বিশেষ প্রতিবেদন,কলকাতা : পশ্চিমবাংলার বিধানসভা নির্বাচনে আসন সংখ্যা দুই অঙ্ক পার করতে বিজেপির নাকি কালঘাম ছুটে যাবে। তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনৈতিক পরামর্শদাতা প্রশান্ত কিশোরের (পিকে) এমনই একটি টুইট শোরগোল ফেলে দিয়েছে রাজ্য তথা জাতীয় রাজনীতিতে। আর যেহেতু তিনি টুইটটি করেছেন বিজেপিকে নিশানা করে, তাই সর্বভারতীয় স্তরেও তার জবাব এসেছে গেরুয়া শিবিরের তরফে।
রবিবার বোলপুরে নিজের র্যালিতে বিপুল জনসমাগম দেখে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। বলেছিলেন, মানুষের এই আগ্রহই প্রমাণ করছে, ক্ষমতা থেকে এবার সরছেই তৃণমূল। আসন সংখ্যার নিরিখে সামনের বিধানসভা ভোটে বিজেপি একাই দুশো পার করবে বলে দাবি করেছিলেন তিনি। আবার শুভেন্দু অধিকারীর বিজেপিতে যোগ দেওয়ার দিন মানুষের উন্মাদনা দেখে বিজেপির সর্বভারতীয় সহ–সভাপতি মুকুল রায় স্পষ্ট বলেছিলেন, একুশে তৃণমূল তিন অঙ্কে পৌঁছনোর আগেই থেমে যাবে। এর অর্থ, ১০০–র কম আসন পাবে তৃণমূল। স্পষ্টই কয়েকদিন ধরে বাংলা তো বটেই, গোটা ভারতেই বিজেপিকে নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে যেমন আলোচনা চলছে, তেমনই মানুষের আলোচনায়ও উঠে আসছে গেরুয়া শিবিরের কথাই। তুলনায় কয়েকদিন ধরে যথেষ্ট নিষ্প্রভ দেখাচ্ছে তৃণমূলকে।
এর নেতিবাচক প্রভাব যে তৃণমূল কর্মী–সমর্থকদের ওপর পড়তে পারে, তা হয়তো অনুমান করতে পারছেন দলের রাজনৈতিক পরামর্শদাতা প্রশান্ত কিশোর। তাই সোমবার তিনি বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল কী হতে পারে, তা নিয়ে একটি অনুমানের কথা টুইট করেন। যদিও তিনি নিজে সেই টুইটকে অনুমান বলেননি। বলেছেন, সেটা তাঁর বিশ্বাস। আর বিধানসভা ভোটের ফল সেটাই হবে। এদিন তিনি টুইটে জানিয়েছেন, মিডিয়াই বিজেপিকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখাচ্ছে। আসলে বিজেপির তেমন শক্তিই নেই বাংলায়। লিখেছেন, ‘বাংলায় বিজেপি দুই অঙ্কের সংখ্যা পার করতে রীতিমতো হিমশিম খাবে।’ তার মানে, অমিত শাহের কথা সত্য হবে না। মুকুল রায়ের বক্তব্যও কথার কথা হয়ে থেকে যাবে। এমনকী, বিজেপির বাংলার ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে।
প্রশান্ত কিশোর নিজের কথার ওপর এতটাই আস্থাশীল যে, সেই টুইটেই লিখে দিয়েছেন, ‘এই টুইটটি রেখে দেবেন। বিজেপি যদি এর থেকে ভালো ফল করে, তা হলে আমি অবশ্যই জায়গা ছেড়ে দেব।’ এর অর্থ, বাংলার বিধানসভা নির্বাচনে যদি বিজেপি ৯৯টির বেশি আসন পায়, তা হলে তিনি রাজনৈতিক পরামর্শদাতা সংস্থার কাজ ছেড়ে দেবেন। কিন্তু প্রশ্ন হল, আচমকা তিনি নিজেই বিজেপির বিরুদ্ধে এমন টুইট করে সরাসরি যুদ্ধে নামছেন কেন? তিনি তো একটি দলের রাজনৈতিক পরামর্শদাতা। তাঁর পরামর্শ শুনে সেই দলটিই তো সম্মুখ সমরে যাবে বিজেপির বিরুদ্ধে। তাঁর তো আড়ালে থাকার কথা। তা হলে প্রকাশ্যে আসছেন কেন?
রাজনৈতিক মহলের মতে, ফুটবলের পিকে ছিলেন প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর ভোকাল টনিকে ইস্টবেঙ্গল বা মোহনবাগানের ফুটবলাররা তেতে উঠতেন, সমর্থকরা স্বপ্ন দেখতেন। আর এই পিকে, মানে প্রশান্ত কিশোর এখন হয়তো মনে করছেন, মানসিক ভাবে তৃণমূলের অনেক নেতা ও কর্মী পিছিয়ে পড়েছেন। তাই তাঁদের মনে সাহস ফিরিয়ে আনতে ফুটবলের পিকের মতোই রাজনীতিতেও ভোকাল টনিক দেওয়ার রীতি নিয়ে আসতে চাইছেন।
প্রশান্ত কিশোরের এই টুইটের পর জবাবও আসতে শুরু করে গেরুয়া শিবির থেকে। মূল জবাবটি আসে বাংলায় বিজেপির সহ–পর্যবেক্ষক অরবিন্দ মেনন পাল্টা টুইট করে বলেছেন, ‘অন্যেরা কী ভবিষ্যদ্বাণী করলেন, তার ওপর নির্ভর করে বিজেপি চলে না। আমরা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিজেরাই তৈরি করি। অমিত শাহ এবং জগৎপ্রকাশ নাড্ডা বলেছেন, দিদি একা হয়ে যাবেন এবং বিজেপি দুশো পেরিয়ে যাবে। আপনাকে আগাম শুভেচ্ছা এবং বিদায় জানিয়ে রাখলাম।’ মুখ খুলেছেন রাজ্যে বিজেপির কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয়ও। তিনি বলেছেন, ‘বাংলায় এখন বিজেপির যে সুনামি বইছে, তাতে এইসব রাজনৈতিক পরামর্শদাতার রাতের ঘুম উড়ে গিয়েছে। তাই তাঁরা ভুলভাল বকছেন। বাংলায় নতুন সরকার গড়ে ওঠার পর দেখা যাবে দেশে সত্যিই একজন রাজনৈতিক পরামর্শদাতা কমে যাবে।’
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় পাল্টা টুইট করে লিখেছেন, ‘আমি খুবই খুশি এই কারণে যে, এণন একজন বিশেষজ্ঞ তৃণমূল এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্বাচনী যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু কোন পৃথিবীতে বাস করেন তিনি? তৃণমূল তাঁকে কী খাবার খাওয়ায় কে জানে! তার বদলে আমরা ২০২১ সালের জন্য অপেক্ষা করি। তখন না থাকবে সাপ (তৃণমূল), না বাজবে বাঁশি (পিকে)।’ প্রশান্ত কিশোরের টুইটের জবাব দিয়েছেন বিজেপির সর্বভারতীয় সহ–সভাপতি মুকুল রায়ও। তিনি বলেছেন, ‘কে এই প্রশান্ত কিশোর? তিনি কি ব্যবসায়ী, নাকি রাজনীতিবিদ, নাকি তৃণমূল কর্মী? তাঁর কি নিজস্ব কোনও রাজনৈতিক দল রয়েছে? আসলে তিনি কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য, তা আমরা জানি না। মনে হয়, কেউই জানে না।’
বিজেপির রাজ্য সহ–সভাপতি জয়প্রকাশ মজুমদার বলেছেন, ‘বিজেপিকে নিশানা করতে তিনি এই টুইট করেননি। আসলে তিনি হয়তো চাকরি হারানোর ভয় পাচ্ছেন। তাই নিয়োগকর্তাকে (পড়ুন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) খুশি করতেই এমন সব অর্থহীন, যুক্তিহীন কথা বলছেন। তিনি বুঝে গিয়েছেন, তাঁর পেশাদারি দক্ষতার ওপর প্রশ্নচিহ্ন তৈরি হয়েছে। তাই তা কাটিয়ে দিতে এইসব কথা বলছেন।’
রাজ্য বিজেপির এক নেতা বলেছেন, প্রশান্ত কিশোর হতাশায় ভুগছেন। তৃণমূল ছেড়ে যে ভাবে ভালো ভালো নেতারা পালিয়ে যাচ্ছেন, তাতে দলের ভবিষ্যৎ আরও অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। তিনি নিজেও শুভেন্দুকে বুঝিয়েছিলেন। কিন্তু লাভ হয়নি। এখন রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়কে বোঝাচ্ছেন। কিন্তু রাজীব কী করবেন, তা তিনি এখনও ঠিক বুঝতে পারছেন না। ফলে ভয়ঙ্কর চিন্তার মধ্যে রয়েছেন। তাই এ–সব আবোল–তাবোল কথা বলে তৃণমূলের ব্যর্থ নেতাদের মনে সাহস জোগাতে চাইছেন।