আন্তর্জাতিক ডেস্ক: সীমান্তে কেবল ‘এক নয়, তিন প্রতিপক্ষের’ বিরুদ্ধে ভারতকে লড়তে হয়েছে বলে দাবি করেছেন ভারতের উপ-সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল রাহুল আর সিং। তিনি বলেছেন, প্রতিপক্ষ হিসাবে পাকিস্তান ‘দৃশ্যমান’ হলেও নেপথ্যে থেকে চীন এবং তুরস্ক তাদের সাহায্য করেছে।
ভারতের ডেপুটি চিফ অব আর্মি স্টাফ (কেপাবিলিটি, ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড সাসটেনেন্স) লেফটেন্যান্ট জেনারেল রাহুল আর সিং বলেছেন, চীন পাকিস্তানকে শুধু সামরিক সরঞ্জামই দেয়নি, সেগুলোর কার্যকারিতা যাচাইয়ের ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করেছে পাকিস্তান।
ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) নিউ এজ মিলিটারি টেকনোলজিস প্রোগ্রামে বক্তব্য রাখতে গিয়ে ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের সময় তিনি এই মন্তব্য করেন। ‘অপারেশন সিন্দুর’ থেকে ভারত কী শিক্ষা নিতে পারে সে বিষয়ে যেমন মত প্রকাশ করেছেন তিনি, তেমনই কয়েকটা ক্ষেত্রে রাখঢাক না করে সমালোচনাও করতে ছাড়েননি।
সেই তালিকায় রয়েছে সাপ্লাই চেইন বা নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ সংক্রান্ত সমস্যা মতো বিষয়ও। তিনি অভিযোগ করেছেন, কার্যকর সরবরাহ ব্যবস্থার অভাবে সামরিক সরঞ্জাম ‘সময় মতো এসে পৌঁছায়নি’ নাহলে, ‘গল্পটা হয়ত একটু অন্যরকম হতো।’
তার এই মন্তব্য ঘিরে নানা আলোচনা তৈরি হয়েছে। চীনের প্রসঙ্গ টেনে কেন্দ্র সরকারকে কটাক্ষ করেছে বিরোধীদল কংগ্রেস।
প্রবীণ কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ অভিযোগ তুলেছেন, পাকিস্তানকে সাহায্যের বিষয়ে চীনের ভূমিকা নিয়ে যা এতদিন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে ‘পাবলিক প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট করে দিয়েছেন ডেপুটি আর্মি চিফ উপ-সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল রাহুল আর সিং।’
পাশাপাশি তিনি উল্লেখ করেছেন, এটা সেই চীন যারা পাঁচ বছর আগে লাদাখে স্থিতাবস্থা পুরোপুরি বদলে দিয়েছিল। কিন্তু ২০২০ সালের ১৯ জুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাদের ক্লিন চিট দেন।
অন্যদিকে, বিশেষজ্ঞদের মতে, লেফটেন্যান্ট জেনারেল রাহুল সিংর ভাষণে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক বিষয় উঠে এসেছে যা ভারতের মাথায় রাখা উচিত। পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞ উপমন্যু ব্যাখ্যা করে বলেছেন, কিছু নির্দিষ্ট লক্ষ্যকে মাথায় রেখেই পাকিস্তানের সঙ্গে চীন তাদের নৈকট্য বাড়িয়েছে এবং সাম্প্রতিক উত্তেজনার সময় সে দেশ যে পাকিস্তানকে সাহায্য করবে, তা অভিপ্রেতই ছিল। এই অঞ্চলে শান্তি ও ভারসাম্য বজায় রাখতে হলে ভারতকে প্রতিবেশী দেশের পাশাপাশি তাদের সহায়তাকারী দেশগুলোর কথাও ভাবতে হবে।
আর সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহের বিষয়ে যে মন্তব্য করেছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল সিং তার দ্রুত সমাধান প্রয়োজন বলেই মনে করছেন সামরিক বিশেষজ্ঞরা। অবসরপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার এবং সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ প্রফুল্ল বক্সী বলেন, ‘সামরিক সরঞ্জামের সাপ্লাই চেইন সম্পর্কে যে তথ্য প্রকাশ পেয়েছে, সেনা কর্মকর্তাদের অনেকেই সে বিষয়ে আগেও বলে এসেছেন। ভবিষ্যতের কথা ভেবে এসব বিষয় গুরুত্ব সহকারে দেখা এবং মোকাবিলা করা দরকার।’
প্রসঙ্গত, গত মাসে বিবিসির সংবাদদাতা ফ্রাঙ্ক গার্ডনার পাকিস্তানের জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ কমিটির জেনারেল সাহির শামশাদ মির্জার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, তারা চীনের কাছ থেকে কতটা সমর্থন পেয়েছে?
জবাবে মির্জা দাবি করেন, ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তান যে পাল্টা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, সেখানে তারা নিজস্ব সম্পদই ব্যবহার হয়েছে।
ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির আয়োজিত অনুষ্ঠানে শুক্রবার ভারতের উপ-সেনাপ্রধান রাহুল আর সিং বলেছেন, অপারেশন সিন্দুর থেকে যা কিছু শেখার থাকতে পারে, সে বিষয়ে বলা দরকার বলে আমি মনে করি। প্রথমত, সীমান্ত একটা, শত্রু দু’জন। আমরা সামনে পাকিস্তানকে দেখেছি, কিন্তু আসলে শত্রু দু’জন। আমি যদি তিনজন বলি তাহলে ভুল হবে না। পাকিস্তান ছিল কেবল সামনে দৃশ্যমান মুখ।
তিনি আরও বলেন, পাকিস্তানকে চীন সম্ভাব্য সব ধরনের সহায়তা দিয়েছে। কারণ গত পাঁচ বছরের তথ্য অনুযায়ী, পাকিস্তান যে সামরিক সরঞ্জাম পেয়েছে, তার ৮১ শতাংশ এসেছে চীন থেকে। আর চীন, একটা পুরোনো প্রবাদ ভালোভাবেই অনুসরণ করেছে, ধার করা ছুরি দিয়ে হত্যা করা… তাই তারা উত্তর সীমান্তে কাদা ছোড়াছুড়ির খেলায় জড়িয়ে পড়ার চেয়ে (অন্যকে) যন্ত্রণা দেওয়ার জন্য প্রতিবেশীকে ব্যবহার করেছে।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক সংঘর্ষে চীনের ভূমিকা সম্পর্কে আগেও অভিযোগ উঠেছিল। পাকিস্তানের প্রতি তুরস্কের সমর্থনও স্পষ্টভাবেই প্রকাশ্যে এসেছে এর আগে।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল রাহুল আর সিংয়ের কথায়, চীন একটা বিষয় বুঝতে পেরেছে যে, এখানে তাদের তৈরি অস্ত্রগুলোকে (ভারতের) বিভিন্ন সিস্টেমের বিরুদ্ধে যাচাই করে দেখতে পারবে। তাই এটা তাদের কাছে এক ধরনের পরীক্ষাগারের মতো ছিল। এর বাইরে, তুরস্কও একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে; যা (পাকিস্তানকে) সাহায্য করেছে। আমরা দেখেছি যে সংঘর্ষের সময় অনেক ধরনের ড্রোন ছিল, সঙ্গে প্রশিক্ষিণপ্রাপ্ত ব্যক্তিও ছিল।
চীন যে স্যাটেলাইট ব্যবহার করে সংশ্লিষ্ট সামরিক তথ্য পাকিস্তানকে নিয়মিতভাবে দিয়েছে, সেই বিষয়েও উল্লেখ করেন তিনি। রাহুল আর সিং বলেন, যখন ডিজিএমও পর্যায়ের আলোচনা চলছিল, তখন পাকিস্তান উল্লেখ করেছিল, আমরা জানি যে আপনার অমুক ভেক্টর রেডি রয়েছে এবং যে কোনও পদক্ষেপ নিতে পারে। আমরা আপনাদের সেটা প্রত্যাহার করার অনুরোধ করব। তার মানে, পাকিস্তান জানতো আমাদের কাছে এমন ভেক্টর প্রস্তুত আছে; যা তাদের ওপর চরমতম আঘাত হানতে পারে।
তার যুক্তি, সেই কারণেই পাকিস্তান যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেয়। সেই প্রসঙ্গ টেনে রাহুল আর সিং বলেছেন, এটা স্পষ্ট যে তারা চীন থেকে লাইভ ইনপুট পাচ্ছিল। তাই ভবিষ্যতে এই বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে এবং দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।
• অপারেশন সিন্দুর থেকে শিক্ষা
অপারেশন সিন্দুর থেকে শিক্ষণীয় বিষয়গুলো ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল সিং। এই প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কোনোরকম রাখঢাক করেননি তিনি।
‘‘অপারেশন সিন্দুরের সময় একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল এয়ার ডিফেন্স (আকাশ প্রতিরক্ষা) এবং সেখানে আমরা কী কী করতে পেরেছি। আমরা ভালো-মন্দ মিশিয়ে (পারফর্ম) করেছি। তবে এক্ষেত্রে অনেক কিছু করা যেতে পারে।’’
তিনি বলেন, কিছু দেশি সিস্টেম ভালো (পারফর্ম) করেছে, কয়েকটা তেমন ভালো করেনি। এবার আমাদের জনবহুল এলাকাগুলো নিশানা ছিল না। কিন্তু পরের বারের জন্য আমাদের তৈরি থাকতে হবে। তার জন্য দরকার আরও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং আরও বেশি পরিমাণে কাউন্টার ড্রোন ও কাউন্টার আর্টিলারি সিস্টেম।
এরপরই তিনি নতুন প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনী শক্তির বিষয়ে উল্লেখ করতে গিয়ে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কথা বলেন। তার কথায়, আমাদের কাছে ইসরায়েলের মতো সুযোগ-সুবিধা নেই। তাদের আয়রন ডোম আছে, একাধিক আকাশ প্রতিরক্ষা সিস্টেম রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশের বিস্তৃতি ব্যাপক এবং এই জাতীয় সরঞ্জাম ব্যবহার করতে অনেক অর্থ ব্যয় হয়। তাই আমাদের উদ্ভাবনী সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।
সামরিক সরঞ্জামের সঙ্গে সম্পর্কিত সরবরাহ শৃঙ্খল বিষয়ে সমালোচনা করতে ছাড়েননি লেফটেন্যান্ট জেনারেল রাহুল আর সিং। তিনি বলেন, আরেকটা বড় শিক্ষা হলো আমাদের শক্তিশালী এবং নিরাপদ সরবরাহ শৃঙ্খলা থাকা দরকার।
সেনাবাহিনীর দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ধরা যাক এই বছরের জানুয়ারি বা গত বছরের অক্টোবর-নভেম্বরের মধ্যে আমাদের যে সরঞ্জামগুলো পাওয়ার কথা ছিল, তা সময়মতো পৌঁছাতে পারেনি।
জেনারেল রাহুল আর সিং বলেন, ২২ এপ্রিলের ঘটনার পর আমি ড্রোন প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম কতজন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সরঞ্জাম সরবরাহ করতে পারবে। সেই সময় অনেকেই হাত তুলেছিলেন। কিন্তু এক সপ্তাহ পর যখন ফোন করি, তখন কিছু (সুরাহা) মেলেনি।
‘‘এর সবচেয়ে বড় কারণ হলো আমাদের সরবরাহ শৃঙ্খলা মূলত অন্যান্য দেশের ওপর নির্ভরশীল। যদি এই সমস্ত সরঞ্জাম সময়মতো আমাদের কাছে পৌঁছাত, তাহলে হয়তো গল্পটা একটু অন্যরকম হতো। সেই কারণেই আমাদের এই বিষয়ে গুরুত্ব সহকারে ভাবতে হবে।’’
ভারতের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা রাহুল আর সিংয়ের মন্তব্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
মানব রচনা ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ অ্যান্ড স্টাডিজের সহকারী অধ্যাপক ও পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞ উপমন্য বসুর গবেষণার অন্যতম বিষয় হলো সাউথ এশিয়ান পলিটিক্স অ্যান্ড কনফ্লিক্ট স্টাডিজ।
তিনি বলেছেন, চীন যে পাকিস্তানকে সাহায্য করবে, সেটি কারও অজানা নয়। ভারতের সঙ্গে চীনের যে টেরিটোরিয়াল কনফ্লিক্ট রয়েছে, সে কথা মাথায় রেখে তারা (ভারতের সঙ্গে) সরাসরি সংঘর্ষে না জড়িয়ে পাকিস্তানকে ব্যবহার করবে এটা স্বাভাবিক।
‘‘কারণ, তারা জানে সীমান্ত অস্থিরতা তৈরি করতে প্রতিবেশী পাকিস্তানকে ব্যবহার করা সহজ। পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের কৌশলগত সম্পর্ক রয়েছে। তবে তারা পাকিস্তানের মিত্র এমনটা ভাবার কিছু নেই। তারা আসলে নিজেদের স্বার্থের জন্য পাকিস্তানকে ব্যবহার করছে।’’
তবে তুরস্কের ক্ষেত্রে সমীকরণ ভিন্ন। বসু বলেন, চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে তিক্ততা থাকলেও, তুরস্কের সঙ্গে সরাসরি কোনও সমস্যা নেই। ইসলামিক দেশ হিসাবে নিজেদের অবস্থানের গুরুত্ব বোঝাতে তারা পাকিস্তানকে সমর্থন করেছে।
পাকিস্তানকে অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম দেওয়ার বিষয়টাকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করেছেন অবসরপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার এবং সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ প্রফুল্ল বক্সী। তার কথায়, চীনের আগ্রহের কারণ, তাদের অস্ত্র ব্যবহার করে পাকিস্তান যদি ভারতের ক্ষতি করতে পারে, তাহলে তাদের বাণিজ্যিক লাভ হবে। সেই ফলাফল দেখিয়ে তারা অন্য দেশের কাছেও সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করতে পারবে।
অন্যদিকে, সাপ্লাই চেইনসহ অন্যান্য যে সমস্ত বিষয়ে রাহুল আর সিং সমালোচনা করেছেন, তার যৌক্তিকতা রয়েছে বলে মনে করে এই সাবেক সেনা কর্মকর্তা। তিনি বলেন, অভ্যন্তরীণ কিছু সমস্যা আছে যা কখনই অস্বীকার করা যায় না। এখানে ব্যুরোক্রেসি রয়েছে। তাছাড়া (প্রশাসনিক স্তরে) যারা ডিসিশন মেকার (সিদ্ধান্ত নেন) তাদের সামরিক বিষয়ে তেমন অভিজ্ঞতা নেই বললেই চলে। সেনা কর্মকর্তারা আবার বেশিরভাগ সময়েই তাদের বিরুদ্ধে গিয়ে কোনও কথা বলতে পারেন না, তাদের সে সুযোগও থাকে না।
‘‘সরবরাহ শৃঙ্খলা মজবুত না হওয়ার কারণে সরঞ্জাম দেরিতে এসে পৌঁছানোর বিষয়টা অনেকদিন ধরেই রয়েছে। এর একমাত্র সমাধান হলো, অন্য দেশের ওপর নির্ভর না করে ভারতেই সেই সমস্ত সরঞ্জাম তৈরি করতে হবে, পরামর্শ দিয়েছেন প্রফুুল্ল বক্সী। বিবিসি বাংলা।