বিশেষ প্রতিবেদন,কলকাতা: শুভেন্দু অধিকারীকে নিয়ে বিতর্ক এখনও থামেনি। কারণ, মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিলেও বিধায়ক পদ এখনও ছাড়েননি তিনি। (যদিও যে কোনও দিন বিধায়ক এবং দলের সদস্যপদ তিনি ছাড়তে পারেন)। এর মধ্যে দলের অস্বস্তি বাড়িয়ে দিলেন মন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়। একটু ঘুরিয়ে দলের নেতৃত্বের ওপর একরাশ ক্ষোভ উগরে দিলেন শনিবার।
কোচবিহার দক্ষিণের বিধায়ক মিহির গোস্বামী ইতিমধ্যে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। বিধায়ক শীলভদ্র দত্ত দল না ছাড়লেও দলের বিরুদ্ধে নিজের ক্ষোভ গোপন রাখেননি। এখনও রাখছেন না। মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক মান ভাঙানোর উদ্যোগ নিলেও শীলভদ্রের নাগাল পাননি। এর মধ্যে শুক্র ও শনিবার, এই দু’দিন তিন বড় তৃণমূল নেতা যে আচরণ করলেন, তাতে দলের শীর্ষনেতাদের মাথাব্যথা বেড়ে যাওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। শুক্রবার শুভেন্দু অধিকারীকে নিয়ে মুখ খোলেন অতীন ঘোষ। মন্তব্য করেন, ‘শুভেন্দু দল ছাড়লে বড় ক্ষতি হয়ে যাবে দলের। জনভিত্তি আছে, দলে এমন নেতার সংখ্যা খুবই কম। শুভেন্দু তাঁদেরই একজন।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিভিন্ন সময় যাঁরা দল ও দলনেত্রীকে আক্রমণ করেছেন, তাঁরা এখন দলে এসে বড় জায়গা পেয়ে যাচ্ছেন। আমাদের মতো যাঁরা শুরু থেকে দলটা করছেন, তাঁদের অনেকেই আজ হতাশ।’
শুধু অতীন ঘোষই নন, শুক্রবার দলের বিরুদ্ধেই সরাসরি পদক্ষেপ করেন মন্ত্রী সাধন পাণ্ডে। ওইদিন উল্টোডাঙায় পশ্চিমবাংলা সরকারের ‘দুয়ারে সরকার’ কর্মসূচির শিবির হচ্ছিল। অভিযোগ ওঠে, শিবির করে তৃণমূল নেতা ও কর্মীরা নাম নথিভুক্ত করছেন। তখন সেখানে গিয়ে মন্ত্রী সাধন পাণ্ডে জানান, এটা সরকারের কর্মসূচি। সেখানে সরকারের কাজ রাজনৈতিক দল কেন করবে? শুধু তাই নয়, তিনি সরকারি কর্মসূচিতে দলীয় হস্তক্ষেপের অভিযোগে শাসক দলের পেতে রাখা টেবিলও উল্টে দেন। ফলে শুক্রবার সরকারের ওই কর্মসূচি ভণ্ডুল হয়ে যায়। সেজন্য অবশ্য দলের অনেক নেতা সাধনবাবুর দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন। অনেকে তাঁর বিরুদ্ধে তোপও দাগেন। তবে অনেক সাধারণ মানুষ তাঁর ওই কাজের জন্য সাধুবাদই জানিয়েছেন।
সেই ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই একই ভাবে দলের অস্বস্তি বাড়িয়ে দিলেন আরেক মন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়। শনিবার হরিদেবপুর এলাকার একটি বস্ত্র বিতরণ অনুষ্ঠানে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার খুব খারাপ লাগে, যখন দেখি যোগ্যতা ও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেও আমাকে পিছনের সারিতে ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়েছে। যে মুখগুলোকে মানুষ পছন্দ করে না, যাঁরা দুর্নীতিগ্রস্ত, শুধু স্তাবক বলে তাঁদেরই আজ সামনের সারিতে আনা হচ্ছে। এগুলো সবই এক–এক সময়ের যন্ত্রণা।’ স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, কার স্তাবকতা করলে বড় পদ পাওয়া যাচ্ছে? তার মানে, রাজীব কি সরাসরি দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই নিশানা করছেন? এর পরই তিনি টেনে আনেন শুভেন্দু–প্রসঙ্গ। বলেন, ‘শুভেন্দু চলে গেলে দলে অপূরণীয় শূন্যতা তৈরি হবে। তাঁর মতো আরও অনেক নেতার মনেই অনেক ক্ষোভ, অভিমান জমে আছে। কেন তাঁদের মনে এত অভিমান বা ক্ষোভের জন্ম হল, তা আরও আগে অনুসন্ধান করা জরুরি ছিল। আরও আগে ভাবা উচিত ছিল।’
এর পরই তাঁর গলায় ফুটে ওঠে একরাশ হতাশা। বলেন, ‘যাঁরা মাটিতে নেমে কাজ করেন, মাঠেঘাটে ঘুরে মানুষের পাশে থাকেন, দলে তাঁরা আর প্রাধান্য পান না। দলে তো এখন ক্ষমতালোভীরাই জায়গা পাচ্ছে। অথচ তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলার উপায় নেই। এখন তো ভালোকে ভালো, খারাপকে খারাপ বললেই সমস্যা হয়ে যাচ্ছে।’ যদিও রাজীবের মন্তব্যের পাল্টা মুখ খুলেছেন অপর মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমও। তবে তিনি পাল্টা আক্রমণে যাননি। বেশ সতর্ক ভাবেই বলেছেন, ‘রাজীব ভালো ছেলে। মন্ত্রী হিসেবেও ভালো কাজ করছে। আমাদের ছোট ভাইয়ের মতো। কিন্তু ওর মনে রাখা উচিত, আমাদের সকলের মাথার ওপর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রয়েছেন। আর তিনি যখন মাথার ওপর রয়েছেন, তখন চিন্তার আর কারণ নেই।’
কিন্তু সত্যিই কি চিন্তার কোনও কারণ নেই? শাসক দলের তরফে এখন অবশ্য বিক্ষুব্ধ নেতাদের সমস্ত বিবাদ বিসংবাদ মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু সেই নেতাদের একাংশের বক্তব্য, বিধানসভা নির্বাচনে দলের অবস্থা খুব একটা আশার জায়গায় নেই। অবস্থা সামাল দেওয়ার জন্যই এই উদ্যোগগুলি নেওয়া হচ্ছে। কোনও রকমে ভোট বৈতরণী পার হতে পারলে ফের আগের অবস্থাই দেখা যাবে দলের মধ্যে। তাই দলের উদ্যোগের মাঝেও বেসুরো গাইছেন অনেক নেতা এবং এমনকী, বেশ কয়েকজন মন্ত্রীও।