ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. মুহম্মদ শামসুজ্জোহার শাহাদাত দিবস আজ (১৮ ফেব্রুয়ারি)। ১৯৬৯ সালের এ দিনে পাকবাহিনী গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
দেশের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী খ্যাত ড. জোহার শাহাদাতবার্ষিকীকে ‘শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। আজও দিবসটি উপলক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
পাকিস্তানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে উত্তাল গণ-আন্দোলন চলছে পূর্ব পাকিস্তানে। প্রবল আন্দোলনে ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ছাত্র আসাদ (আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান), ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দি অবস্থায় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে আইয়ুব খানের লোকেরা হত্যা করলে এর প্রতিবাদে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিবাদের দাবানল ছড়িয়ে পড়ে।
দেশের নানা স্থানে সান্ধ্য আইন, ১৪৪ ধারা জারি হয়। এ দাবানলের শিখা জ্বলে উঠে রাজশাহীতেও। ১৭ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় জেলা প্রশাসন রাজশাহী শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে সব ধরনের মিছিল-মিটিং নিষিদ্ধ করে। ওইদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ মুক্তিকামী জনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের উদ্দেশ্যে শোভাযাত্রা বের করেন।
শোভাযাত্রাটি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ অধ্যক্ষের বাসভবনের সামনে পৌঁছালে আইয়ুব খানের পেটোয়া পুলিশবাহিনীর সঙ্গে ছাত্র-শিক্ষকসহ মুক্তিকামী জনতার সংঘর্ষ বাঁধে। এ ঘটনার পরদিন ১৮ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়ে উত্তেজনা। বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা আবার ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রস্তুতি নেন।
অপরদিকে সশস্ত্রবাহিনীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইনগেটে প্রস্তুত রাখাসহ গেট তালাবদ্ধ করে রাখা হয়- যেন ছাত্র-জনতা বের হতে না পারেন। এরপর আন্দোলনরত বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা সব প্রতিরোধ ও বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে মেইনগেটের সীমানা প্রাচীর টপকে বের হওয়া শুরু করলে শিক্ষকরা মেইনগেটের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রহরীকে গেট খুলে দেয়ার নির্দেশ দেন। এমন সংকটময় মুহূর্তে মুক্তিকামী ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে সামরিক জান্তার দোসররা রাইফেল উঁচিয়ে গুলি করার প্রস্তুতি নিতে থাকলে ছাত্ররা পাকবাহিনীর পার্ক করা একটি গাড়িতে কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেয়।
এই পরিস্থিতিতে ড. জোহা পাকসেনা অফিসারদের সঙ্গে কথা বলার জন্য এগিয়ে যান এবং তাদের অনুরোধ করেন যেন সেনাবাহিনীর তরফ থেকে কোনো ধরনের উস্কানিমূলক পদক্ষেপ নেয়া না হয়। সময় অতিবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কে ছাত্র-জনতার ঢল নামতে শুরু করলে পাকবাহিনীর দোসররা তাদের ওপর গুলি করতে প্রস্তুত হয়।
সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে যায়। শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে ড. জোহা হাত উঁচিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের বলছিলেন ‘প্লিজ, ডোন্ট ফায়ার, প্লিজ, ডোন্ট ফায়ার, দে আর স্টুডেন্টস। দে আর আওয়ার চাইল্ডস।’
তবে হঠাৎ সবাই চমকে গেলেন, ‘ফায়ার’ শব্দে এলো আদেশ, গুলির শব্দ সেকেন্ডের ব্যবধানে ছাপিয়ে উঠল সবকিছু। কোনো নির্দিষ্ট টার্গেট নয়, এলোপাতাড়ি গুলি চললো।
শিক্ষার্থীদের জীবন রক্ষা করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হলেন ড. জোহা। পাকিস্তানি বাহিনীর দুর্বিনীত, সৈন্য, অফিসাররা আদেশ পেয়ে বেয়নেট দিয়ে খোঁচাতে লাগল ড. জোহার নিস্তেজ শরীর।
পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী শামসুজ্জোহার রক্তাক্ত প্রায় নিথর দেহ মিনিউসিপ্যালিটির বারান্দায় নিয়ে গিয়ে ফেলে রাখা হয়। বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত তাকে এভাবে ফেলে রাখা হলো। ৪টার দিকে সার্জিকাল বেডে নেওয়ার পর সেখানেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন ড. জোহা।
শহীদ হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রক্টর ও রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহম্মদ শামসুজ্জোহা।
মুহম্মদ শামসুজ্জোহা ১৯৩৪ সালের পহেলা মে পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরের বাঁকুড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। বাঁকুড়া জেলা স্কুল থেকে মেট্রিক এবং বাঁকুড়া ক্রিশ্চিয়ান কলেজে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় পরিবারসহ চলে আসেন বাংলাদেশে। ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ থেকে অনার্স এবং ১৯৫৪ সালে একই বিষয়ে প্রথম শ্রেণিতে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন তিনি।
কর্মজীবনের শুরুতে ড. জোহা পাকিস্তানের অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরিতে সহকারী পরিচালক হিসেবে এবং পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএসসি (স্পেশাল) ডিগ্রি, ইমপেরিয়্যাল কলেজের এআরসিএস ডিগ্রি লাভ করেছেন ড. জোহা।
১৯৫৯ সালের ৪ আগস্ট পশ্চিম পাকিস্তানের ওয়াহ ক্যান্টনমেন্টে সহকারী পরিচালক পদে যোগ দেন কৃতী বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ ও মেধাবী এই গবেষক। ১৯৬১ সালের ১১ জুন ঢাকার গাজীপুরের গজারিয়া গ্রামের হায়াত আলী খানের মেয়ে নিলুফা বেগমকে বিয়ে করেন তিনি।
১৯৬৬ সালে তাদের প্রথম সন্তানের জন্ম হয়। ১৯৬৮ সালের জানুয়ারিতে নরওয়ের অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বছরের উচ্চতর গবেষণার সরকারি বৃত্তি লাভ করেন। ফিরে এসে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পান। ১৯৬৮ সালের ১৫ এপ্রিল ড. শামসুজ্জোহা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
প্রতি বছর ১৮ ফেব্রুয়ারিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। আজকের দিনটি জোহা দিবস উপলক্ষ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, বিভিন্ন আবাসিক হল, পেশাজীবী সমিতি ও সংগঠন, রসায়ন বিভাগ এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে ড. জোহার মাজার ও জোহা স্মৃতিফলকে পুষ্পস্তবক অর্পণসহ নানা কর্মসূচির পালন করবে।
এছাড়াও সকালে জোহা স্মারক বক্তৃতা, বাদ জোহর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে কোরআনখানি ও বিশেষ মোনাজাত এবং বিকেলে শহীদ শামসুজ্জোহা হলে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। ড. জোহা দেশের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী হলেও এখন পর্যন্ত এ দিনটিকে সরকারিভাবে পালন করার কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।
শহীদ ড. মুহম্মদ শামসুজ্জোহার শাহাদাতবার্ষিকীকে (১৮ ফেব্রুয়ারি) ‘জাতীয় শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালন করার দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা জোর দাবি জানিয়ে আসছেন।