বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ১০:১৮ পূর্বাহ্ন
আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে বিস্ফোরণের দু’দিন এবং পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে বোমা বিস্ফোরণের একদিন পর দক্ষিণ এশিয়ায় আবারও উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। মাত্র ছয় মাস আগের ভয়াবহ সংঘাতের পর প্রতিবেশী দুই দেশের মাঝে আবারও এসব বিস্ফোরণ ঘিরে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ শুরু হয়েছে।
ইসলামাবাদ ও দিল্লিতে কী ঘটেছে এবং পাকিস্তানি ও ভারতীয় কর্মকর্তারা হামলা সম্পর্কে কী বলছেন, নতুন এই উত্তেজনার বিশ্লেষণ তুলে ধরা হলো।
সোমবার স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টা ৫২ মিনিটে দিল্লির ঐতিহাসিক লাল কেল্লার কাছের মেট্রো স্টেশনের কাছাকাছি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। এতে অন্তত ১৩ জন নিহত ও ২০ জনের বেশি আহত হন।
দিল্লি পুলিশের কমিশনার সতীশ গোলচা বলেছেন, ‘‘একটি ধীরগতির গাড়ি সিগন্যালে থামার পরই বিস্ফোরণ ঘটে। এতে আশপাশের আরও কয়েকটি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’’
ভারত এখন পর্যন্ত এই বিস্ফোরণের ঘটনায় আনুষ্ঠানিকভাবে কারও ওপর দায় চাপায়নি। তবে দিল্লি পুলিশ ১৯৬৭ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় একটি মামলা দায়ের করেছে।
বিস্ফোরিত গাড়ির মূল মালিক মোহাম্মদ সালমানকে হরিয়ানার গুরগাঁও এলাকা থেকে আটক করেছে পুলিশ। ২০১৩ সালে তিনি গাড়িটি কিনেছিলেন, পরে তা বিক্রি করেন এবং গাড়িটি আবার হাতবদল হয়। স্থানীয় গণমাধ্যম বলছে, গাড়িটি সালমানের নামেই নিবন্ধিত এবং হরিয়ানার নম্বর প্লেট বহন করছিল। সালমান যে ব্যক্তির কাছে গাড়িটি বিক্রি করেছিলেন তাকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
পূর্ব-নির্ধারিত ভুটান সফরে গিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, ‘‘দিল্লিতে যা ঘটেছে, তা আমাদের সবাইকে নাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের সংস্থাগুলো ষড়যন্ত্রের মূল পর্যন্ত পৌঁছাবে এবং অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে।’’
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং বলেছেন, তদন্তকারীরা বিস্ফোরণের এই ঘটনায় দ্রুত ও বিস্তারিত অনুসন্ধান শুরু করেছেন। এই বিবৃতি সত্ত্বেও ভারতীয় নেতা ও নিরাপত্তা কর্মকর্তারা আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠীকে বিস্ফোরণের জন্য দায়ী করেননি।
ভারত বিস্ফোরণের ওই ঘটনায় এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানকে অভিযুক্ত করেনি। তবে পাকিস্তানের কর্মকর্তারা বলেছেন, দিল্লির হামলার জন্য ভারত শেষ পর্যন্ত ইসলামাবাদকেই দায়ী করবে বলে ধারণা করছেন তারা।
স্থানীয় গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ বলেছেন, যদি আগামী কয়েক ঘণ্টা কিংবা আগামীকালকের মধ্যে ভারত আমাদের ওপর দোষ চাপায়, তাতে আমি অবাক হব না।
দিল্লিতে হামলার ২৪ ঘণ্টারও কম সময় পর মঙ্গলবার দুপুর ১২টা ৩০ মিনিটে ইসলামাবাদের শ্রীনগরের জেলা ও দায়রা আদালত ভবনের প্রবেশপথে বিস্ফোরণ ঘটে।
পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহসিন নাকভি সাংবাদিকদের বলেন, এক আত্মঘাতী হামলাকারী আদালতের প্রবেশদ্বারে পুলিশের গাড়ির পাশে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। তিনি বলেন, হামলাকারী আদালত প্রাঙ্গণে প্রবেশের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে পুলিশের গাড়িকে লক্ষ্যবস্তু বানায়।
এই ঘটনায় অন্তত ১২ জন নিহত ও ৩০ জনের বেশি আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে পাঁচজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া ভিন্নমতাবলম্বী গোষ্ঠী জামা-উল-আহরার এই হামলার দায় স্বীকার করেছে। তবে আফগান তালেবানের অনুসারী টিটিপি হামলায় তাদের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেছে।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারি আত্মঘাতী ওই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন।
দেশটির প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ বলেছেন, ইসলামাবাদে এই হামলার পেছনে ভারতের প্রক্সি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো জড়িত। তবে এই অভিযোগের বিষয়ে কোনও প্রমাণ দেননি তিনি। এক বিবৃতিতে শেহবাজ শরিফ বলেছেন, ‘‘ভারতের পৃষ্ঠপোষকতায় পাকিস্তানের নিরীহ নাগরিকদের ওপর এ ধরনের হামলা নিন্দনীয়।’’
তিনি বলেন, ইসলামাবাদ ও ওয়ানায় সাম্প্রতিক হামলাগুলো ভারতের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের জঘন্য উদাহরণ। বিশ্বকে ভারতের এই ধরনের জঘন্য ষড়যন্ত্রের নিন্দা জানানোর এখনই সময়।
দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ বলেছেন, আফগানিস্তান থেকে ভারতের পরিকল্পনায় ইসলামাবাদে হামলা চালানো হয়েছে। গত কয়েক বছরে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সম্পর্কের ব্যাপক অব্নতি ঘটেছে। গত অক্টোবরের সীমান্ত সংঘর্ষের পর এই সম্পর্কের আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরের সংঘর্ষে আফগানিস্তানে ৫০ বেসামরিক ব্যক্তি নিহত ও ৪৪৭ জন আহত হয়েছিলেন। এর মধ্যে দেশটির রাজধানীতে মারা গেছেন কমপক্ষে ৫ জন।
গত ৭ নভেম্বর ইস্তাম্বুলে কাতার ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় পাকিস্তান-আফগানিস্তানের মাঝে শান্তি আলোচনা শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত তা ভেস্তে যায়। একই সময়ে ভারত ও তালেবানের সম্পর্ক নতুন মোড় নিয়েছে। আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি অক্টোবরের শুরুতে ভারত সফর করেছেন। ২০২১ সালে ক্ষমতায় ফিরে আসার পর আফগানিস্তানের শীর্ষ এই তালেবান নেতার ভারতে প্রথম সফর ছিল এটি।
চলতি সপ্তাহের শুরুর দিকে তুরস্কের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং গোয়েন্দা প্রধান আফগানিস্তানের সঙ্গে ইসলামাবাদের স্থগিত হয়ে যাওয়া শান্তি আলোচনা নিয়ে বৈঠক করার জন্য পাকিস্তান সফর করবেন বলে ঘোষণা দেন প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান।
আত্মঘাতী হামলার পর মঙ্গলবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া পোস্টে খাজা আসিফ লিখেছিলেন, পাকিস্তান বর্তমানে ‘‘যুদ্ধাবস্থায়’’ রয়েছে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল পাকিস্তানের অভিযোগকে ‘‘ভিত্তিহীন ও অমূলক’’ আখ্যায়িত করে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘‘পাকিস্তানের নেতারা স্পষ্টতই বিভ্রান্ত। তারা নিজেদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট থেকে জনগণের দৃষ্টি সরাতে এসব মনগড়া গল্প তৈরি করছেন।’’
নয়াদিল্লি বলছে, ইসলামাবাদের এই অভিযোগ মূলত পাকিস্তানের বিতর্কিত ২৭তম সংবিধান সংশোধনী বিল পাসের রাজনৈতিক চাপ থেকে দৃষ্টি সরানোর কৌশল। এই বিলটি সেনাবাহিনীর ক্ষমতা আরও বাড়াবে এবং শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের বিচারের বাইরে রাখবে বলে দেশটির বিরোধীদল ও আইন বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
জয়সওয়াল বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাস্তবতা সম্পর্কে ভালোভাবেই অবগত এবং পাকিস্তানের বিভ্রান্তিকর কৌশলে তারা বিভ্রান্ত হবে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মে মাসের সংঘাতের পর ভারত বর্তমানে তুলনামূলক সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। সেই কাশ্মিরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহত হয়েছিলেন। ভারত ওই হামলার দায় পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি গোষ্ঠী লস্কর-ই-তৈয়বার ওপর চাপিয়েছিল।
ওই হামলার প্রতিশোধে পাকিস্তানে জঙ্গি আস্তানা লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ভারত। জবাবে ভারতের সীমান্ত লাগোয়া বিভিন্ন শহরে হামলা চালায় পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী। কয়েক দিনের বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা-পাল্টা হামলার পর গত ১০ মে যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছায় উভয় দেশ।
দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান আল-জাজিরাকে বলেছেন, ‘‘পাকিস্তান এসব হামলার ঘটনায় ভারতকে দায়ী করবে; এটা নতুন কিছু নয়। তবে ভারতের অবস্থান এবার জটিল। কারণ মে মাসে প্রমাণ ছাড়াই আক্রমণ চালিয়ে আন্তর্জাতিক সমর্থন হারিয়েছিল দিল্লি।
কুগেলম্যান বলেন, দিল্লি ও ইসলামাবাদের মতো রাজধানীতে বিস্ফোরণ বিরল ঘটনা; যা দক্ষিণ এশিয়ার সামগ্রিক নিরাপত্তা ঝুঁকিকে স্পষ্ট করে তুলছে।
‘এসব হামলার প্রভাব শুধু ভারত ও পাকিস্তানের নয়; আফগানিস্তানের ওপরও পড়বে। পাকিস্তান তালেবান-সমর্থিত জঙ্গিদের দায়ী করছে। অন্যদিকে তালেবান ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করছে।’’
বিশ্লেষকদের মতে, এখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো দুই দেশের প্রতিক্রিয়া কেমন হয়। পাকিস্তান আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ নিতে পারে। কারণ ইসলামাবাদ মনে করছে, হামলাটি আফগান মদদপুষ্ট গোষ্ঠীর মাধ্যমে চালানো হয়েছে।
কুগেলম্যান বলেন, তালেবানের সঙ্গে পাকিস্তানের আলোচনা সফল হয়নি। ইসলামাবাদে এই হামলা মানসিকভাবে পাকিস্তানের বেসামরিক ও সামরিক নেতৃত্বের জন্য খুবই ক্ষতিকর। কারণ ইসলামাবাদ তুলনামূলকভাবে শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ এবং অত্যন্ত সুরক্ষিত রাজধানী শহর।
‘‘এই ধরণের বিস্ফোরণ খুবই অস্বাভাবিক। যে কারণে এটি পাকিস্তানের জন্য নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা ব্যর্থতার বড় দৃষ্টান্ত।’’
সূত্র: আল-জাজিরা।