বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা :
গোলমাল, বোমাবাজি, হিংসার আবহ থেকে মুক্ত হতে পারল না পশ্চিমবাংলা। যদিও সেই আবহের মধ্যেও বিপুল ভোট পড়েছে দ্বিতীয় দফার ৩০টি কেন্দ্রের বিধানসভা নির্বাচনে। নির্বাচন কমিশনও জানিয়েছে, বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা ছাড়া এদিনের ভোট মোটের ওপর নির্বিঘ্নেই হয়েছে। কমিশনের তরফে আগেই পর্যাপ্ত নিরাপত্তার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিল গোটা গোটা নন্দীগ্রামে। তারই মধ্যে কেশপুর এবং নন্দীগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় তৃণমূল এবং বিজেপি কর্মীদের মধ্যে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছে বৃহস্পতিবার।
দ্বিতীয় দফার ভোটে এদিন বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত পাওয়া হিসেবে দেখা যাচ্ছে, মোট ৮০.৪৩ শতাংশ ভোট পড়েছে। এর মধ্যে বাঁকুড়ায় ৮২.৯২ শতাংশ, পূর্ব মেদিনীপুরে ৮১.২৩ শতাংশ, পশ্চিম মেদিনীপুরে ৭৮.০২ শতাংশ এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ভোট পড়েছে ৭৯.৬৫ শতাংশ। এই তথ্য দিয়েছেন রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক (সিইও) আরিজ আফতাব। নন্দীগ্রামে এদিন ১৪৪ ধারা জারি ছিল। আরিজ আফতাব আরও বলেছেন, ‘কয়েকটি বিক্ষিপ্ত ঘটনা ছাড়া নির্বাচন মোটামুটি শান্তিপূর্ণই ছিল।’ পিংলা বিধানসভার জলচকে তৃণমূলের প্রতীক এবং পাইকান বুথে বিজেপির প্রতীকে কালি লাগিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এদিন যে কেন্দ্রগুলিতে ভোট হয়, সেগুলি হল নন্দীগ্রাম, পাঁশকুড়া পূর্ব, পাঁশকুড়া পশ্চিম, ময়না, নন্দকুমার, মহিষাদল, হলদিয়া, কেশপুর, চণ্ডীপুর, খড়গপুর সদর, নারায়ণগড়, সবং, পিংলা, ডেবরা, দাসপুর, ঘাটাল, চন্দ্রকোনা, তমলুক, তালডাংরা, বাঁকুড়া, বড়জোড়া, ওন্দা, বিষ্ণুপুর, কোতলপুর, ইন্দাস, সোনামুখী, গোসাবা, পাথরপ্রতিমা, কাকদ্বীপ এবং সাগর।
নন্দীগ্রাম–সহ দক্ষিণ বাংলার ৩০ বিধানসভায় যখন ভোট হচ্ছে, তখন উলুবেড়িয়ায় বিজেপির নির্বাচনী জনসভায় প্রধান বক্তা ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সেই সভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কটাক্ষ করে প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেন, ‘দিদি, কী সব শুনছি! আপনি নাকি আরও একটি কেন্দ্রে প্রার্থী হচ্ছেন? তাও নাকি শেষ দফায়? সেইজন্য নাকি মনোনয়ন পেশ করার প্রস্তুতিও নিচ্ছেন? বলি, ব্যাপারটা কী? নন্দীগ্রামে কি হারছেন? এ ব্যাপারে কি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছেন?’ প্রধানমন্ত্রী মোদির কটাক্ষের সময়ই নন্দীগ্রামের ভোট প্রক্রিয়া নিয়ে তীব্র বিরক্তি প্রকাশ করেন মমতা। তিনি দাবি করেন, কমিশনের কাছে ৬৩টি অভিযোগ জানিয়েছেন। ফলে মোদির মন্তব্য নিয়ে তখন রীতিমতো চাঞ্চল্য তৈরি হয়ে যায় বাংলার বিভিন্ন মহলে। শেষে তৃণমূলের তরফে প্রতিক্রিয়া দেওয়া হয়। বলা হয়, নন্দীগ্রামে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই জিতবেন। তিনি আরও কোনও কেন্দ্রে প্রার্থী হবেন না।
নন্দীগ্রামের ভোট এবং তার ফলাফল নিয়ে তৃণমূল দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়ার মধ্যেও অদ্ভুত রকমের স্ববিরোধ রয়েছে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। এদিন দুপুর দুটো নাগাদ তিনি এই কেন্দ্রের বয়ালে একটি বুথে গিয়ে জানান, নির্বাচন কমিশনে ৬৫টি অভিযোগ তিনি জানিয়েছেন। রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়ের সঙ্গেও বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন বলে জানান। পরে বুথ থেকে বেরিয়ে তিনি বলেন, ‘কমিশনের চোখে আঙুল দিয়ে আমি দেখিয়ে দিয়েছি, এখান ৮০ শতাংশ ছাপ্পা ভোট হয়েছে। এখানকার লোককে ভোট দিতে দেওয়া হয়নি। আমি আদালতেও যেতে পারি।’ এর পর সন্ধ্যায় তাঁর বক্তব্য বদলে যায়। তিনি বলেন, ‘আমিই জিতব। নন্দীগ্রাম নিয়ে আমি চিন্তিত নই। আমি চিন্তিত দেশের গণতন্ত্র নিয়ে। নন্দীগ্রামে জেতার ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।’ প্রশ্ন হল, বিজেপি যদি ৮০ শতাংশ ভোটই ছাপ্পা হয়, তা হলে তৃণমূল জিতবে কী করে? বলা বাহুল্য, এই প্রশ্নের জবাব মমতা বা তৃণমূল, কারও কাছেই পাওয়া যায়নি। যদিও তৃণমূল নেত্রীর সমস্ত অভিযোগই খারিজ করে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
ভোট নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বিজেপি প্রার্থী শুভেন্দু অধিকারী এদিন দুপুরে বলেন, ‘দুপুর বারোটা পর্যন্ত ৬০ শতাংশ ভোট পড়েছে। এর মানে তো বিপ্লব! আমার আশা, আরও ভোট পড়বে। ভোট পড়ার যে ট্রেন্ড দেখছি, তাতে তো পরিষ্কার, এবার পরিবর্তন হচ্ছেই। লিখে নিন, এবার বেগম হারছেন, বিকাশ জিতছে।’ এদিনই বুথে বুথে ঘুরতে গিয়ে একটি সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় আটকে যান শুভেন্দু। সেখানে কিছু যুবক তাঁকে উদ্দেশ্য করে ‘গো ব্যাক’ স্লোগান দেয়। ঘটনাটি নিয়ে শোরগোল পড়ে যায়। বিষয়টি দেখে সেখানেই সংবাদ মাধ্যমে শুভেন্দু বলেন, ‘রাস্তাঘাট ফাঁকা। অথচ বাইক বাহিনী ঘুরে বেড়াচ্ছে। এরা কারা বুঝতে অসুবিধে হয় না। কিন্তু এ ভাবেও তারা ভোটে জিততে পারবে না। বাইক বাহিনী পাঠিয়ে দিয়েছে আমাকে ভয় দেখাতে।’ অবশ্য তিনি স্বীকার করে নেন, ‘কেন্দ্রীয় বাহিনী এদিন ভালো মুভ করেছে।’
কেশপুরে বিজেপি প্রার্থী প্রীতিশরঞ্জন কুঁয়ার এবং তাঁর নির্বাচনী এজেন্ট তন্ময় ঘোষের গাড়ির ওপর হামলা চালায় একদল দুষ্কৃতী। বিজেপির অভিযোগ, হামলা চালিয়েছে তৃণমূল। বিজেপি প্রার্থীর ভাঙচুর হওয়া গাড়ির অবস্থা দেখে অনেকেই শিউরে উঠেছেন। কেউ কেউ বলছেন, ভাগ্যের জোরে বেঁচে গিয়েছেন বিজেপি প্রার্থী এবং তাঁর গাড়ির চালক। সেই সময় সেই দৃশ্য দেখাতে গিয়ে সেখানে আক্রান্ত হয়েছে সংবাদ মাধ্যমও। অভিযুক্ত সেই তৃণমূলই। যদিও সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছে তৃণমূল। জেলার পুলিশ সুপার দীনেশ কুমার জানিয়েছেন, এই ঘটনায় ১৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
পাশাপাশি ডেবরার প্রার্থী ভারতী ঘোষকে চকমানু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বুথে ঢুকতে বাধা দেন তৃণমূল কর্মীরা। আবার এই কেন্দ্রেই রাধাকান্তপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বুথে ঢুকতে তৃণমূল প্রার্থী হুমায়ুন কবিরকে কেন্দ্রীয় বাহিনী বাধা দেয় বলে প্রার্থীই অভিযোগ করেছেন। পূর্ব মেদিনীপুরের মহম্মদপুরের ১ নম্বর ব্লকের বুথ সংলগ্ন এলাকায় চণ্ডীপুরের তৃণমূল প্রার্থী তথা অভিনেতা সোহম চক্রবর্তীর গাড়ি ঘিরে বিজেপি কর্মীরা ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দেন। সেই সময় তাঁর গাড়ি ভাঙচুর করা হয় বলেও অভিযোগ উঠেছে। গোটা ঘটনার জন্য প্রশাসনের কাছে রিপোর্ট তলব করেছে নির্বাচন কমিশন।
এ ছাড়া ভোটের দিন বিধি ভেঙে ভোটারদের মধ্যে টাকা বিলির অভিযোগ উঠেছে বাঁকুড়ার তৃণমূল প্রার্থী তথা অভিনেত্রী সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে। তিনি স্থানীয় ভৈরব মন্দিরে এদিন পুজো দিয়ে টাকা বিলি করেন বলে বিজেপি ওই অভিযোগ জানিয়েছে নির্বাচন কমিশনে। এর পর একটি বেসরকারি বৈদ্যুতিন সংবাদ মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে সায়ন্তিকা মন্তব্য করেন, ‘মন্দিরের সামনে বসে থাকা গরিব মানুষকে ১০১ টাকা দিয়ে যদি চারটে ভোট পাই, তাতে আমি খুশি।’ বলা বাহুল্য, তাঁর এই মন্তব্য নিয়েও বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
আরও পড়ুন : রক্তগঙ্গায় ধাবিত হচ্ছে মিয়ানমার, সতর্ক করলেন জাতিসংঘ দূত