বিশেষ প্রতিবেদন,কলকাতা : চাঞ্চল্যকর ঘটনা পশ্চিমবাংলার রাজনীতিতে। বৃহস্পতিবার বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জগৎপ্রসাদ (জে পি) নাড্ডার কনভয়ে হামলা চালানোর ঘটনার পরই মুখ খোলেন জগদীপ ধনকড়। তিনি সরাসরি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে চিঠি লিখে জানিয়ে দিয়েছেন, ‘পশ্চিমবাংলার আইন–শৃঙ্খলার অবস্থা খুবই খারাপ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের উচিত এবার বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করা। মুখ্যমন্ত্রী এবং পুলিশ ও প্রশাসনের অনেককে আমি বারবার রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে সতর্ক করেছি। কিন্তু সরকার বা প্রশাসনের তরফে কোনও ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। ফলে রাজ্যে সংবিধান মেনে সরকার চালানো খুবই কঠিন হয়ে উঠেছে।’
রাজ্যপালের চিঠির পরই নড়েচড়ে বসে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। শুধু তাই নয়, মন্ত্রকের তরফে রাজ্যের মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ডিজিকে দিল্লিতে তলব করা হয়। দিল্লি থেকে নবান্নে পাঠানো নির্দেশে ১৪ ডিসেম্বর তাঁদের সশরীরে দিল্লিতে এসে দেখা করতে বলা হয়েছে। যদিও জগদীপ ধনকড় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে চিঠিতে শুধু এ কথা বলেই থেমে যাননি। তিনি আরও বলেছেন, ‘গতকাল ছিল মানবাধিকরা দিবস। গোটা বিশ্ব ওই দিবস পালন করেছে। আর পশ্চিমবঙ্গে কিন্তু বিপরীত ঘটনাটাই ঘটেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য আমার কাছে রীতিমতো উদ্বেগজনক মনে হয়েছে।’ পাশাপাশি এদিন তিনি টুইট করে বলেছেন, ‘বৃহস্পতিবার বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতিকে মুখ্যমন্ত্রী যে ভাষায় আক্রমণ করেছেন, তাঁর উচিত সেই মন্তব্য প্রত্যাহার করে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া। তা হলে তারঁ ভাবমূর্তির উন্নতি হবে। মুখ্যমন্ত্রীর একটা দায়িত্ব আছে। তিনি সংবিধান মেনে চলতে বাধ্য। মুখ্যমন্ত্রীকে বলছি, দয়া করে আগুন নিয়ে খেলবেন না। তিনি যদি সংবিধান মেনে না চলেন, তা হলে তার পর আমার কাজ শুরু হবে।’
রাজ্যপালের এ কথার মধ্যেই পশ্চিমবাংলায় রাষ্ট্রপতি শাসন জারির ইঙ্গিত রয়েছে বলে অনেকেই মনে করছেন। বিষয়টি নিয়ে নবান্নেও আলোচনা হয়েছে বলে সূত্রের খবর। তবে তা নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ্যমন্ত্রী বা সরকারের তরফে কোনও বক্তব্য পেশ করা হয়নি বা কোনও বিবৃতিও দেওয়া হয়নি। তবে দিল্লি যে বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতির কনভয়ের ওপর হামলাকে ভালো ভাবে নেয়নি তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে শুক্রবার আরও একটি ঘটনায়। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এদিন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নাড্ডাকে ফোন করে তাঁর শারীরিক অবস্থার খোঁজ নেওয়ার পাশাপাশি ঘটনা সম্পর্কেও জানতে চান। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ফোন করেন বিজেপির সর্বভারতীয় সহসভাপতি মুকুল রায় এবং সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক কৈলাস বিজয়বর্গীয়কে। তাঁদের শারীরিক অবস্থার খোঁজ নেন শাহ। ওইদিন মুকুল রায় এবং কৈলাস বিজয়বর্গীয়ও ওই ঘটনায় জখম হয়েছেন।
এদিকে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ডেকে পাঠানো নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র সচিবকে রাজ্যের মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের তরফে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, জে পি নাড্ডার কনভয়ের জন্য রাজ্যের তরফে যথাযথ সুরক্ষার বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। তার পরেও যে অভিযোগ উঠেছে, তা গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। এই অভিযোগে ইতিমধ্যেই ৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আর তাই মুখ্যসচিব এবং ডিজিকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তরফে যে ভাবে ডেকে পাঠানো হয়েছে, তার কি আর প্রয়োজন আছে? একই সঙ্গে সেই নির্দেশ খারিজ করারও আবেদন জানিয়েছেন মুখ্যসচিব। যদিও তাঁর চিঠির জবাবে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র সচিব এদিন রাত পর্যন্ত কোনও জবাব দিয়েছেন বলে জানা যায়নি। সম্ভবত শনিবার চিঠির জবাব আসতে পারে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র সচিবের কাছ থেকে। সূত্রের খবর, মুখ্যসচিবের এ ভাবে নির্দেশ এড়িয়ে যাওয়ার চিঠিকে ভালো ভাবে নেয়নি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।
অন্যদিকে, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তরফে মুখ্যসচিব ও ডিজিকে ডেকে পাঠানো এবং জে পি নাড্ডার কনভয়ে হামলা নিয়ে তাঁরই বিরুদ্ধে আক্রমণ শানিয়েছে তৃণমূল। দলের সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘নাড্ডা তো ক্রিমিনালদের সঙ্গে নিয়ে ঘুরছেন। যিনি জেড ক্যাটাগরির নিরাপত্তা নিয়ে ঘুরছেন, তা হলে তাঁর কনভয়ে অত গাড়ি বা মোটর বাইক কেন?’ তাঁর দাবি, ‘নাড্ডাই আইন ভেঙেছেন।’ কেন্দ্রের প্রতি রাজ্যের এমন আচরণ নিয়ে বিজেপি নেতা জয়প্রকাশ মজুমদার বলেন, ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার এখন মোটেই পশ্চিমবাংলার আইন–শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না। রাস্তায় তাঁদের সঙ্গী গুন্ডারা। অন্য রাজ্য থেকে কেউ এলে তাঁকে বহিরাগত বলে গালিগালাজ করছে। এমন একটা বিদ্বেষমূলক পরিবেশ তৈরি করতে চাইছে যেন ভারত এবং পশ্চিমবাংলা আলাদা দুটি দেশ। এই পরিবেশ কাঙ্ক্ষিত নয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে এই ঝগড়া করছেন।’
আবার, জেপি নাড্ডার কনভয়ে হামলার ঘটনার পরই বৃহস্পতিবার রাতে দিল্লির বঙ্গভবনে হামলা চালানোর চেষ্টার অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। যদিও অভিযোগ অস্বীকার করেছে তৃণমূল। এ ছাড়া, তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলোর বাইরেও কারা কালি লেপে দিয়ে যায় বলে অভিযোগ উঠেছে। তৃণমূল অভিযোগের আঙুল তুলেছে বিজেপির বিরুদ্ধে। ওই দুই ঘটনা নিয়ে তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায় বলেছেন, ‘যারা ভিতু, তারাই রাতের অন্ধকারে এমন কাজ করে।’ পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রী–সহ তৃণমূল নেতারা যে ভাবে বিজেপিকে দিল্লির পার্টি এবং বিজেপির সর্বভারতীয় নেতাদের বহিরাগত বলে দেগে দিচ্ছেন, তার সরাসরি সমালোচনা করেন বিজেপি নেতা সায়ন্তন বসু। তিনি রীতিমতো হুমকি দিয়ে বলেন, ‘এ রকম চলতে থাকলে এর পর তৃণমূল নেতাদের পশ্চিমবাংলার বাইরে বের হওয়া কঠিন হয়ে যাবে। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না।’
এ ছাড়া, একজন মুখ্যমন্ত্রী হয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে ভাষায় বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতিকে আক্রমণ করেছেন, তার সমালোচনা করেছেন বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসুও। তিনি বলেছেন, ‘যেমন মুখ্যমন্ত্রী, তেমন বক্তব্য তো হবেই। হরিনাথ দে আমাদের বিখ্যাত ভাষাবিদ। আর একজন ভাষাবিদের কথা এখন জানতে পারছি। তিনি হলেন মুখ্যমন্ত্রী। আর, তিনি যে ভাষায় চাড্ডা, নাড্ডা, ফাড্ডা, ছাড্ডা বলেছেন, সেখানে আমার বোধ হয় কিছু বলা সাজে না। চাড্ডা মানে পঞ্জাবি। পঞ্জাবি ছাড়া চাড্ডা হয় না। চাড্ডা, নাড্ডা, ফাড্ডা, ছাড্ডা বলে ছন্দ মিলিয়ে কথা বলতে গিয়ে যে গাল দেওয়া হল, তার পরিণাম খুব খারাপই হবে। জাতীয় সংহতির পক্ষে বিপজ্জনক হবে ব্যাপারটা।’
আর ঘটনা নিয়ে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির দাবি, ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেছেন, নাড্ডার ওপর হামলা নাকি সাজানো। আমিও তাই মনে করি। তবে ঘটনাটা সাজিয়েছে তৃণমূলই। অনেক প্ল্যান করেই সাজিয়েছে। কারণ, সংখ্যালঘুদের মমতা বোঝাতে চেয়েছেন, দেখো, আমরাই ওদের মারতে পারি।’ তিনি বলেছেন, ‘আমি আগেই বলেছি, বাংলায় সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জন্ম দিয়েছেন মমতা। বিধানসভা ভোটের আগে মুসলমানদের মমতা দেখাতে চেয়েছেন, বিজেপি সভাপতির কনভয়ে হামলার ক্ষমতা এখানে একমাত্র তৃণমূলেরই আছে। লোকসভা ভোটের আগেও কেউ ‘জয় শ্রীরাম’ বললে তিনি তেড়ে যেতেন। সেটা ছিল আসলে লোক দেখানো। টার্গেটেড অডিয়েন্সের জন্য।’