বিবেকবোধ
হাতে গুনে দেখলাম আর মাত্র দুই দিন বাকি ঈদ আসতে।
ঈদের আগে আজই শেষ আর পড়াতে যাবো না মিতু কে।
এই মাসেই ওকে প্রথম পড়াতে শুরু করেছিলাম,এক খুব কাছের বড় ভাই-ই ঠিক করে দিয়েছিল টিউশনটা।
আজ আন্টি এই মাসের টিউশানি ফি টা দেয়ার কথা আছে।রুম থেকে বের হওয়ার আগে হাতে ঘড়ি পরতে পরে মনে মনে হিসেব করে নিচ্ছিলাম….
দু মাসের মেস ভাড়া ২৬০০,দু মাসের বিদ্যুৎ বিল ২৩৭ টাকা,চটিটা এই কদিন তিন বার ছিড়েছে একটা চটি স্যান্ডেল কিনা খুব দরকার ওর দাম ১৫০ টাকা। ছোট ভাই খুব জেদ ধরেছে ওর জন্যে একটা ব্যাট কিনতে হবে ওটার দাম যে কত আল্লাহ মালুম। আরও কি কি যেন ছিল এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না কিছুতেই।আচ্ছা থাক,পরে এসে হিসেব করবো বলেই রুম থেকে বের হয়ে ব্যাস্ত রাস্তায় আসলাম।
আজ কেন জানি এতো হাটছি তবু পথ শেষ হচ্ছে না,মনের মধ্যে শুধু ঘুরপাক খাচ্ছে না জানি আন্টি কত টাকা দিবে।
আমি যে দিন প্রথম দিন পড়াতে যাই, আন্টি খুব সুন্দর করে বলেছিল কত দিতে হবে তোমায়?।হঠাৎ করে এমন প্রশ্নে থতমত খেয়েছিলাম খুব।
-ইয়ে মানে আন্টি,ওসব কথা থাক। ভাইয়ার সাথে এ বিষয়ে কথা বলে নিয়েন।
-না বাবা আমি সোজা খাই,সোজা বুঝি।আগে থেকেই বলে নেয়া ভালো।আচ্ছা তুমি যখন বলছো আমি তোমার ভাইয়ার সাথেই কথা বলে নিবো।
-জি আন্টি,ঠিক আছে।
-আর শোন আমার মেয়ে ক্লাস নাইনে পড়ে,ওকে তোমার physics,chemistry,biology আর higher math এই কয়টা বিষয় পড়াতে হবে।
আমি পাশেই বসে থাকবো সবসময় দেখবো তুমি কেমন পড়াও। আর হ্যাঁ ওকে তুমি কতক্ষন পড়াবে?
-আমি এমন এমন কথাবার্তা শুনে যে আকাশ থেকে পড়লাম।কিছুই বের হচ্ছিলো না মুখ দিয়ে।থ মেরে বসে ছিলাম.
-কি হলো??
-ইয়ে মানে আমি তো ১ ঘন্টা করে পড়াই।
-না না,১ ঘন্টায় হবে না।ওকে তোমার ১:৩০ মিনিট পড়াতে হবে।এক দিনে দুইটা সাবজেক্ট।বুঝেছো?.
একটা মানুষ এভাবেও কথা বলতে পারে!! আমি বুঝছিলাম না কি বলবো। আগের মাসে কোন টিউশানি ছিল না বলে দু মাসের রুম ভাড়া,বিদ্যুৎ বিল বাকি পড়েছে।যত কষ্টই হোক পড়াতে আমাকে হবেই।
আমি খুব ধিরে বললাম..
-আচ্ছা ঠিক আছে আন্টি।
সেই দিন লজ্জায় টাকার কথাটা বলতে পারি নি।কিভাবে ওত বড় একটা মানুষের সাথে টাকা নিয়ে কথা বলবো,( না না আন্টি আমার এতো লাগবেই,ধুর আমি এতো কমে পড়াই না।না না হবে না)
আমি আর ভাবতে পারছিলাম না,ওসব ভাই আমার দ্বারা সম্ভব না।
তাছাড়া তো ভাইয়া বলেছেই যে ৪০০০ এর নিচে দিবে না।অনেক ভালো ফ্যামেলি। বাবা,পুলিশের এস.আই। আন্টিও নাকি কথায় একটা যব করে,ভাইয়া ঠিক করে বলতে পারছিল না।
আমি হাটতে হাটতে চলে এলাম বাসার সামনে।কলিং বেল চাপতেই দেখলাম মিতুর ছোট ভাই দরজা খুলে দিল,ও পড়ে ক্লাস ফোর এ।
আমাকে দেখেই বলে উঠলো স্যার জানেন আমরা না আজ ঈদের মার্কেট করতে যাব।একবার গেছিলাম আবার আজ যাব।
আমি হাসি মুখে বললাম…. ও আচ্ছা,বাহ ভালো তো 🙂
ওর সাথে কথা বলতে বলতেই আন্টি বের হয়ে এলো রুম থেকে।
-দাড়িয়ে কেন?সোফায় বসে ওর সাথে কথা বলো আমি আসছি।
আন্টি ১ মিনিট পরে এসেই বললো।আজ মিতু তো পড়বে না।আমরা একটু শপিং এ যাচ্ছি।দেখ তো মিতুর বাবা ওকে একটা ড্রেস কিনে দিয়েছেই ৩০০০ টাকা দিয়ে,পাশের ফ্ল্যাটের নিশাত কি যেন আরেকটা ড্রেস কিনেছে।ওর মত ড্রেস নিবে জেদ ধরেছে।কি আর করি বলো,একটাই মেয়ে আমার.
ওও হ্যা,এ মাস তো শেষ হয়েই গেল।এই যে টাকাটা রাখো ১৫০০ আছে।
আমি নির্বাক হয়ে মাথা নিচু করে বসে রইলাম সোফায়।
-কি হলো, অমন চুপ হয়ে গেলে কেন?
আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না কি বলবো।মনে হচ্ছিলো,এই দুনিয়ার এমন কোন ভাষা নেই যা দিয়ে আমি উনাকে আমার সেই মুহূর্তের অনুভূতি টুকু বুঝাতে পারবো।
আচ্ছা শোন,এই নাও আর ২০০ টাকা।তুমি আসলেই অনেক কষ্ট করেছো এই মাস।আমার মেয়ের আর বাইরে গিয়ে ৪ টা প্রাইভেট পড়ে আসতে হয় না।
এই টাকাটা আপাতত রাখো, সামনে মাস থেকে বাড়িয়ে দেব।বুঝোই তো ঈদের সময় কত কেনাকাটা….. সব টাকা অসব করতেই প্রায় শেষ।
-জি আন্টি!!!
আমি গেট পার হয়ে রাস্তায় আসলাম।মনে হচ্ছিলো পৃথিবীটা যে থমকে গেছে….থেমে গেছে ঘড়ির কাটা…নিস্তব্ধতা ঘিরেছে আমায়।
ধবধবে সাদা চাঁদের আলোয় আলোকিত চারিপাশ,কোথাও কি কোন যায়গা নেই আমি লুকিয়ে থাকতে চাই কোন অন্ধকারে।
লেখক : শিক্ষার্থী
শাহমখদুম মেডিকেল কলেজ, রাজশাহী