সার্ভে সনদ অনুযায়ী যাদের ময়ূর-২ লঞ্চটি পরিচালনা করার কথা ছিল তারা লঞ্চে ছিলেন না। যেখানে গতি ধীর হওয়ার কথা ছিল সেখানে বেপরোয়াভাবে লঞ্চের গতি আরো বাড়িয়ে দেওয়া হয়। ময়ূর-২ লঞ্চের মালিক মোসাদ্দেক হানিফ সোহয়াদ, ম্যানেজার দেলোয়ার হোসেন, সুপারভাইজার আবু সাঈদ, সেলিম হোসেন ও সালাম ছিলেন ময়ূর কোম্পানীর সার্বিক পরিচালনাকারী। তাদের ভুল দিক নির্দেশনা এবং পরিচালনাকারীর ভুলের জন্যই বুড়িগঙ্গায় লঞ্চডুবির ঘটনা ঘটে। এতে ৩৪ জন নিরীহ মানুষের জীবন চলে যায়।
বুড়িগঙ্গায় ময়ূর-২ লঞ্চের ধাক্কায় অন্য একটি লঞ্চডুবির ঘটনায় করা মামলায় লঞ্চের মালিক মোসাদ্দেক হানিফ সোহয়াদসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছে পুলিশ। চার্জশিটে এসব কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
মঙ্গলবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) ঢাকার জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এ চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সদরঘাট নৌ-থানার এসআই শাহিদুল আলম।
মালিক ছাড়া চার্জশিটভুক্ত অন্য আসামিরা হলেন- লঞ্চের মাস্টার আবুল বাশার মোল্লা, সহকারী মাস্টার জাকির হোসেন, চালক শিপন হাওলাদার, সিপাই শাকিল হোসেন, সুকানি নাসির মৃধা, গ্রিজার হৃদয় হাওলাদার, সুপারভাইজার আব্দুস সালাম, সেলিম হোসেন হিরা, আবু সাঈদ ও দেলোয়ার হোসেন সরকার।
চার্জশিটে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেছেন, ‘লঞ্চটি নির্ধারিত সময়ের প্রায় ২ ঘণ্টা আগে সকাল ৯টায় বোগদাদিয়া ডকইয়ার্ড থেকে ছেড়ে আসে। এ বিষয়ে তদন্ত করে জানা যায়, কিছু মালামাল নামানোর জন্য ময়ূর কোম্পানির মালিক, ম্যানেজার, সুপারভাইজার, এবং অন্যান্য কর্মকর্তারা মাস্টার, সুকানি, চালক ও গ্রিজারকে নির্দেশ দেয়। এ কারণে পরিচালনাকারীরা দ্রুত মালামাল সরবরাহের জন্য বোগদাদিয়া ডকইয়ার্ড থেকে আগেই রওনা হয়। তাছাড়া সরকারি নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও মালিক বা অন্যান্য কর্মকতারা যথেষ্ট পরিমাণ লোকজন নিয়েছেন। মাস্টার বা সুকানি হেলপার দিয়ে তাদের লঞ্চ চালানো, দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।’
চার্জশিটে আরও বলা হয়েছে, ভিকটিম লঞ্চের মাস্টার-সুকানিরা বারবার সংকেত দেওয়ার পরও ময়ূর-২ লঞ্চ চালনাকারী এজাহারনামীয় আসামিরা দ্রুত ঘাটে যাওয়ার আশায় ওভারটেক করার চেষ্টা করে। এ কারণে মর্নিং বার্ড লঞ্চের সঙ্গে ধাক্কা লাগে এবং চোখের পলকেই লঞ্চটি পানিতে তলিয়ে যায়। মামলার তদন্তে আসামিদের বিরুদ্ধে মামলায় দণ্ডবিধি ২৮০, ৩০৪ (ক) ও ৪৩৭ ধারায় চার্জশিট দাখিল করা হলো।
২০২০ সালের ২৯ জুন সকাল ৯টার দিকে মুন্সিগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা ‘মর্নিং বার্ড’ লঞ্চটি ঢাকার সদরঘাট কাঠপট্টি ঘাটে ভেড়ানোর আগমুহূর্তে সেটিকে ধাক্কা দেয় চাঁদপুরগামী লঞ্চ ময়ূর-২। সঙ্গে সঙ্গে ‘মর্নিং বার্ড’ ডুবে যায়। লঞ্চডুবির ওই ঘটনায় শেষ পর্যন্ত ৩৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
মর্নিং বার্ডকে ধাক্কা দিয়ে ডুবিয়ে দেওয়ার সময় ময়ূর-২ -এর মূল মাস্টার নয়, একজন শিক্ষানবিশ চালাচ্ছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে। লঞ্চের কোনো ত্রুটি নয়, মাস্টারের ভুলে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিক তদন্তে উঠে আসে।
দুর্ঘটনার পর অবহেলাজনিত মৃত্যু এবং বেপরোয়াভাবে জাহাজ চালানোর অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করেন নৌ-পুলিশ সদরঘাট থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মোহাম্মদ শামসুল। মামলায় দণ্ডবিধি ২৮০, ৩০৪ (ক) ও ৪৩৭ ধারায় অভিযোগ আনা হয়।
মামলার এজাহারভুক্ত আসামিরা হলেন- লঞ্চের মালিক মোসাদ্দেক হানিফ সোহয়াদ, লঞ্চের মাস্টার আবুল বাশার মোল্লা ও জাকির হোসেন, চালক শিপন হাওলাদার ও শাকিল হোসেন এবং সুকানি নাসির মৃধা ও মো. হৃদয়।
অভিযোগ প্রমাণ হলে দশ বছরের কারাদণ্ড
লঞ্চডুবির ওই ঘটনায় করা মামলায় বেপরোয়াভাবে লঞ্চ চালিয়ে মানুষ হত্যা ও ধাক্কা দিয়ে লঞ্চ দুর্ঘটনার জন্য দণ্ডবিধি ২৮০, ৩০৪ (ক), ৪৩৭ ও ৩৪ ধারায় চার্জশিট দিয়েছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। ধারাগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে ৪৩৭ ধারায়।
ধারা অনুযায়ী শাস্তি
ধারা ৩০৪ (ক) : অবহেলার ফলে মৃত্যু
কোনো ব্যক্তি যদি বেপরোয়াভাবে বা অবহেলাজনিতভাবে কার্য করে কারও মৃত্যু ঘটায় এবং তা শাস্তিযোগ্য নরহত্যা না হয়, তবে সে ব্যক্তি পাঁচ বৎসর পর্যন্ত কারাদণ্ডে অথবা অর্থদণ্ডে অথবা উভয় দণ্ডেই দণ্ডিত হবে।
ধারা ২৮০ : বেপরোয়া জাহাজ চালানো
কোনো ব্যক্তি যদি এমন বেপরোয়াভাবে বা অবহেলার সাথে কোনো নৌযান চালনা করে, যার কারণে কোনো মানুষের জীবন বিপদাপন্ন হয় অথবা অপর কোনো ব্যক্তির আঘাত লাগার বা জখম হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়, তবে সে ব্যক্তি ছয় মাস পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের কারাদণ্ডে অথবা এক হাজার টাকা পর্যন্ত যে কোনো পরিমাণের অর্থদণ্ডে, অথবা উভয় দণ্ডেই দণ্ডিত হবেন।
ধারা ৪৩৭ : পাটাতন বিশিষ্ট জাহাজ বা বিশ টন পরিমাণ ভারবাহী জাহাজে আঘাত
কোনো ব্যক্তি যদি পাটাতনবিশিষ্ট জলযান অথবা বিশ টন বা তার বেশি ওজনের বোঝাবিশিষ্ট কোনো জলযান ধ্বংস করার বা উহাকে বিপজ্জনক করে দেয়ার অভিপ্রায়ে বা তা দ্বারা উহাকে ধ্বংস করতে বা বিপজ্জনক করে দিতে পারে বলে জানা সত্ত্বেও অনুরূপ পাটাতনবিশিষ্ট জলযানের অথবা কুড়ি টন বা তদূর্ধ্ব ওজনের কোনো জলযানের অনিষ্টসাধন করে, তবে উক্ত ব্যক্তি ১০ বৎসর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং তদুপরি অর্থ দণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।