বিশেষ সংবাদদাতা,কলকাতা:
পশ্চিমবাংলার বিধানসভা নির্বাচনের চতুর্থ দফা রক্তাক্ত হয়ে উঠল। কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে ৪ জনের মৃত্যু হয় এদিন। ঘটনার জন্য বিরোধীদের তরফে তৃণমূল দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকে উসকানি দেওয়ার অভিযোগ তোলা হয়েছে। যদিও মমতা পাল্টা অভিযোগ তুলেছেন বিজেপি এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিরুদ্ধে। তিনি এদিনই শিলিগুড়ি চলে যান। রবিবার তিনি শীতলকুচি যাবেন বলে ঘোষণা করেন। যদিও নির্বাচন কমিশন সেখানে রাজনৈতিক নেতাদের যাওয়ার ব্যাপারে ৭২ ঘণ্টার জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
প্রথম ঘটনাটি ঘটে সকালে ভোট গ্রহণ শুরু হতেই। শীতলকুচির পাগলাপির এলাকায় ভোট দিতে গেলে আনন্দ বর্মন নামে এক বিজেপি কর্মীকে গুলি করে খুন করা হয়। অভিযোগের আঙুল ওঠে তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে। অভিযোগ অস্বীকার করেছে তৃণমূল। এর পরের ঘটনা সেই শীতলকুচির জোড়পাটকির ১২৬ নম্বর বুথের বাইরে। অভিযোগ, তিনশো থেকে চারশো মহিলা–পুরুষ কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ঘিরে ধরে বিক্ষোভ দেখাতে থাকে। তাদের হাতে ছিল হাতা, খুন্তি, দা প্রভৃতি। সেই সময় উত্তেজিত জনতা বাহিনীকে আক্রমণ করে বলে অভিযোগ। উল্লেখ্য, কয়েকদিন আগেই কোচবিহারে ভোট প্রচারে গিয়ে মহিলাদের এক জোট হয়ে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ঘেরাও করার পরামর্শ দিয়েছিলেন স্বয়ং তৃণমূল দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অনেকেই মনে করছেন, ঘটনার মধ্যে মমতার সেই পরামর্শের ছায়া দেখা গিয়েছে। ওই ঘটনায় তপ্ত হয়ে ওঠে এলাকা। সেই সময় কেন্দ্রীয় বাহিনী গুলি চালালে ৪ জন নিহত হন। এ ছাড়া ওই গুলিতে আরও ৪ জন জখম হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গিয়েছে।
ঘটনার পর কোচবিহার জেলা পুলিশ সুপার দেবাশিস ধর বলেন, ‘ওই বুথে সাড়ে ৯টা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ স্বাভাবিকই ছিল। আচমকা ৯টা ৪৫ নাগাদ বুথ চত্বরে একটি ছেলে অসুস্থ হয়ে পড়ে। এ নিয়ে বাহিনীর দু’জন জওয়ান বিষয়টি জানতে চান। তখনই গুজব ছড়ায় যে, হয়তো তাকে সিআইএসএফের জওয়ানরা মারধর করেছে। তাতেই প্রায় ৩০০–৩৫০ গ্রামবাসী জড়ো হয়ে যান, যাদের মধ্যে বেশির ভাগ মহিলা। তাদের হাতে ‘লোকাল মেড অস্ত্র’ ছিল। দা জাতীয় নিয়ে অস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করার চেষ্টা করে। হোমগার্ডের আঘাতও লাগে। অস্ত্রশস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়ার আশঙ্কা ছিল। কুইক রেসপন্স টিমকে ডাকা হয়। সেই সময় গোলমাল শুরু হয়। ব্যালট ইউনিটও ছিনতাইয়ের পরিস্থিতি তৈরি হয়। এরপরই বাহিনী ফায়ার ওপেন করে। ১৫ রাউন্ড গুলি চলে। চারজন মারা গিয়েছে।’ ঘটনার পরই কেন্দ্রীয় বাহিনীর কাছে রিপোর্ট চেয়ে পাঠায় নির্বাচন কমিশন। এর পরই ঘটনার কথা বিস্তারিত ভাবে নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছেন পুলিশ পর্যবেক্ষক বিবেক দুবে।
রিপোর্টে বিবেক দুবে জানিয়েছেন, শীতলকুচির ওই বুথ ঘিরে ফেলে কেন্দ্রীয় বাহিনীর আগ্নেয়াস্ত্র ছিনতাই করার চেষ্টা করা হয়। ফলে বাধ্য হয়েই কেন্দ্রীয় বাহিনী গুলি চালায়। রিপোর্ট খতিয়ে দেখার পর নির্বাচন কমিশনের তরফে জানানো হয়, আত্মরক্ষার্থেই গুলি চালিয়েছে কেন্দ্রীয় বাহিনী। একই সঙ্গে ঘটনার জেরে এখানকার ১২৬ নম্বর বুথে ভোট বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে কমিশন। তবে কমিশনের বক্তব্য মানতে রাজি হননি তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শনিবার বনগাঁ দক্ষিণের নির্বাচনী সভা থেকে তিনি বলেন, ‘কোচবিহারে আমাদের ৪ ভাইকে গুলি করে মেরেছে দিল্লির পুলিশ। সকালেও এক জনের মৃত্যু হয়েছে। এর পিছনে ষড়যন্ত্রকারী কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। বিজেপির লজ্জা হওয়া উচিত, গলায় দড়ি দেওয়া উচিত। আমি বলছি, অমিত শাহ, আপনি পদত্যাগ করুন।’
ঘটনার জন্য মমতাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি বলেন, ‘কোচবিহারে যা হয়েছে তা সত্যিই দুঃখের। তাদের পরিবারের প্রতি আমার সমবেদনা রয়েছে। নির্বাচন কমিশনকে তদন্তের আবেদন জানাব। আসলে বিজেপির পক্ষে মানুষের সমর্থন দেখে দিদি আর তার গুন্ডারা পাগল হয়ে উঠেছে। মসনদ হাতছাড়া হচ্ছে দেখে দিদি এই স্তরে নেমে গিয়েছেন। আমি দিদিকে, তাঁর গুন্ডাদের ও তৃণমূলকে পরিষ্কার বলছি, আপনাদের স্বেচ্ছাচারিতা আর চলবে না। যারা জঙ্গিদের মোকাবিলা করতে ভয় পায় না, তারা আপনার হুমকিতে ভয় পাবে কেন? এভাবে প্ররোচনা দিয়ে হিংসা ছড়িয়ে এবার আর ভোট বৈতরণী পার করতে পারবেন না আপনি।’ ঘটনায় মুখ খুলেছে অন্য বিরোধী দলগুলিও। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীররঞ্জন চৌধুরি বলেন, ‘নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলায় যে ভাবে খুনোখুনি, রক্তারক্তি হচ্ছে , তা চিন্তার বিষয়। আমরা নিশ্চয়ই বিষয়টি দেখব।’ শীতলকুচির ঘটনার দায় বিজেপি এবং তৃণমূল, এই দুই দলেরই বলে দাবি করেন তিনি।
তবে ঘটনার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই সরাসরি দায়ী করেছেন অপর কংগ্রেস নেতা আবদুল মান্নান। তিনি বলেছেন, ‘মমতার প্ররোচনাতেই শীতলকুচির ঘটনা ঘটেছে। এবার তিনি করবেন মৃতদেহ নিয়ে রাজনীতি। মৃতদেহ নিয়ে এই ধরনের রাজনীতি এবার বন্ধ হোক।’ সিপিএম নেতা মহম্মদ সেলিমও ঘটনার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্ররোচনাকেই নিশানা করেছেন। বলেছেন, ‘কয়েকদিন আগে কোচবিহারে গিয়ে উসকানি দিয়ে এসেছেন। সেই ঘটনারই পরিণতি এদিন দেখা গেল চারজনের প্রাণহানিতে।’ যদিও তৃণমূলের দাবি, নিরীহ মানুষকে গুলি করে মেরেছে কেন্দ্রীয় বাহিনী। তৃণমূল সাংসদ দোলা সেন অভিযোগ করেছেন, ‘শান্তিপূর্ণ নির্বাচন কেন রক্তাক্ত হল, তা কমিশনের কাছে জানতে চায় বাংলার মানুষ।’ জেলা তৃণমূল সভাপতি পার্থপ্রতীম রায় দাবি করেছেন, ‘বিনা প্ররোচনায় গুলি চালিয়েছে বাহিনী।’
যদিও তৃণমূলের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে বিজেপি। সাংসদ নিশীথ প্রামাণিকের বক্তব্য, ‘কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরা পাগল নন যে, তারা বিনাপ্ররোচনায় নিরীহ মানুষকে গুলি করে খুন করবে। তারা প্রশ্ন তুলেছে, ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিদের যেতে কেন বাধা দিয়েছে তৃণমূল? প্রকৃত ঘটনা যাতে সাধারণ মানুষের কাছে না পৌঁছয়, সেইজন্যই সংবাদ মাধ্যমকে ঘটনাস্থলে পৌঁছতে দেওয়া হয়নি।’ এদিন বিকেলে বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারীও এই ঘটনার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উসকানিকে দায়ী করেছেন।
তবে নিজের দাবিতে অনড় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই ঘটনার সিআইডি তদন্ত হবে বলে জানিয়েছেন। কিন্তু তিনি এখন তদারকি মুখ্যমন্ত্রী। তাই তিনি এই নির্দেশ দিতে পারেন কিনা, তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে।