বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা: বিজেপিকে রুখতে তৃণমূলের সঙ্গে হাত মেলাতে আপত্তি নেই সিপিএমের। চমকে ওঠার মতো কথা হলেও এমন পথেই যেতে চাইছে সিপিএম। অথবা, যাচ্ছেও বলা যেতে পারে। কারণ, বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু স্বয়ং নাম না করে হলেও তৃণমূলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে যে বামেদের আপত্তি নেই, সে কথা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। যদিও রাজনৈতিক মহলের ব্যাখ্যা, নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ফের একটা ভণ্ডামোর আশ্রয় নিচ্ছে বামেরা।
১৯৭৭ সাল থেকে টানা ৩৪ বছর পশ্চিমবাংলার ক্ষমতায় ছিল সিপিএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট। কংগ্রেস বা অন্য কোনও দল প্রবল প্রতাপশালী বামেদের কোনও চ্যালেঞ্জই জানাতে পারেনি। তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৃণমূল কংগ্রেস গঠন করার পর পরিস্থিতি বদলে যায়। মমতার অনমনীয় বাম বিরোধিতার কাছে হার মানতে হয় বামেদের। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, নেতাই, জঙ্গলমহল–সহ গোটা রাজ্যে রক্তক্ষয়ী একটা সময় গড়িয়েছে সিপিএম এবং তৃণমূলের সেই লড়াইয়ে। তখন থেকেই সিপিএমের প্রধান শত্রু হয়ে যায় তৃণমূল। আরও পরিষ্কার করে বললে মমতা। অবশেষে ২০১১ সালে বাংলা থেকে বাম জমানার অবসান ঘটিয়ে দেন মমতা। তবে সিপিএম এবং তৃণমূলের বৈরিতার শেষ হয়নি। হওয়ার কথাও ছিল না। সিপিএম নেতা থেকে সাধারণ কর্মীরা কিছুতেই তৃণমূলের আধিপত্য মেনে নিতে পারছিলেন না। তা ছাড়া ক্ষমতায় আসার পর জেলাস্তরে সিপিএম সমর্থকরা তৃণমূল পন্থীদের অত্যাচারের সম্মুখীন কম হননি! তাই সিপিএম কর্মীরা তৃণমূলকে প্রধান শত্রু বলে বিবেচনা করে এসেছেন এতদিন।
যে কারণে ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে সিপিএমের ওপরই ভরসা করতে পারেননি তাদের অনেক কর্মী–সমর্থক। মনে করা হয়, তৃণমূলকে হারাতে বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলেন তাঁরা। যার সুফল ভোটের ফলাফলে পেয়েছে বিজেপি। তবে এবার বিধানসভা নির্বাচনে সিপিএমের সেই কর্মীরা একই পথ অনুসরণ করেননি। হিসেব বলছে, সিপিএম কর্মীদের ভোট তৃণমূলের দিকেই গিয়েছে। অন্তত বাংলায় সিপিএমের প্রধান কার্যালয় আলিমুদ্দিন স্ট্রিট সে কথাই মনে করে। সিপিএম নেতারাও যে সে কথা বিশ্বাস করেন, সংবাদ মাধ্যমের কাছে বিভিন্ন সময় তাঁরা সে কথাই উল্লেখ করেছেন। যদিও তাতে বিজেপির যতটা ক্ষতি হয়েছে, তার চেয়েও বেশি ক্ষতি হয়েছে সিপিএম তথা বামপন্থী দলগুলিরই। রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনে তাদের আসন সংখ্যা শূন্যতে গিয়ে ঠেকেছে। এমনকী, লোকসভায়ও বাংলা থেকে তাদের কোনও প্রতিনিধি নেই।
রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, যে রাজ্যের মানুষকে স্বভাব–বামপন্থী বলে মনে করা হয়, যে রাজ্য বামেরা টানা ৩৪ বছর শাসন করেছে, সেই রাজ্যে তাদের অস্তিত্বই আজ বিপণ্ণ হয়ে পড়েছে। এই সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজছিল সিপিএম। মানুষের সমর্থন পেতে হলে যে মানুষের কাছে যেতে হয়, আর সেটা যে যথেষ্ট পরিশ্রমের ও কঠিন একটি কাজ, তা বাংলার বাম নেতারা বুঝতে পেরেছেন। তাই সেই পরিশ্রমের কাজ করতে তাঁরা এখন রাজি নন। সেইজন্য সহজ পথটাই তাঁরা এখন ধরতে চাইছেন। অন্তত বিমানবাবুর বক্তব্যে সেই প্রমাণই পাওয়া গেল কলকাতায়। সোমবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন পাঁচদিনের সফরে দিল্লি পৌঁছে যান, তার আগে কলকাতায় বিমানবাবু বলেন, ‘কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা, অন্যদিকে কোহিমা পর্যন্ত সর্বভারতীয় স্তরে বিজেপিকে রুখতে হবে। তাই বিজেপির বিরুদ্ধে আন্দোলনে যে কোনও দলের সঙ্গে যেতে রাজি বামেরা।’
সরাসরি তৃণমূলের নাম না করলেও বিমানবাবু যে রাজ্যে তৃণমূলের সঙ্গে যেতে চাইছেন, তা এদিন স্পষ্ট করে দেন। তবু সাংবাদিকরা সরাসরি তাঁকে তৃণমূল প্রসঙ্গে তাঁদের অবস্থান জানতে চান। তখন বিমানবাবু ফের বলেন, ‘বিজেপি বিরোধী যে কোনও দলের সঙ্গেই কাজ করতে প্রস্তুত বামেরা।’ যদিও রাজনীতি বিশেষজ্ঞদের মতে, বিজেপিকে শিখণ্ডী করে সিপিএম তথা অন্য বাম দলগুলি আসলে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চাইছে। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের কথা মাথায় রেখেই যে বাম চেয়ারম্যান এ কথা বলছেন, তা–ও বুঝতে অসুবিধে হয় না। আসলে আগামী লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের সঙ্গে জোট বেঁধে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চাইছেন বিমানবাবুরা। কিন্তু তৃণমূল তাঁদের কতখানি গুরুত্ব দেবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কেন না, পশ্চিমবাংলায় লোকসভা আসনের সংখ্যা মাত্র ৪২টি। মমতা চান, ৪২–এ ৪২–ই পেতে। তার মানে কোনও আসনই তিনি কোনও দলকে ছাড়বেন না।
তবু প্রশ্ন হল, লোকসভা নির্বাচনে বিজেপিকে হারানোর কথা ভেবে যদি বিরোধী জোটে সবুজ সঙ্কেতও দেন, তা হলেও বিরোধী দলগুলিকে তিনি কতগুলি আসন ছাড়তে পারেন? এদিকে, কংগ্রেসও তৃণমূলের সঙ্গে জোট বাঁধতে আগ্রহী। বহরমপুর–সহ মুর্শিদাবাদে তাদের কিছুটা শক্তি রয়েছে। জোট হলে তিনি কংগ্রেসকে একটি আসন ছাড়তে পারেন। পাহাড়ে তিনটি আসন তিনি সেখানকার দলগুলিকেই ছেড়ে দিয়ে থাকেন। তা হলে বামেদের সঙ্গে জোট হলে তাদের কোনও আসন আদৌ কি তিনি ছাড়বেন? কারণ, সেই অর্থে এখন বাংলায় বামেদের শক্তিঘাঁটি বলে কিছুই নেই। আর, বামেদের জোটে রয়েছে ৭–৮টি দল। সবাইকে মমতা যে একটি করে আসন ছেড়ে দেবেন, তা হতে পারে না। সে ক্ষেত্রে জোট যদিও হয়ও বামেদের সর্ব মোট একটি আসন তিনি ছাড়তে পারেন। আর সেই আসন হবে, তৃণমূলের শক্তি যেখানে একেবারে কম, সেই অঞ্চলে। তাতে বামেদের অস্তিত্ব কতখানি টিকে থাকবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়।