বিশেষ প্রতিবেদন,কলকাতা : শেষ পর্যন্ত বিধায়ক পদে ইস্তফাই দিয়ে দিলেন শুভেন্দু অধিকারী। মন্ত্রিত্ব পদ ছাড়ার ঠিক ১৭ দিনের মাথায় ছেড়ে দিলেন পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিধায়ক পদও। বুধবার বিকেলে তিনি কলকাতায় বিধানসভা ভবনে অধ্যক্ষ বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘরে যান। কিন্তু তখন বিমানবাবু বিধানসভায় ছিলেন না। তাই তাঁর সচিবের কাছে পদত্যাগ পত্র দিয়ে আসেন। যদিও ফেরার সময় বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিকদের কাছে কোনও মন্তব্য করেননি।
বিমানবাবু অধ্যক্ষ। তাই তিনি নিরপেক্ষ থাকবেন, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তিনি ইস্তফা দেওয়ার পরই রাজনৈতিক মহলের একাংশের মধ্যে রটে যায়, শাসক দলের বিধায়ক বলে অধ্যক্ষের ওপর তৃণমূলের চাপ থাকবে। এই ইস্তফাপত্র গ্রহণ না করার জন্য তৃণমূল প্রভাব খাটাতে পারে। তার পরই শোনা যায়, শুভেন্দুর ইস্তফা গ্রাহ্য নাও করতে পারেন অধ্যক্ষ। সমস্ত জল্পনা সত্যি প্রমাণ করে বিমানবাবু পরে বলেন, ‘শুভেন্দু আমার কাছে ইস্তফাপত্র দেননি। আমি বিধানসভায় গিয়ে সেই চিঠি দেখব। তবে এটা রীতি নয়।’ আসলে নিয়ম অনুযায়ী, অধ্যক্ষের কাছেই ইস্তফাপত্র দিতে হয় বিধায়ককে। সুতরাং এই ইস্তফা নিয়ে যে আরও এক প্রস্ত নাটক হতে চলেছে, তা বুঝে যায় রাজনৈতিক মহল। কিন্তু সমস্ত জল্পনায় জল ঢেলে দেন স্বয়ং শুভেন্দু অধিকারী। সন্ধ্যায় তিনি তাঁর ঘনিষ্ঠদের বলেছেন, ‘অধ্যক্ষ ডাকলে আমি না হয় ফের গিয়ে ইস্তফাপত্র তাঁর হাতেই দিয়ে আসব।’
ইস্তফা দেওয়ার পরই নীরবে বোমা ফাটিয়ে দিলেন শুভেন্দু অধিকারী। না, তৃণমূল দল বা মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কোনও কথা বলেননি তিনি। তবে যে কাজটি করেছেন, তা দলের অস্বস্তি বাড়িয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। তিনি রাজ্যের পুলিশ ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর অভিযোগ জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন স্বয়ং রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়কে। চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ‘আমার অবস্থান স্পষ্ট হয়ে যেতেই পুলিশ ও প্রশাসন আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। আমার ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করার হুমকি দিচ্ছে। রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান হিসেবে আপনার হস্তক্ষেপ চাইছি।’ চিঠি পেয়েই নড়েচড়ে বসেন রাজ্যপাল। তিনি শুভেন্দুর চিঠির ছবি অ্যাটাচ করে একটু টুইট করেন, আর তা ট্যাগ করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। টুইটে তিনি লিখেছেন, ‘প্রাক্তন মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী আমার কাছে পুলিশি হয়রানি থেকে রক্ষা পেতে হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করেছেন।’ বিষয়টি নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মহলেও। উল্লেখ্য, মন্ত্রিত্ব ত্যাগের আগেই রাজ্যের দেওয়া জেড ক্যাটাগরির নিরাপত্তাও ছেড়ে দেন শুভেন্দু। তার পরই তাঁর জীবন সংশয়ের কথা শোনা যেতে থাকে। শেষে কেন্দ্রীয় সরকার তাঁকে জেড ক্যাটাগরির নিরাপত্তা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে।
এদিকে, আসানসোলের পুরপ্রশাসক তথা পাণ্ডবেশ্বরের বিধায়ক জিতেন্দ্র তিওয়ারিকে ফোন করেছিলেন স্বয়ং তৃণমূল দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এর আগে ফিরহাদ হাকিমের সঙ্গে বৈঠকে বসার কথা ছিল তাঁর। কিন্তু তিনি সেই বৈঠক বাতিল করে দেন। বলে দেন, একমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেই তিনি কথা বলতে পারেন। সকলকে চমকে দিয়ে বুধবার দুপুরে সেই মমতাই ফোন করেন। জিতেন্দ্রকে মাথা ঠান্ডা রাখার পরামর্শ দিয়ে মমতা জানান, তাঁর সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করবেন। মমতার সঙ্গে ফোনে কথা বললেও বিকেলের পর জিতেন্দ্র কিন্তু চলে যান তৃণমূল সাংসদ সুনীল মণ্ডলের বাড়ি। সেখানে ছিলেন স্বয়ং শুভেন্দু অধিকারী। ছিলেন কালনার বিধায়ক বিশ্বজিৎ কুণ্ডু এবং দক্ষিণবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ নিগমের চেয়ারম্যান দীপ্তাংশু চৌধুরি। এই বৈঠক ঘিরে রাজনৈতিক মহলে কম চর্চা হচ্ছে না। তবে শুভেন্দু অনুগামীদের বক্তব্য, সম্প্রতি সুনীল মণ্ডলের মাতৃবিয়োগ ঘটেছে। তাই সমবেদনা জানাতে তাঁরা সুনীলবাবুর বাড়ি গিয়েছিলেন।
শুধু তাঁরাই নন, এবার তৃণমূলের রাজনৈতিক পরামর্শদাতা প্রশান্ত কিশোরকে (পিকে) নিশানা করে তোপ দাগলেন দুর্গাপুরের বিধায়ক বিশ্বনাথ পরিয়াল, ডানকুনির প্রাক্তন ভাইস চেয়ারম্যান দেবাশিস মুখোপাধ্যায়। বিশ্বনাথ বলে দিয়েছেন, মমতা যদি চান তিনি ইস্তফা দিতে তৈরি। এ ছাড়া দলের কাজকর্মে বিতশ্রদ্ধ হয়ে দলই ছেড়ে দিলেন বোলপুরের কাউন্সিলর শেলি রায়, প্রাক্তন কাউন্সিলর তমোজিত রায়। এ–সবের পাশাপাশি, শুভেন্দু দলের বিধায়ক পদে ইস্তফা দিতেই তাঁকে বিশ্বাসঘাতক বলে অভিযুক্ত করলেন তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়। তিনি বলেছেন, ‘বিজেপির সঙ্গে শুভেন্দুর বোঝাপড়া হয়েছে। আদর্শ নয়, এ–সব আসলে পদের জন্য দর কষাকষি। বিজেপির কাছে পদ পাওয়ার আশ্বাস পেয়েই শুভেন্দু গেছে। দেখুক, বিজেপি তাকে কী দিতে পারে!’
অন্যদিকে, শুভেন্দু ইস্যুতে মুখ খুললেন বিজেপির সর্বভারতীয় সহসভাপতি মুকুল রায়। তিনি বলেছেন, ‘তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ছে তৃণমূল। দেখতে থাকুন কী হয় শেষ পর্যন্ত!’ মমতার নাম না করে বলেন, ‘দলের প্রতিষ্ঠার সময় যিনি ছিলেন না, তিনি কী করে বুঝবেন কী হতে যাচ্ছে!’ তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, তৃণমূলের অন্তত ১০০ জন বিধায়ক এবং ১০ জন সাংসদ বিজেপিতে যোগ দিতে চলেছেন। যদিও মুকুল রায়ের কথা ঠিক হয়, তা হলে তৃণমূলের ভবিষ্যৎ সত্যিই কঠিন হতে চলেছে বলে ধারণা তথ্যাভিজ্ঞ মহলের। আবার, শুভেন্দু যে বিজেপিতেই যাচ্ছেন, সে বিষয়ে মোটামুটি নিশ্চিত রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা। তবু শুভেন্দু অধিকারীকে শুভেচ্ছা জানালেন কংগ্রেস বিধায়ক আবদুল মান্নান। বলেন, ‘‘যে দলটা বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে কংগ্রেসের ভূত দেখিয়েছিল সবাইকে, আমি বিশ্বাস করি, সেই দলের স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটাবে এই শুভেন্দু অধিকারীই। শুভেন্দুর যাত্রাপথ শুভ হোক। আমার ধারণা, সফল নেতৃত্ব দিয়ে আগামিদিনে সে এই বাংলাকে স্বৈরাচারমুক্ত করবে।’