বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা: সংবাদের শিরোনামে সেই নন্দীগ্রামে। এবার সেই সংবাদের কেন্দ্রবিন্দু স্বয়ং পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী। সেখানে একটি মন্দিরে গিয়ে তিনি আহত হয়েছেন। ঘটনাটির পরিপ্রেক্ষিতে যদিও তিনি ষড়যন্ত্রের অভিযোগই তুলেছেন। তবে তাঁর অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন বিরোধী দলের নেতা ও নেত্রীরা। তাঁদের স্পষ্ট বক্তব্য, হারবেন বুঝতে পেরে মানুষের মনে নিজের সম্পর্কে সহানুভূতি জাগিয়ে তুলতে চাইছেন। তাই এমন মোটা দাগের নাটক করছেন তিনি। ঘটনাটিকে অনেকেই রাজনৈতিক ভণ্ডামো বলে উল্লেখ করেছেন। পাশাপাশি ঘটনার সিবিআই তদন্তের দাবি জানিয়েছে বিজেপি। তবে পুরো ঘটনার রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
বুধবার তৃণমূল ও বিজেপি–র দুটি কর্মসূচিতে দুই প্রার্থী নন্দীগ্রামেই ছিলেন। এদিন দুপুরে হেলিকপ্টারে নন্দীগ্রামে যান মমতা। স্থানীয় মন্দিরে পুজো দিয়ে হলদিয়ায় মনোনয়ন জমা দিতে যান। আর শুভেন্দু দলের নির্বাচনী কার্যালয় উদ্বোধন করেন। এদিকে, হলদিয়া মহকুমা শাসকের কার্যালয়ে মনোনয়ন পত্র পেশ করার পর মুখ্যমন্ত্রী নন্দীগ্রামে একের পর এক মন্দিরে গিয়ে পুজো দেন। সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে গিয়ে প্রচারের কাজও করছিলেন। একদিকে নিরাপত্তা রক্ষী, পুলিশ, পাশাপাশি অসংখ্য দলীয় কর্মী এবং সমস্ত সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিরা ঘিরেছিলেন মমতাকে। তাঁদের কাছেই মমতা দাবি করেন, নন্দীগ্রামে তিনিই জয়ী হবেন। এরই মধ্যে আচমকা ছন্দপতন। রানিচকে একটি মন্দিরে হরিনাম সংকীর্তনে যোগ দেন তিনি। সেখান থেকে বের হওয়ার সময় হঠাৎই পড়ে যান। তাঁর বাঁ পায়ে চোট লাগে। যদিও মুখ্যমন্ত্রী অভিযোগ করেছেন, চার–পাঁচজন নাকি তাঁকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে। ঘটনাটি ‘ষড়যন্ত্র’ বলে উল্লেখ করেন তিনি। সূত্রের খবর, তখন সেখানে কোনও পুলিশ, নিরাপত্তা রক্ষী বা সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধি নাকি উপস্থিত ছিল না। তাই গোটা ঘটনাটি নিয়ে রহস্য জমাট বেঁধেছে।
গাড়িতে উঠে মমতা সাংবাদিকদের জানান, তাঁর বাঁ পা ফুলে গিয়েছে। কপাল এবং মাথায়ও চোট লেগেছে। এমনকী, তাঁর বুকেও চোট লেগেছে। জ্বর জ্বর ভাবও রয়েছে। সন্ধ্যায় ‘গ্রিন করিডর’ করে তাঁকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসার জন্য পাঁচ সদস্যের একটি মেডিক্যাল টিম তৈরি হয়েছে। তবে এই ঘটনার প্রভাব পড়ে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায়। কলকাতা, হুগলি, জলপাইগুড়িতে তৃণমূল কর্মীরা পথ অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। কোথাও প্রতিবাদ মিছিল বের করা হয়। ঘটনার খবর পেয়েই সক্রিয় হয়ে ওঠে নির্বাচন কমিশন। জেলা প্রশাসনের রিপোর্ট তলব করে তারা। মমতা ‘জেড প্লাস’ ক্যাটাগরির নিরাপত্তা পান। তার মধ্যেই এমন ঘটনা ঘটায় তাঁর নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। রাতে তাঁকে দেখতে হাসপাতালে যান রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়। কিন্তু তাঁকে দেখেই তৃণমূল নেতা ও কর্মীরা ‘গো ব্যাক’ স্লোগান দিতে থাকেন। তৃণমূল নেতা ও কর্মীদের এমন আচরণ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
মমতার আহত হওয়ার খবরে প্রথম মুখ খোলেন বিজেপি নেতা অর্জুন সিং। তিনি পরিষ্কার বলেন, ‘মিথ্যে কথা বলছেন মুখ্যমন্ত্রী। পুরোটাই নাটক। আসলে তিনি প্রথম দিনই বুঝে গিয়েছেন, নন্দীগ্রামে তিনি জিততে পারবেন না। মানুষ তাঁর পাশে নেই। পুলিশ ও প্রশাসন দিয়ে চোখ রাঙিয়ে এতদিন তিনি মানুষকে বোবা বানিয়ে রেখেছিলেন। এখন নির্বাচন কমিশন রয়েছে। তাই সেটা সম্ভব হচ্ছে না। সেই কারণে সহানুভূতি পাওয়ার আশায় এই ধরনের একটা নাটক করেছেন।’ তাঁর পরিষ্কার বক্তব্য, ‘তা ছাড়া রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীই তো পুলিশমন্ত্রী। তিনি যেখানেই যান না কেন, ২ কিলোমিটার আগে থেকেই গাড়ি আটকে দেওয়া হয়। এর মধ্যেও যদি কেউ তাঁকে ধাক্কা মেরে থাকে, তা হলে তাঁর ফাঁসি হওয়া উচিত।’ শুধু তিনিই নন, বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা কৈলাস বিজয়বর্গীয়ও বলেছেন, ‘কার এত ক্ষমতা যে, মুখ্যমন্ত্রীকে ধাক্কা মারে? ঘটনার সিবিআই তদন্তের দাবি জানাচ্ছি।’
বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেছেন, ‘তিনি মুখ্যমন্ত্রী। জেড প্লাস ক্যাটেগরির নিরাপত্তা পান। রাজ্যের আইন–শৃঙ্খলাও তাঁর হাতেই। তিনি যদি এ ভাবে আক্রান্ত হন, তা হলে সাধারণ মানুষের অবস্থা কী হবে?’ তিনিও ঘটনার সিবিআই তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। বিজেপি মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘মমতা চোট পেয়েছেন, এটা খুবই দুঃখজনক ঘটনা। তিনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন। তবে, তাঁর নিরাপত্তায় কোথায় কী ত্রুটি হয়েছে, তা অতি উচ্চ পর্যায়ে তদন্ত করে দেখা উচিত।’ অন্যদিকে, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরিও স্পষ্ট বলেছেন, ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এমন নাটক আগাগোড়াই করে এসেছেন। এখনও তা–ই করছেন। এটা সহানুভূতি পাওয়ার জন্য তাঁর একটা রাজনৈতিক ভণ্ডামি।’ আবার, এদিনই নন্দীগ্রামে নিজেদের প্রার্থী ঘোষণা করেছে সিপিএম। তাদের প্রার্থী হয়েছেন মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আহত হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সবসময় নাটক করেন। এটা তাঁর আরও একটা নাটকই।’
তবে এই ঘটনা নিয়ে মমতার প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপি প্রার্থী শুভেন্দু অধিকারী কোনও প্রতিক্রিয়া জানাননি। অবশ্য, কাঁথি ও তমলুকের সাংসদ শিশির অধিকারি এবং দিব্যেন্দু অধিকারি ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে মমতার দ্রুত আরোগ্য কামনা করেছেন। কিন্তু, তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষ অভিযোগ করেছেন, ‘এই ঘটনা আসলে একটা চক্রান্ত। বিরোধীদের পায়ের তলায় মাটি সরে যাচ্ছে বলে মুখ্যমন্ত্রীর ওপর আঘাত হানা হয়েছে।’ রাজ্যের মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য অভিযোগ করেছেন, ‘এই ঘটনা ঘটিয়েছে বিজেপিই। প্রচারের প্রথমদিনেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুঝিয়ে দিয়েছিলেন নন্দীগ্রামের মানুষ তাঁর সঙ্গেই রয়েছেন। তার পরই এই হামলা হল।’