বিশেষ প্রতিবেদন,কলকাতা : পশ্চিমবাংলার রাজনীতিতে শুভেন্দু অধিকারীর নতুন যাত্রা শুরু হয়ে গেল ‘অরাজনৈতিক কর্মসূচির’ মাধ্যমে। আর সেই যাত্রা শুরু হল শহিদ ক্ষুদিরাম বসুর ১৩১তম জন্মবার্ষিকীতে।
বৃহস্পতিবার তমলুকে তাঁর মূর্তিতে মালা দেন। তাম্রলিপ্ত জনকল্যাণ সমিতির উদ্যোগে তমলুক হাসপাতাল মোড় থেকে হ্যামিলটন হাইস্কুল পর্যন্ত পদযাত্রায় অংশ নেন তেরঙা পতাকা হাতে নিয়ে। এই হ্যামিলটন স্কুলেই পড়তেন ক্ষুদিরাম। এদিন পদযাত্রা শেষে এই স্কুলেই সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন শুভেন্দু। কিন্তু কোনও ‘রাজনৈতিক’ মন্তব্য করেননি সেখানে। তবে পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে নন্দীগ্রামের বিধায়ক শুভেন্দু বলেন, ‘আমি বাংলার ছেলে, আমি ভারতের ছেলে। আমি বাংলার মানুষের জন্য লড়ব।’
তমলুকের পর গড়বেতায় ক্ষুদিরামের একটি পূর্ণবয়ব মূর্তির আবরণ উন্মোচন করেন তিনি। এদিন গড়বেতায় শুভেন্দুর অরাজনৈতিক সভাতেও ছিল উপচে পড়া ভিড়। সেখানে স্বতঃস্ফূর্ত শুভেন্দু বলেন, ‘আমার সম্পর্কে আজ একটা খবরের কাগজে অদ্ভুত কিছু কথা লেখা হয়েছে। বলা হচ্ছে, আমি নাকি কমফর্ট জোনে রাজনীতি করি। আমার বক্তব্য, তাঁরা আমার সম্পর্কে সত্যিই কি কিছু জানেন? নাকি সব জেনেও বিশেষ উদ্দেশ্যে এ–সব কথা লিখছেন! কেননা সবাই জানেন, দশকের পর দশক ধরে আমি গড়বেতায় আসছি। ২০১১ সালের আগে আমিই সব থেকে বেশি এই গড়বেতায় এসেছি। এখন অবশ্য ফ্ল্যাটবাড়িতে থাকা কারও কারও এখানে আসতে খুবই অসুবিধে হয়! আমি তা বুঝি। কিন্তু গ্রামের এই ছেলেটা আজ রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে। পান্তাভাত খাওয়া, মুড়ি খাওয়া সেই ছেলেটা, যাকে আপনারা অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি চেনেন। কথা দিচ্ছি, এই ছেলেটাই আপনাদের জন্য লড়বে। কেউ আমাকে আটকাতে পারবে না।’
এদিকে, শুভেন্দুকে হোয়াটসঅ্যাপে তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায় যে জবাব দিয়েছেন, তাতে বাংলার রাজনীতিতে নতুন করে জল্পনা তৈরি হয়েছে। বুধবার হোয়াটসঅ্যাপে শুভেন্দু যে মেসেজ করেছিলেন সৌগত রায়কে, তা নিয়ে দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা হয়েছে সৌগতর। তার পরই তিনি শুভেন্দুকে হোয়াটসঅ্যাপে উত্তর দেন। সূত্রের খবর, তিনি নাকি লিখেছেন, আর যদি একসঙ্গে কাজ করা যদি সম্ভব না হয়, তা হলে মঙ্গলবারের বৈঠকে কেন তিনি আশ্বাস দিয়েছিলেন? যদিও শুভেন্দু অধিকারীর ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রে জানা গিয়েছে, সৌগত রায় কী উত্তর লিখেছেন, তা তিনি জানেন না। কারণ, তিনি সৌগত রায়ের জবাব খুলেও দেখেননি। উল্লেখ্য, শুভেন্দু–সৌগত বৈঠক নিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে কম আলোচনা হয়নি। সংবাদ মাধ্যমে সে সব কথা ফলাও করে ছাপাও হয়েছে। আর সেখানেই শুভেন্দু অধিকারী অনেক ফাঁক দেখেছেন। ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি বলেছেন, বৈঠক নিয়ে তিনি কোনও সাংবাদিকের সঙ্গে কথা না বললেও সৌগতবাবু এক তরফা ভাবে সংবাদ মাধ্যমকে বৈঠকের কথা এবং নিজের ধারণার ভিত্তিতে গড়া নানা ভাষ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। মঙ্গলবারের বৈঠকের পরও সে ভাবেই তিনি সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন।
কিন্তু শুভেন্দু সংবাদ মাধ্যমের কাছে এখনও বিষয়টি নিয়ে মুখ খোলেননি। তাঁর ধারণা, পরিকল্পিত ভাবেই তাঁর সঙ্গে সৌগত রায়কে বৈঠকে বসানো হয়েছে। তার পর তাঁর ওপর চাপ তৈরি করতে এবং মানুষকে বিভ্রান্ত করতে বৈঠক নিয়ে এক তরফা ভাষ্য দেওয়া হয়েছে। সব কিছুর পেছনে তৃণমূলের পরামর্শদাতা প্রশান্ত কিশোরের (পিকে) কৌশল থাকতে পারে বলে শুভেন্দু অধিকারী এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ নেতাদের ধারণা। সেই কারণে সৌগত রায়ের সঙ্গে আর কোনও আলোচনায় যেতে তিনি আগ্রহী নন বলে ঘনিষ্ঠ নেতাদের জানিয়ে দিয়েছেন।
অপরদিকে, বিজেপিতে যোগ দেওয়া কোচবিহার দক্ষিণের বিধায়ক মিহির গোস্বামী ফোন করেন শুভেন্দুকে। প্রায় কুড়ি মিনিট দু’জনের কথা হয়। যদিও এই ফোনালাপকে মিহিরবাবু সৌজন্যমূলক বলে দাবি করেছেন। যদিও রাজনৈতিক সূত্রে জানা গিয়েছে, তিনি বিজেপিতে যোগ দেওয়ার ঘটনা পরম্পরার কথা বিস্তারিত ভাবে শুভেন্দুকে জানান। একই সঙ্গে তাঁকে বিজেপিতে যোগ দেওয়ার আহ্বানও জানান। যদিও এই তথ্য পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন মিহিরবাবু। বলেছেন, ‘শুভেন্দুর বাবা শিশির অধিকারী সম্পর্কে আমার কাকাবাবু হন। তাঁদের পরিবারের সঙ্গে আমার ৩৫ বছরের সম্পর্ক। তাই কথাবার্তা যা হয়েছে, সবই ব্যক্তিগত ও পারিবারিক।’
শুভেন্দু বিতর্ক নিয়ে ফের মুখ খুলেছে বিজেপি। এদিন সকালে নিউ টাউনের ইকো পার্কে প্রাতর্ভ্রমণে গিয়ে দিলীপ ঘোষ সৌগত রায়কে বিদ্রুপ করেন। মর্নিং ওয়াক শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘শুভেন্দুকে নিয়ে কয়েকদিন ধরে মাস্টারমশাই খুব বড় বড় কথা বলছিলেন। তার পর এমন ঝটকা খেয়েছেন যে, চুপ করে গিয়েছেন। এখন আর মুখ দিয়ে তাঁর কথা বের হচ্ছে না। আসলে সাইড লাইনের একজন অতিরিক্ত খেলোয়াড় দুই বুড়ো খোকাকে মাঠে নামিয়েছিল তৃণমূল। তাই মাঠে নেমে সেমসাইড গোল খেয়ে গিয়েছে। কে জানে, এবার হয়তো তাদের শিক্ষা হবে। মনে হয় আর এমন ভুল তারা করবে না।’
অন্যদিকে, শুভেন্দু বিতর্কের পর তৃণমূলের অন্য অনেক নেতা ও নেত্রীর অসন্তোষও প্রকাশ্যে চলে আসছে। যেমন বালির বিধায়ক বৈশালী ডালমিয়ার বিরুদ্ধে ‘বহিরাগত’ অভিযোগ তুলে পোস্টার লাগিয়েছে তৃণমূলেরই একাংশ। সেখানে বিধানসভা নির্বাচনে বালিরই কোনও নেতাকে দলের প্রার্থী করার দাবি করা হয়েছে। এর পরই মুখ খোলেন বৈশালী। তিনি বলেন, ‘এরা তো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকেই বহিরাগত বলেন। তাঁরা জানেনই না প্রধানমন্ত্রী আমাদের পরিবারের প্রধান। বাইরের রাজ্য থেকে কেউ এলে তাঁকেই বহিরাগত বলা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীকেই যখন বহিরাগত বলা হচ্ছে, আমি তো কোন ছাড়!’ প্রধানমন্ত্রী প্রসঙ্গে টেনে আনায় বৈশালীর বক্তব্যে অন্য রকম গন্ধ পাচ্ছে রাজনৈতিক মহল। যদিও নিজের বক্তব্য নিয়ে পরে আর বেশি কোনও ব্যাখ্যায় যাননি তিনি।