন। লোকসভায় তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় নিজস্ব ঢঙে বলেছেন, ‘দীনেশ বিশ্বাসঘাতক। দলের জন্য কোনও দিন কিছু করেননি। শুধু নিজেরটাই বুঝেছেন। তাই তাঁর ইস্তফায় দলের কিছু যায় আসে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘মমতাদি তাঁকে রেলমন্ত্রী করেছিলেন। রাজ্যসভার সাংসদ করেছিলেন। তাঁর জন্য আরও অনেক কিছু করেছিলেন। কিন্তু এখন নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহদের কাছ থেকে অতিরিক্ত কিছু পাওয়ার আশায় তিনি দল ছেড়েছেন।’
এদিকে, পশ্চিমবাংলায় বিজেপির কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি কৈলাস বিজয়বর্গীয় এই খবর শুনে বলেন, ‘তিনি যদি বিজেপিতে যোগ দেন, তা হলে তাঁকে আমরা স্বাগত জানাব।’ এই প্রসঙ্গে তৃণমূল নেতারা যে ভাবে তাঁর সমালোচনা করেছেন, তার প্রতিক্রিয়ায় দিল্লিতেই তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে দীনেশ ত্রিবেদী বলেন, ‘যদি বিজেপিতে যোগই দিই, তা হলে অপরাধের কী আছে?’ সেই সঙ্গে বিজেপি নেতারা তাঁকে যে ভাবে তাঁদের দলে স্বাগত জানিয়েছেন, তাতে খুশি দীনেশ। তাঁদের সকলকেই তিনি ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
উল্লেখ্য, প্রশান্ত কিশোরকে তৃণমূলের রাজনৈতিক পরামর্শদাতা করে যে ভাবে দলের পরিচালনার দায়িত্ব তাঁর সংস্থার হাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তুলে দিয়েছেন, অন্য অনেক নেতার মতো দীনেশ ত্রিবেদীও মেনে নিতে পারেননি। ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি বলেওছিলেন, ‘সিপিএমের সঙ্গে লড়াই করার সময় তো কোনও কর্পোরেট সংস্থার প্রয়োজন হয়নি! তা হলে এখন হচ্ছে কেন?’
অন্যদিকে, নবান্ন অভিযানে পুলিশি আক্রমণের প্রতিবাদে পশ্চিমবাংলায় এদিন ১২ ঘণ্টার বন্ধের ডাক দিয়েছিল সিপিএম নেতৃত্বাধীন বাম দলগুলি। সমর্থন করেছিল কংগ্রেসও। রাজ্যের কোনও কোনও জায়গায় বাম ও কংগ্রেস কর্মীরা জোর করে বন্ধ করতে গেলে বিক্ষিপ্ত ভাবে হিংসার ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া রাজ্যের কোথাও বন্ধের তেমন কোনও প্রভাব এদিন পড়েনি।