বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা : রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষার অবসান। ভয়ঙ্কর করোনা রোধে শনিবার পশ্চিমবঙ্গ–সহ গোটা ভারতে করোনার টিকা দেওয়ার কর্মসূচি শুরু হল। সকাল সাড়ে ১০টায় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এই টিকাকরণের সূচনা করে দিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। প্রথম দিনেই দেশজুড়ে ৩ হাজার ৬টি কেন্দ্রে প্রায় তিন লক্ষ মানুষকে টিকা দেওয়া হয়। এভাবে প্রথম ধাপে তিন কোটি স্বাস্থ্যকর্মী ও অন্যান্য ফ্লন্টলাইন কর্মীদের টিকা দেওয়া হবে। এর মধ্যে আছেন সেনাবাহিনীর মানুষও।
এদিন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জানান, ইতিহাসে এত বড় টিকাকরণ কর্মসূচি এর আগে কখনও হয়নি। সেই সঙ্গে করোনাকে যুদ্ধে হারানোর প্রক্রিয়া আজ শুরু হয়ে গেল। অবশ্য টিকাকরণ শুরু হলেও মাস্ক ব্যবহারে এবং দূরত্ববিধি বজায় রাখার ক্ষেত্রে কোনও রকম ঢিলেমি রাখা চলবে না। টিকা নিয়ে যাবতীয় সংশয়ও এদিন উড়িয়ে দেন তিনি। জানান, খুব ভালো ভাবে পরীক্ষা করেই দুটি টিকাকে ছাড়পত্র দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তাই চিন্তার কিছু নেই। স্পষ্ট বলেন, ‘কোনও গুজবে কান না দেবেন না। আমাদের সকলেরই লক্ষ্য, করোনার অভিশাপ থেকে মুক্ত হওয়া।’ সেই সঙ্গে এ কথাও মনে করিয়ে দেন, ‘এই টিকার দুটো ডোজ নিতে হবে। টিকার দ্বিতীয় ডোজ না নেওয়ার ভুল কেউ করবেন না। দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার দুই সপ্তাহ পর থেকেই করোনা প্রতিরোধের ক্ষমতা তৈরি হবে আমাদের শরীরে।’
এদিন পশ্চিমবঙ্গেও টিকাকরণ কর্মসূচি শুরু হয়ে যায়। প্রথম ধাপে মোট ২০৭টি হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্রে টিকা দেওয়া হচ্ছে। প্রথম দফায় টিকাকরণের জন্য চিকিৎসক, নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীদেরই অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। টিকাকরণের জন্য আগেই তাঁদের নাম নথিভুক্ত করা হয়েছিল। আপাতত ব্রিটিশ–সুইডিশ সংস্থা অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির তৈরি কোভিশিল্ড প্রতিষেধকটিই তাঁদের শরীরে প্রয়োগ করা হবে। তবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এদিন অভিযোগ করেছেন, ‘কেন্দ্র থেকে পাঠানো টিকার পরিমাণ যথেষ্ট নয়। প্রয়োজনে প্রস্তুতকারী সংস্থার কাছ থেকে সরাসরি করোনা প্রতিষেধক কিনবে রাজ্য। রাজ্যের প্রত্যেকেই বিনামূল্যে কোভিড ভ্যাকসিন পাবেন। প্রয়োজনে খরচ দেবে রাজ্য সরকার।’
কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর এই দাবি ঘিরে সংশয়ও রয়েছে। কেন না, কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকই প্রস্তুতকারী সংস্থার কাছ থেকে সরাসরি টিকা কিনছে। এখনও কোনও রাজ্যকে সরাসরি টিকা বিক্রি করার অনুমতি পায়নি সংস্থাগুলি। তাই অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, তা হলে রাজ্য সরকার কী করে নিজেরাই টিকা কিনবে? তা ছাড়া টিকা প্রথম ধাপে কতজনকে দেওয়া হবে, সেই হিসেব করেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তরফে রাজ্যগুলিকে পাঠানো হচ্ছে। একসঙ্গে সব পাঠানো সম্ভব না হলে পরে তা পাঠিয়ে দেওয়া হবে। এদিকে, জনপ্রতিনিধিদের এখনই টিকা দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। একই কথা বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু রাজ্যে কিছু বিপরীত ঘটনাও ঘটেছে এদিন। শনিবার কাটোয়া মহকুমা হাসপাতালে ৩৪ জন চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মী টিকা নেন। তার পরই কাটোয়ার তৃণমূল বিধায়ক তথা পুরপ্রশাসক রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় করোনা টিকার প্রথম ডোজ নেন। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, কোন যুক্তিতে টিকা পেলেন তিনি?
কাটোয়া মহকুমা হাসপাতালের তরফে জানানো হয়েছে, রোগী কল্যাণ সমিতির সদস্য হওয়ায় কাটোয়ার বিধায়ককে টিকা দেওয়া হয়। প্রশ্ন হল, রোগী কল্যাণ সমিতির সদস্য কি আদৌও প্রথমসারির করোনা যোদ্ধা? তবে বিধায়ক সাফ জানিয়েছেন, তালিকায় তাঁর নামে ছিল। তাই তিনি টিকা নিয়েছেন। আবার রোগী কল্যাণ সমিতির সদস্য হওয়ার জন্য প্রথম দিনেই ভাতার স্টেট জেনারেলে হাসপাতালে টিকা নেন ভাতারের তৃণমূল বিধায়ক সুভাষ মণ্ডল এবং প্রাক্তন বিধায়ক বনমালি হাজরা। সুভাষ মণ্ডলকে দিয়েই এদিন ভাতারে টিকাকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক প্রণব রায় জানান, সুভাষ মণ্ডল এবং বনমালি হাজরা রোগী কল্যাণ সমিতির সদস্য। প্রয়োজনে হাসপাতালের পাশে থাকেন। তাই তাঁদের টিকা দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া, আলিপুরদুয়ার জেলা হাসপাতালের টিকা প্রাপকদের তালিকায় প্রথমেই ছিলেন আলিপুুরদুয়ারের তৃণমূল বিধায়ক সৌরভ চক্রবর্তী। বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক শুরু তৈরি হয়। আলিপুরদুয়ার বিজেপির জেলা কমিটির সভাপতি গঙ্গাপ্রসাদ শর্মা বলেন, ‘বিধায়কের ডক্টরেট উপাধি থাকলেও তিনি চিকিৎসক নন। তা সত্ত্বেও মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে প্রথম টিকা পাওয়ার চেষ্টা করছিলেন বিধায়ক। টিকাকরণের ক্ষেত্রেও দলের লোকেদের সুবিধা পাইয়ে দিচ্ছে তৃণমূল সরকার।’ যদিও সৌরভ বলেছেন, ‘আমার যেহেতু পিএইচডি আছে এবং আমি জেলা হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান, সেজন্য হয়তো জেলা স্বাস্থ্য বিভাগে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। আমি যখনই জানতে পেরেছি, তখনই টিকা নিতে অস্বীকার করেছি।’
এদিকে, কলকাতার বিধানচন্দ্র রায় হাসপাতালের এক নার্স এই টিকা নেওয়ার পর অচৈতন্য হয়ে পড়লে চাঞ্চল্য তৈরি হয়। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে নীলরতন সরকার হাসপাতালের সিসিইউতে ভর্তি করা হয়। জানা গিয়েছে, ওই নার্সের অ্যাজমা আছে। তাঁর অসুস্থতার কারণ টিকা নেওয়াই কিনা, তা চিকিৎসকরা খতিয়ে দেখছেন। এ ছাড়া, রামপুরহাটেও এক স্বাস্থ্যকর্মীর শরীরে হালকা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। দু’জনকে পরীক্ষা করে দেখার পর রাতে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, চিন্তার কোনও কারণ নেই।
অন্যদিকে, ভারত বায়োটেকের তৈরি কোভ্যাক্সিন যাঁরা নিচ্ছেন, তাঁদের একটি অনুমতিপত্রে সই করতে হচ্ছে। শর্ত মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দিতে হচ্ছে তাঁদের। আবার কারও শরীরে টিকার কারণে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলে ক্ষতিপূরণ ও চিকিৎসার দায়িত্ব নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে ওই অনুমতিপত্রে। ক্ষতিপূরণের মাত্রা ঠিক করবে আইসিএমআর–এর এথিকস কমিটি।